সাহিত্য জগতে এলেন কীভাবে?
সাহিত্য জগতে এসেছি মূলত বাংলা কবিতাকে ভালোবেসে। আমি আগে চাকরি করতাম কলেজ স্ট্রিটের একটি পাবলিকেশনে। যখন জানা গেল আমার ছেলের অটিজম রয়েছে, তখন তাকে সময় দেবার জন্য আমি চাকরি ছেড়ে দিই। সেই সময় আমি বাড়িতে অনেকটা সময় পেতাম। একটা সময় বাংলা কবিতা নিয়ে একটা কিছু করার স্বপ্ন দেখতাম। হাতে যখন কিছুটা সময় পেলাম তখন আমি স্বপ্ন পূরণ করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠি। সিদ্ধান্ত নিই একটি পত্রিকা প্রকাশ করব। সম্পাদনা করব নিজেই। পত্রিকার নাম রাখলাম ‘শুধু বিঘে দুই’। যা আত্মপ্রকাশ করল ২০১২ সালে। যদিও প্রস্তুতি শুরু হয়েছে তার কিছুটা আগে।
বই পড়ার প্রতি আগ্রহ কোন সময় থেকে?
আমরা বরাবর হাওড়ার বাসিন্দা। বাড়িতে পড়াশোনার একটা রেওয়াজ ছিল। বাড়ির প্রায় সবাই বই পড়তেন। বাবা, পিসি, মা, ঠাকুমা, দাদু— সবাই। এভাবেই বই পড়ার প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়। বিভিন্ন ধরনের বই পড়তাম। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, যা পেতাম, পড়তাম। যেতাম লাইব্রেরিতে। বইমেলায়। বই কিনতাম কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া থেকেও। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। যদিও পড়াশোনাও করেছি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে বন্ধুদের সঙ্গে বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতাম। আমার উচ্চশিক্ষা হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে। পরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বই পড়ার পাশাপাশি তখন পড়া শুরু করি বিভিন্ন পত্রপত্রিকা। ভালোবাসতাম মূলত লিটল ম্যাগাজিন পড়তে। তখন থেকেই লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করার স্বপ্ন দেখতাম। বন্ধুরা আমাকে উৎসাহ দিত। যদিও কলেজ, ইউনিভার্সিটি পর্ব শেষ হবার পর বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে আসে। তবে আমি আমার মনের ইচ্ছাকে দমন করিনি। সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম।
প্রথম সংখ্যা থেকেই আপনার পত্রিকায় দেখা গেছে পরিকল্পনার ছাপ। এটা কীভাবে সম্ভব হল?
পরিকল্পনা করে কিছুই করিনি। যখন আমি পত্রিকা প্রকাশ করার কথা ভাবি, তখন ছিলাম আমি আনকোরা। নতুন। সাহিত্য জগতের কেউই আমাকে চিনতেন না। ছিল না কোনও পরিচিতি। যদিও এখনও যে আমার খুব একটা পরিচিতি হয়েছে, এটা আমি মনে করি না। পত্রিকা প্রকাশের শুরুতে আমাকে সাহায্য করেছিলেন কবি শোভন পাত্র। জোগাড় করে দিয়েছিলেন প্রচুর লেখা। পত্রিকার প্রচ্ছদও তিনিই করে দিয়েছিলেন। সেই সমস্ত লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ‘শুধু বিঘে দুই’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা। পত্রিকাটি কবিতা বিষয়ক। প্রকাশের আগে পর্যন্ত আমি ভাবিনি পত্রিকাটি এতটা পাঠকের সমাদর পাবে। ২০১৩ সালে আমি অংশগ্রহণ করি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লিটল ম্যাগাজিন মেলায়। পরে অংশগ্রহণ করি কলকাতা বইমেলায়। বহু মানুষ পত্রিকা কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর থেকে আর লেখার জন্য ভাবতে হয়নি। সারা বছর ধরেই কবিতা আসতে থাকে।
আপনার পত্রিকায় প্রাধান্য দেওয়া হয় নতুন কবিদের। এর কারণ কী?
