`আমার মত এই যে, ভারতবষের্র বুকের উপর যত কিছু দুঃখ আজ অভ্রভেদী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার একটিমাত্র ভিত্তি হচ্ছে অশিক্ষা। জাতিভেদ, ধর্মবিরোধ, কর্মজড়তা, আথির্ক দৌর্বল্য আঁকড়ে আছে শিক্ষার অভাবকে।’ রবীন্দ্রনাথ কোন দৃষ্টিতে শিক্ষাকে দেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) শিক্ষাচিন্তা আর কর্মকাণ্ডের পিছনে কাজ করেছে তাঁর জীবনের দুটি অভিজ্ঞতা একটি ছেলেবেলার অন্যটি যৌবনের।
আরও পড়ুন: অর্ধেক আকাশ জুড়ে উড়ান, তিনিই ডানা জুগিয়েছেন
ছেলেবেলার স্মৃতি আঁকতে গিয়ে তিনি দমবন্ধ পরিবেশের কথা তাঁর জীবনস্মৃতিতে উল্লেখ করেছেন। আর যৌবনে রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore) এই শহর কলকাতার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত। জোড়াসাঁকোর তেতলার ছাদ বই পড়া আর সাহিত্যের আড্ডা গানের আসর নাটকের মহড়া স্বদেশি ভাবনা আরও কত কি তাঁকে পেয়ে বসেছিল। সেই রবীন্দ্রনাথেরই মন এক বড় ধাক্কা পেয়েছিল শহরের জীবন পেরিয়ে গ্রামের জীবনের অভিজ্ঞতার সম্মখুীন হয়ে। জোড়াসাঁকোয় জন্ম হওয়া এই কবি এক সময় গিয়ে পৌঁছলেন পদ্মাতীরের গ্রামে। সেখানে তিনি দেখলেন এক অন্য জীবন। সেই প্রথম অনুভব করলেন এখানে কম, প্রকৃতিই বড়ো। আর যাদের দেখলেন তা বড় বেদনার। তাঁর মনে এল প্রবল ঢেউ। তিনি দেখলেন গ্রামে বাঁধা মানষুগুলি রয়েছে গভীর অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে। দেখলেন শিলাই দহের মানষুজন গ্রামের প্রকৃতি। সেই অশিক্ষার ছবি তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর `বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক একটি প্রবন্ধে। যেখানে রবীন্দ্রনাথের অন্তরের গভীর শোক ও বেদনার ছবি প্রতীয়মান। তখন থেকেই হয়তো তিনি মনে মনে বাঁধছিলেন তাঁর স্বপ্নে বিশ্বভারতীর সুর। তিনি ঠিক করলেন দেশের প্রথম ও প্রধান প্রয়োজন শিক্ষা। যেখানে তিনি অনুভব করলেন শিক্ষাই পারে সমাজের শতকরা আশিভাগ সমস্যার সমাধান করে দিতে। আর আমাদের দেশের শতকরা প্রায় আশি ভাগই গ্রামীণ মানষু, সেই ভাবনা থেকেই তাঁর বিশ্বভারতী গড়ে তোলার স্বপ্ন শুরু। যেখানে শিক্ষা শুধু শহরমুখী হয়ে থাকবে না, বদ্ধ ঘরের নাভিশ্বাস তোলা শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত ভাবনাতেই উন্মুক্ত পরিবেশকে বেছে নিলেন তাঁর স্বপ্নের শিক্ষা ভাবনায়। তিনি ভাবলেন মুক্ত আকাশের নীচে প্রাকৃতিক আবেষ্টনে বসাতে হবে তরুণ শিক্ষার্থীদের। যেখানে গুরু-শিষ্যের মিলন হবে অন্তরঙ্গ। অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যেই শিক্ষাথীর্রা পাঠ নেবে। পুঁথি সবর্স্ব বিদ্যা নয়, থাকবে বিচিত্রবিদ্যার বিপুল আয়োজন। সেই ভাবনাতেই জারিত হয়ে পঠন পাঠনের সঙ্গে যুক্ত হল সংগীত, চিত্রকলা, শারীর-চর্চা, নাটক, উত্সব অনুষ্ঠান, শিল্পকলা থেকে গ্রাম সেবা এবং নৈশ বিদ্যালয়ও। মাত্র কতিপয় ছাত্রকে নিয়ে শুরু হল শিক্ষার পথ চলা। বীরভমের বোলপুরের মাটিতে এক নবদিগন্ত সূচিত হল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) হাতে। এখানে তাঁর পিতার কথা ভুললে চলবে না। ১৯০১ সালে কতিপয় ছাত্র নিয়ে যে বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু তারপর সেখানে ছাত্রদের পাশাপাশি সমাগত হল ছাত্রীরাও। প্রবর্তন হল সহ-শিক্ষার। ছাত্রছাত্রীরা আর শুধু বাঙালিই রইল না সেই সারিতে এসে ভিড় করলেন বিদেশের পড়ুয়ারাও। শান্তিনিকতনের শিক্ষা