রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: গঙ্গার জলে মাছের মতো সাঁতারু তরুণ রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore)। ওপার ছুঁয়ে ফিরে আসতে পারেন এপারে। ক্লান্ত হয় না শরীর। হাঁফ ধরে না বুকে। রাণী চন্দকে একটি চিঠিতে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore), ‘গঙ্গা সাঁতরে তখন এপার ওপার হতাম। নতুন বৌঠান দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠতেন’ (রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন : সমীর সেনগুপ্ত : পৃষ্ঠা ৪৫-৪৬)। গঙ্গার কোলে এসেছেন, গঙ্গার বুকে সাঁতার শিখেছেন, গঙ্গার তীরে বড় হয়েছেন। তবু তিরিশ বছর বয়সে গঙ্গার তীর ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore) চলে গেলেন পদ্মার তীরে? কলকাতার মহল, মহল্লা আর মজলিশ ত্যাগ করে বেছে নিলেন পদ্মার নির্জন চরে, গ্রাম্য পরিবেশে স্বনির্বাসন প্রায় একটানা দশ বছর! কেন? মূলত দুটি কারণে। মাত্র তেইশ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ হারালেন তাঁর ভালবাসার নতুন বৌঠান কাদম্বরীকে। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের পরেই আত্মহত্যা করলেন কাদম্বরী। এবং ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের কাছে ঠাকুরবাড়ির পরিবেশ। দ্বিতীয়ত, তিনি উপলব্ধি করলেন ক্রমশ এমন এক সত্য, এই প্রচারপ্রবণ যুগে আমাদের অনুভব যার আর নাগাল পায় না। এই ফেসবুক-সংক্রামিত কালে আমরা যা কিছু সামান্য কাজই করি না কেন, তার প্রচার ও প্রশংসা চাই মুহূর্তে। এবং তা না হলে আমরা বোধ করি নিদারুণ এক অনিশ্চয়তা। এমনকী অস্তিত্বের সংকট। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বুঝতে পারলেন আত্মপ্রকাশের আগে নিজেকে তৈরি হতে হবে, প্রচার ও প্রশংসার আলো থেকে অনেক দূরের, ধ্যান ও শ্রমমগ্ন নির্জনতায়। সেই আদিম বিস্তারিত নির্জনতা নেই কলকাতার গঙ্গার তীরে। সেই একাকিত্ব এবং মগ্ন সৃজনের পরিবেশ তিনি পেতে পারেন পদ্মার চরে। কিংবা পদ্মার বুকে তাঁর ঠার্কুদা দ্বারকানাথের ‘পদ্মা’-বোটে ভাসতে-ভাসতে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রী-সন্তান-সংসার ছেড়ে, ঠাকুরবাড়ির সমস্ত আরাম ও বিলাসিতা ত্যাগ করে, দশ বছরের জন্য চলে গেলেন নিঃসঙ্গ সৃজন ও সাধনায়। এবং দশ বছর নিবিড় প্রেমে পড়ে থাকলেন পদ্মায়। ভাসলেন পদ্মার নিরবচ্ছিন্ন ভালবাসার স্রোতে। পদ্মার অনন্তজীবনে এসেছে কি এমন প্রবল প্রেমিক যে শুধু পদ্মাকেই ভালবাসবে! যে তরুণ প্রেমিক আদি মানুষের মতো ঘুরে বেড়াবে নিঃসঙ্গ পদ্মাচরের অমাবস্যায় কিংবা পূর্ণিমায়! ভুলে যাবে শহর সভ্যতার আরাম, আয়েশ, আসঙ্গ! পদ্মার মুক্ত প্রান্তরে যে ডুবে থাকবে নদীর নতুন সখ্যে! এবং অনুভব করবে এই নিঃসঙ্গ চরেই এল এই উপলব্ধি যে বিশ্বজগতের মাঝখানে তার স্থান।
