ছোটবেলা থেকেই পাতার পর পাতা নিখুঁত অঙ্ক কষে সবাইকে অবাক করে দিত মেয়েটি। অঙ্কের বিভিন্ন ফর্মুলায় সাদা পাতাগুলোকে ভরিয়ে তুলত মেধাবী এই মেয়ে। শুধু অঙ্কই নয়, এর পাশাপাশি খেলাধুলোতেও সে ছিল সমান পারদর্শী।
ক্রিকেট ও হকিতেও ছিল তাঁর অসামান্য দক্ষতা! ১৯৩৮ সালে মোট ছটি ডিস্টিংশন নিয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পরে যখন স্কলারশিপ হিসাবে ত্রিশ পাউন্ড আর দাদুর কাছ থেকে পুরস্কার হিসেবে পাওয়া পাঁচ পাউন্ড কীভাবে খরচ করবে, ভেবে কূল-কিনারা করতে পারছিল না মেয়েটি, তখন তাঁর বাবা তাঁকে জানালেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টালমাটাল পরিস্থিতিতে যেসব রিফিউজি ছেলেমেয়ে অর্থের অভাবে পড়াশুনো করতে পারছে না, এই অর্থ তাদের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। মেয়েটি কিন্তু দ্বিধা করল না, সঙ্গে সঙ্গেই মনস্থির করে নিল—বেশ, তাই হবে। নিজের ক্ষুদ্র ইচ্ছেপূরণের শখ ছোট্ট ওই মেয়েটির কাছে সেইমুহূর্তে নিতান্তই বাহুল্য বলে মনে হতে শুরু করে! তুখড় মেধার অধিকারিণী এই নারী ছিলেন ভবিষ্যতের বিজ্ঞানী রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন (Rosalind Franklin)।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের সফল মহিলা গবেষক, যিনি বংশগতির আণবিক গঠন নিয়ে সফলতার সঙ্গে কাজ করেছিলেন। ১৯৫০ সালের গোড়ার দিকে তিনি একাই ডিএনএ’র গঠন সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। যদিও সেই তথ্যগুলি ব্যবহার করে পরবর্তীকালে ওয়াটসন এবং ক্রিক ডিএনএ আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পান। তবে শুধু ডিএনএ-গঠন সংক্রান্ত আবিষ্কার-ই নয়, করেছিলেন ভাইরাস নিয়ে জটিল এবং অত্যাধুনিক পরীক্ষামূলক গবেষণা। বর্তমানে স্ট্রাকচারাল বায়োলজি বিষয়টির ভিত তিনিই গড়ে দিয়েছিলেন। ডিএনএ’র আণবিক গঠন আবিষ্কারের পরপরই আণবিক জীববিজ্ঞান শাখাতে রীতিমতো এক বিপ্লব শুরু হয়ে গিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ। যেটা ব্যবহার করে ইচ্ছেমতো প্রোগ্রাম করা, ডিএনএ অন্য কোনও অর্গানিজমের মধ্যে স্থাপন করা যেত। একের পর এক অভূতপূর্ব সব আবিষ্কার! ভাবলে অবাক হতে হয় বইকি। অথচ এই প্রতিভাময়ী নারীর জীবনপথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না মোটেও।
১৯২০ সালে, লন্ডনের নটিংহিল অঞ্চলে ২৫ জুলাই, এক সম্ভ্রান্ত ও ধনী ব্রিটিশ ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রোজালিন্ড এলিস ফ্রাঙ্কলিন। বাবা এলিস আর্থার ফ্র্যাঙ্কলিন ছিলেন কলেজের বিজ্ঞান শিক্ষক। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান রোজালিন্ডের ছিল আরও তিন ভাই আর এক বোন। তাঁর বাবা নিজে উচ্চশিক্ষিত হলেও নারীদের উচ্চশিক্ষার বিরোধী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন মেয়ে সমাজকর্মী হোক।