ক্রমশই রূপ নিল আন্তর্জাতিকতার। একদিকে দেশ বিদেশ থেকে শিক্ষকের সমাগম অন্য দিকে আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া। সেদিনের সেই গ্রামীণ বিদ্যালয় খুব দ্রুত গ্রামীণ আশ্রম বিদ্যালয় থেকে একদিন হয়ে উঠল বিশ্বভারতী। সেই সাধনার যজ্ঞশালায় এসে যোগ দিয়েছেন কত মনীষী। কত গুণী শিল্পী। ভারতের নানা অঞ্চল থেকেই শুধু নয় প্রাচুর্য ও পাশ্চাত্যের নানা দেশ থেকেও। সে তলিকায় চালর্স ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজ, উইলিয়াম পিয়াসর্ন, সিলভ্যা লেভি, লেনাড এলহার্মস্ট, উইনটারনিজ, পল রিশার, য়োনে নোগুচি-র মতো অসংখ্য বিদেশি পণ্ডিত। ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় থেকে বহু দেশীয় পণ্ডিতও এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের নিরলস অবদানের কথা রবীন্দ্রনাথ বার বার স্বীকার করেছেন। আসলে রবীন্দ্রনাথ প্রাকিৃতক পরিবেশের মধ্যে শিক্ষার আবহ তৈরির পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের শুধু শিক্ষা দিতেই চাননি চেয়েছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মহা সম্মিলন ঘটাতে। আন্তর্জাকিতা পেলেও গভীর সংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল বিশ্বভারতীকে এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও। তিনি অকেুতাভয়ে এগিয়ে গিয়েছেন। যে কোনও প্রতিবন্ধকতা পার হতে চেয়েছিলেন। বিশ্বভারতীর উন্নয়ন কল্পে তিনি তাঁর নাটক গানকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন দেশান্তরে। শিক্ষাথীর্র মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রান্তে প্রান্তে। আবেদন করেছিলেন দ্বারে দ্বারে। সেই আবেদনে স্বয়ং গান্ধীজি এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন কবিগুরুর পাশে।এসেছিলেন দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র বসু, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু থেকে আরও অনেকেই। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই একদিন হয়ে উঠল জাতীয় সম্পদ। তা হয়তো কবিগুরুর দেখে যাওয়া হয়নি, কিন্তু এই সান্ত্বনা নিয়ে গিয়েছিলেন যে দেশ স্বাধীন হবে এবং হলে স্বাধীন ভারতে রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় সম্পদে পরিণত হবে।দেশবাসীর সেই আশ্বাস পর্ণূ হয়েছিল। যে শিক্ষার আলোকে তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন আপামর ভারতবর্ষের মানেুষর কাছে। এটাই সার্থক হয়ে উঠেছিল এই ভাবনায় যে তা শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের দরবারেও পৌঁছেছিল। কবিগুরুর শিক্ষা প্রয়াস পেয়েছে যথাথ র্সার্থক রূপ। একদিন একটি প্রাচীন তপোবনের আদশের্ই সূচিত হয়েছিল শান্তিনিকেতনের গোড়া পত্তন। তবে সেই তপোবনে প্রাচীন ধারণাই আটকে ছিল না, তাতে রবীন্দ্রনাথ লাগিয়েছিলেন পশ্চিমী শিক্ষার, বিজ্ঞান চর্চার সম্মিলন। সেই পথ ধরেই বিশ্বভারতীর পথ চলা। তাঁর মৃতু্যর এত বছর পরেও শ্রাবণের ধারার মতোই বার বার যেমন তিনি স্মরিত হন বাংলা ও বাঙালির মনে তেমনই তাঁর শিক্ষার মহান দিকটিও আমাদের সামনে বার বার উঠে আসে। দুই রবীন্দ্রনাথ আমাদের চোখের সামনে ভাসমান হয়ে ওঠেন। একজন স্কুলের বব্ধ ঘরের নাভিশ্বাস থেকে পরিত্রাণ চাওয়া রবীন্দ্রনাথ আর একজন শিল্প সংগীত সাহিত্যের অন্যতম স্রষ্টাপরুুষের পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষানরুাগী রবীন্দ্রনাথ।