কান পেতেছি, চোখ মেলেছি, ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি,
জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার প্রাণ।
এই কান পাতার বড় প্রয়োজন ছিল। এই চোখ মেলার বড় প্রয়োজন ছিল। ধরার বুকে এই প্রাণ ঢালার বড় প্রয়োজন ছিল। এবং রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) জীবনে এই কসমিক মনন সম্ভব হল পদ্মার প্রান্তরে। পদ্মার নিঃসঙ্গ চরের আদিগন্ত ব্যাপ্তি ছাড়া, ওই ধু-ধু ছাড়া, তৈরি হত না রবীন্দ্রনাথের অন্তরমহল! পদ্মার সঙ্গে ওই দশ বছরের সহবাসকালেই রবীন্দ্রনাথ ক্রমশ উপলব্ধি করলেন এক নতুন চেতনার আলো উন্মোচিত করল চিরসত্যের মুখ। সরে গেল মিথ্যার আবরণ। পদ্মার চরেই তিনি শুনতে পেলেন অনন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে নতুন আত্মীয়তার আহ্বান।
পদ্মার তীরে দশটা বছর যে রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিন কত রিস্ক নিয়ে কী অকল্পনীয় বিপদের মুখে কাটিয়েছেন, তা আজ আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। এইটুকু বললেই যথেষ্ট, তিনি যে-কোনও দিন মারা যেতে পারতেন। দু-একটা নিদর্শন দিলেই বুঝবেন, কী অবিশ্বাস্য সাহস তাঁর, কী ভয়ঙ্কর বেপরোয়া তিনি, এবং কীভাবে বিপদ ডেকে আনায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তবে এই দুরন্ত সাহস এই রোম্যান্টিক বেপরোয়ামি ছাড়া কিন্তু পদ্মার প্রেমিক হওয়াও সম্ভব নয়। পদ্মার মতো বিপজ্জনক নদী পৃথিবীতে কম আছে। তাই পদ্মাকে ভালবেসে রবীন্দ্রনাথকে বারবার নামতে হয়েছে বিপদের খেলায়। যে-খেলায় যে-কোনও মুহূর্ত তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত হতেই পারত।
আরও পড়ুন: স্মৃতির আলোয় উজ্জ্বল মরমী গল্পগুচ্ছ
এবার পদ্মার বুকে রবীন্দ্রনাথের ঝুঁকি নেওয়ার মাত্রা কতদূর যেতে পারে, তার গল্পটা বলি। তিনি হঠাৎ ঠিক করলেন আসন্ন বর্ষার মুখে শিলাইদহে তাঁর আর তেমন জুতসই লাগছে না। মনপ্রাণের খোলতাই আসছে না। তিনি শিলাইদহ থেকে সাজাদপুরে যাবেন। তাঁকে থামায় কার সাধ্য? সমস্যা হল পদ্মার একপাড়ে শিলাইদহ। অন্যপাড়ে সাজাদপুর। এটা ঠিক গঙ্গার এপার-ওপার নয়। বর্ষার পদ্মা তো সমুদ্র। যেমন আদিগন্ত বিস্তার, তেমনি তোলপাড়। সেটা ১৮৯৪ সাল। পদ্মার সেই ভয়ঙ্কর রূপ আজ অনেকটাই স্তিমিত।
রবীন্দ্রনাথ সাজাদপুর যেতে চান শুনেই মাঝিদের প্রশ্ন, কোন পথে যাবেন বাবু? বর্ষার পদ্মা পাল তুলে পার হওয়া কি চাট্টিখানি ব্যাপার?
রবীন্দ্রনাথ সব থেকে সহজ কণ্ঠে সব থেকে বিপদের পথটি নেন। বলেন, পাবনার কাছে ইছামতী ধরবি। ইছামতী ধরে সোজা গিয়ে পড়্ হুড়াসাগরে।
—বর্ষায় হুড়াসাগর। বেঁচে ফিরব না কর্তা!