কিন্তু মেয়ের এই ব্যাপারে নিজস্ব সিদ্ধান্ত ছিল ভিন্ন। আর তাতেই তিনি ছিলেন অনড়। তিনি আসলে বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষার পথে পাড়ি দিতে চেয়েছিল প্রথম থেকেই। তাঁর চোখে যে তখন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন! এতটাই নিজের সিদ্ধান্তে সে অনড় ছিল যে কোনও বাধানিষেধ তাঁর বিজ্ঞানসাধনার পথে অন্তরায় হয়নি।
আরও পড়ুন: আমরা সবাই রাধা
প্রাথমিক স্কুলের পড়াশোনা শেষ হলে তাঁকে সেন্ট পলস স্কুল ফর গার্লস-এ ভর্তি করা হয়েছিল। এই স্কুলে তৎকালীন যুগে মেয়েরা অঙ্ক আর বিজ্ঞান শিখতে পারত। স্কুলে আগাগোড়া ভাল ফল করতেন রোজালিন্ড (Rosalind Franklin)। ১৯৩৮ সালে তিনি স্কলারশিপ নিয়ে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিওনহ্যাম কলেজে ভর্তি হন। রোজালিন্ড ১৯৪১ সালে স্নাতক হন, তারপর রিসার্চ স্কলারশিপ পেয়ে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে রোনাল্ড জর্জ নরিসের অধীনে কাজ শুরু করেছিলেন ঠিকই কিন্তু তা খুব একটা সুখকর হয়নি।
কারণ, নরিস একজন নোবেল বিজয়ী বিশিষ্ট বায়ো-ফিজিসিস্ট ছিলেন বটে তবে মানুষ হিসেবে ছিলেন অন্যরকম—গোঁড়া। রোজালিন্ডের মেধা লক্ষ্য করেও তাঁকে রিসার্চের কাজে তেমন দিশা দেখালেন না। কারণ তাঁর নারীবিরোধী মনোভাব।
১৯৪২ সালে ব্রিটিশ কোল ইউটিলাইজেশন রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনের (BCURA) ফেলোশিপ লাভ করলেন। এই সময় থেকে শুরু হয় তাঁর গবেষণা জীবন। কয়লার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে করতে কয়লা থেকে তৈরি হল গ্রাফাইটের সূক্ষ্ম পাত, সেই পাত থেকে তৈরি হল গ্যাস-মাস্ক। যুদ্ধের বাজারে সেই মাস্ক ছিল সে কালের অন্যতম পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট। আর এই গবেষণার কাজ-এর কথা প্রকাশিত হয়েছিল ‘নেচার’ নামক বিজ্ঞানের বিখ্যাত পত্রিকায়। এরপর ১৯৪৫ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্যাল রসায়নে পিএইচডি অর্জন করার পর পাড়ি দেন প্যারিসে সেখানে এক বিখ্যাত ল্যাবরেটরিতে নতুন ধরনের এক প্রযুক্তি আয়ত্ত করলেন তিনি— ‘এক্স-রে-ক্রিস্টালোগ্রাফি’। এই প্রযুক্তি শেখার সুবাদে আবার লন্ডনের কিংস কলেজে তিন বছরের রিসার্চ ফেলোশিপে নিযুক্ত হলেন রোজালিন্ড, ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি বায়োফিজিক্স বিভাগের অধিকর্তা জন র্যান্ডাল নামের বিজ্ঞানীর অধীনে ডিএনএ (DNA) নামক জৈব অণুর ওপর কাজ করার দায়িত্ব পেলেন। আজকের যুগে ডিএনএ কী তা কারওর অজানা নয়, সেকালে কিন্তু তেমনভাবে জানা ছিল না যে ডিএনএ আমাদের জীব জগতের সব কোষের অন্যতম প্রধান উপাদান যার গঠনে লুকিয়ে আছে আমাদের বংশধারার গোপন সংকেত, আমাদের চেহারা-স্বভাব, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য। রোজালিন্ড এক্স-রে-ক্রিস্টালোগ্রাফির সাহায্যে, ছাত্র রেমন্ড গসলিং-এর সহায়তায় খুব যত্ন সহকারে ডিএনএ-র প্রচুর ছবি তুলতে সক্ষম হন। স্বচ্ছ ও পরিষ্কার ছবি না পাওয়া অবধি তিনি থিম থাকেননি অবশেষে তিনি পেলেন সেই প্রার্থিত ছবি, যার নাম বিজ্ঞানের ইতিহাসে ফোটো ৫১ (Photo 51) বলে পরিচিত। ডিএনএর গঠন চিহ্নিত করতে এই ছবি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক আবিষ্কার। ছবিটি তোলা হয়েছিল ফ্র্যাঙ্কলিনের নিজস্ব কৌশলে একটি মেশিনের সাহায্যে যেটি তিনি নিজে রিফাইন করেছিলেন। এরপর ১৯৫১-’৫৩ সালের মধ্যে রোজালিন্ড ডিএনএ নকশা ও কাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে অনেকখানিই এগিয়ে গিয়েছিলেন। একই সময় আবার জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিকও ডিএনএর গঠন নিয়ে কাজ করছিলেন আর তখনই উইলকিন্সের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে ফ্রাঙ্কলিনের তোলা ছবিটা দেখার সুযোগ পান ওয়াটসন। তিনি ক্রিকের সঙ্গে যৌথভাবে একটি মডেল দাঁড় করিয়েছিলেন। তারপর লিখেছিলেন একটি গবেষণাপত্র। ১৯৫৩ সালে সেটা ছাপা হয় নেচার জার্নালে। সেই গবেষণাপত্রের ফুটনোটে শুধু উল্লেখ করা ছিল যে ফ্রাঙ্কলিন এবং উইলকিন্সের অপ্রকাশিত অবদানদ্বারা তাঁরা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন! অথচ, সত্যি বলতে কী, তাদের সম্পূর্ণ কাজের ভিত্তিই ছিল ফ্র্যাঙ্কলিনের ফটো এবং তাঁর আবিষ্কার! এর কিছুদিন পর নেচার পত্রিকায় ফ্রাঙ্কলিনের গবেষণাপত্রটিও পাঠানো হয়। বিষয়বস্তু এক বলে নেচারের সম্পাদকমণ্ডলী সেটা ছাপতে অনিচ্ছুক হন । দুর্ভাগ্যবশত তাঁর এত অবদান লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়।
রোজালিন্ডের (Rosalind Franklin) নিঁখুত এক্স-রে-ক্রিস্টালোগ্রাফির দৌলতে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ ভাইরাসের গঠন সম্পর্কে জানা যায়। এমনকী তিনি প্রাণী ভাইরাস পোলিওর গঠন নিয়েও সফল গবেষণা করতে সক্ষম হন। তার সমাধিফলকে লেখা হয়— ‘ভাইরাস নিয়ে তাঁর কাজ মানবজাতির জন্য দীর্ঘস্থায়ী আশীর্বাদ।’
১৯৫৮ সালের ১৬ এপ্রিল ওভারিয়ান ক্যান্সারে মাত্র ৩৭ বছর বয়সেই তিনি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। ক্ষণজন্মা এই মহিয়সী নারী পেয়েছিলেন উপেক্ষা থেকে গেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে।
২০২০ সালে তাঁর জন্মের শতবর্ষ উপলক্ষে ব্রিটিশ রয়াল মিন্ট তাঁর স্মরণে একটি ৫০ পেনির মুদ্রা প্রচলন করলেন, যার মধ্যে খোদাই করা আছে সেই বিখ্যাত Photo 51-। বিজ্ঞানী মহলে রোজালিন্ড ছাড়া মাত্র একজন এই স্মরণ-মুদ্রা সম্মানে ভূষিত হয়েছেন, তাঁর নাম— স্টিফেন হকিং।
এই বিশ্বে বেশ কিছু মানুষ আজও মনে করেন— বিজ্ঞান গবেষণার জগতে একজন নারী বলেই কেবলমাত্র রোজালিন্ড তাঁর প্রতিভার যথোপযুক্ত মর্যাদা পাননি। তবে কঠোর পরিশ্রম কখনওই বিফলে যায় না তাই ১৯৯৭ অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর ৩৯ বছর পর সুদূর মহাকাশের একটি গ্রহাণু তাঁর নামেই উৎসর্গ করা হয়েছে যার নাম— Rosfranklin।