—কিন্তু আমার যে বর্ষার হুড়াসাগরের ভয়ঙ্কর রূপটাই দেখতে ইচ্ছে করছে, আর তোরা ভয় পাচ্ছিস! চল তো ভেসে। হুড়াসাগরে একবার গিয়ে পড়্। হুড়ার টানে ভেসে যাবি বড়ল নদীতে। তারপর বড়লের শাখা সোনাই ধরে নিবি। হু-হু করে ভেসে যাবি রাউতাড়ায়। ওখানে পালকি থাকবে। পালকিতে সোজা সাজাদপুরের কুঠিবাড়ি।
—কিন্তু কর্তা বড়ল যে আরও ভয়ের।
—তোরা যে মরার আগেই মরে আছিস রে! চল্ চল্ কোনও ভয় নেই! বলেন রবীন্দ্রনাথ।
—এক মাঝি ভয়ে ভয়ে বলে, বর্ষাকালের রাত্রে সাজাদপুর যেতে গেলে কুঠিখাল দিয়ে যাওয়াই ভাল! বিপদ অনেক কম কর্তা।
—ছি ছি, রাজার মতো যাব হুড়াসাগর আর বড়ল পেরিয়ে। তার বদলে আমাকে খাল দিয়ে নিয়ে যাবি? সাগর ছেড়ে নালাপথ? সত্যিই রবীন্দ্রনাথ ভরা বর্ষায় ধরেন হুড়াসাগরের পথ। এবং বর্ষায় পদ্মার তোলপাড় দেখতে উঠে যান বোটের ছাদে। একা দাঁড়ান মাস্তুল ধরে। ক্রমশ অন্ধকার নামে। এপার-ওপারের কোনও হদিশ নেই। অন্ধকার আকাশ জুড়ে সাপের মতো খেলা করছে বিদ্যুৎরেখা। বজ্রপাতের শব্দ। নামে বৃষ্টি। ঝাপসা হয়ে যায় উত্তাল পদ্মা। মাঝিদের আর্তচিৎকার উপেক্ষা করে রবীন্দ্রনাথ একা দাঁড়িয়ে থাকেন বোটের ছাদে। তারপর গান বাঁধেন, এক আশ্চর্য গান, যে-গান কাউকে আর গাইতে শুনি না। পদ্মার বুকে টলমলে বোটের ছাদে দাঁড়িয়ে গাইছেন রবীন্দ্রনাথ :
তোমরা হাসিয়া বাহিয়া চলিয়া যাও কুল কুল কল নদীর স্রোতের মতো।
আমরা তীরেতে দাঁড়ায়ে চাহিয়া থাকি, মরমে গুমরি মরিছে কামনা কত।
রবীন্দ্রনাথের চারধারে থইথই করছে মৃত্যু। এবং সেই আদিগন্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে তিনি গান গাইছেন। এবং শিলাইদহ থেকে সাজাদপুর যেতে তিনি ইচ্ছা করে, পরোয়াহীনভাবে, বেছে নিয়েছেন নিশ্চিত মৃত্যুর পথ : শিলাইদহ থেকে পদ্মা ধরে গোয়ালন্দ। এরপর তো এল যমুনা। যমুনা পেরলে তাঁর বোট গিয়ে পড়বে হুড়াসাগরের অনিশ্চিত আবর্তে। এই মরণময় জলপথ পেরতে পারলে তো সাজাদপুরের ঘাট। যেখানে অপেক্ষা করছে তাঁর পালকি। কিন্তু সাজাদপুরে নামলেন না রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে পেয়ে বসেছে নদীর নেশা। তিনি মাঝিদের আজ্ঞা দিলেন সাজাদপুরে বোট না থামিয়ে সোজা ভেসে যা পতিসরে!
— কর্তা, এরপর পতিসর? সে তো সমুদ্র পেরতে হবে!
— তা তো হবেই। চলনবিল তো নামেই বিল। সে তো সত্যিই সমুদ্র। বর্ষার রাত্রে চলনবিলকে সাগর বানায় আত্রাই নদী। চলনবিল পেরিয়ে আত্রাই পেরিয়ে অন্তহীন নাগর নদ। আহা! এইভাবে আত্মহত্যা করতে ভালই লাগবে। জীবনে কাজের মতো একটা কাজ করলাম তা হলে। মনে-মনে প্রায় চুপি-চুপি বলেন রবীন্দ্রনাথ। একদিন তাঁর বোটের মাস্তুল গেল আটকে এক সেতুতে। ব্যস, স্রোতের টানে ক্রমশ কাত হচ্ছে বোট। সূর্যাস্ত হয়েছে সবে। তখন এই বিপদ। রবীন্দ্রনাথ মাঝিদের বললেন, তোরা জলে ঝাঁপ দে। বলেই তিনি ছুটে উঠে গেলেন ছাদে। মাস্তুল ধরে পদ্মার স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করে বোটটাকে সোজা করে দিলেন।
মাঝিরা হতবাক। কর্তার গায়ে এত জোর! এত শক্তি দেবতার মতো মানুষটার গায়ে!
প্রেমিকা পদ্মার সঙ্গে এইভাবে বিপজ্জনক জীবন কাটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ দশ বছর! একেই কি বলে, পাগলির সঙ্গে ঘর করা!