আমি মনে করি লিটল ম্যাগাজিন মূলত নতুনদের জায়গা। তাঁরাই ঐতিহ্যকে বহন করে নিয়ে যান। তাই আমি বরাবরই নতুনদের লেখা তুলে আনার ব্যাপারে সচেষ্ট থেকেছি। খোঁজ করেছি এমন কবির, যাঁর লেখার মধ্যে নতুন কিছু আছে। নতুন ভাষা, নতুন বলার ভঙ্গিমা। লিটল ম্যাগাজিন সবসময় একটু অন্যরকম কিছু করতে চায়। আমিও চেয়েছি একটু অন্যরকম কিছু করতে। খুব খুশি হই অচেনা অজানা কোনও নতুন কবি যখন কবিতা পাঠান। আমার পত্রিকা কবিতার প্রতি উৎসর্গীকৃত। তাই গল্প প্রকাশের কথা কোনওদিন ভাবিনি। এখনও পর্যন্ত কবিতার হাত ধরেই এগিয়েছি। আগামী দিনে কী হয় দেখা যাক। প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পর ‘সাহিত্যের ইয়ারবুক’ দেখে-দেখে বহু বিশিষ্ট মানুষের ঠিকানায় পত্রিকা পাঠিয়েছি। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই নীরব ছিলেন। তবে মতামত জানিয়েছিলেন কবি গৌতম বসু এবং কবি গৌতম চৌধুরি। দু-জনেই বিভিন্নভাবে উৎসাহ ও পরামর্শ দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে বহু মানুষের ভালোবাসা, প্রশ্রয় পেয়েছি।
আরও পড়ুন-শিখর চুম্বনে মেয়েরাও
পত্রিকা কোনও পুরস্কার পেয়েছে?
আমার পত্রিকা পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত লিটল ম্যাগাজিন সারস্বত সম্মান। পেয়েছি কিছু আর্থিক অনুদান। বিধাননগরের রবীন্দ্র ওকাকুরা মঞ্চে সাহিত্য উৎসব ও লিটল ম্যাগাজিন মেলায় আমার হাতে সম্মাননা তুলে দিয়েছিলেন কবি জয় গোস্বামী। ছিলেন দেবেশ রায়-সহ অনেকেই।
পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি আপনি দুটি প্রকাশনা সংস্থা চালাচ্ছেন। কোন বছর প্রকাশনার জগতে পা রেখেছেন?
‘শুধু বিঘে দুই’-এর প্রকাশনা শুরু ২০১৬ সালে। এই প্রকাশনা থেকে প্রকাশ করি কবিতার বই। মূলত এক ফর্মার। ‘আলপথ’ প্রকাশনা থেকে গল্পের বই। ইতিমধ্যেই বেশকিছু বই আমি প্রকাশ করেছি। আগামী দিনে সংখ্যাটা আশা করি বাড়বে। প্রকাশনা থাকলেও, পত্রিকার গুরুত্ব আমার কাছে অনেক বেশি। অতিমারির মধ্যেও আমি সংখ্যা প্রকাশ করেছি। চলছে নতুন সংখ্যার কাজ। আসলে প্রকাশনায় এসেছি পত্রিকাকে বাঁচানোর জন্য। পত্রিকা প্রকাশ করতে আর্থিক খরচ প্রচুর। প্রতি বছর পত্রিকার জন্য আমার অনেক টাকা ধার হয়ে যায়। সেটা শোধ করতে করতেই শুরু হয়ে যায় নতুন সংখ্যার কাজ। পত্রিকা তো খুব বেশি বিক্রি হয় না যে সহজেই ধার শোধ করে ফেলতে পারব। তার উপর আমি লেখক-সহ কিছু মানুষকে সৌজন্য কপি দিই। সেই সংখ্যাটা কম নয়। কম নয় পত্রিকার আয়তনও। সব মিলিয়ে অনেক খরচ। বিজ্ঞাপন ছাড়াই বেরোয় আমার পত্রিকা। পত্রিকাকে অন্যভাবে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য আমার প্রকাশনায় আসা। বই প্রকাশ করি সম্পূর্ণ নিজেরই খরচে। কবিরা সুন্দর সুন্দর পাণ্ডুলিপি দিয়েছেন, দেন। বইগুলো প্রকাশ করে প্রশংসা পেয়েছি বহু মানুষের। লিটল ম্যাগাজিন মেলা এবং কলকাতা বইমেলা থেকে অনেকেই কিনে নিয়ে গেছেন বইগুলো। তাঁরা কেউ চেনা, কেউ অচেনা পাঠক। এই প্রসঙ্গে বলতে হয় কবি জয় গোস্বামীর কথা। তাঁর সঙ্গে আমার সামনাসামনি পরিচয় সেভাবে হয়নি বললেই চলে। শুনেছি, উনি প্রথম থেকেই আমার পত্রিকা পড়তেন। আমাদের এক ফর্মার বইগুলো দেখে ওঁর এতটাই ভাল লেগেছিল যে উনি আমাকে ফোন করে তা জানিয়েছিলেন। কোনওদিন আমি জয় গোস্বামীর ফোন পাব, স্বপ্নেও ভাবিনি। ওঁর প্রশংসা পেয়েছি, এটা আমার খুব বড় প্রাপ্তি।
আপনার লেখালিখি খুব কম। তার কারণ কী?
খুব একটা লেখার তাড়না আমি অনুভব করি না। সম্পাদনার কাজ করতেই বেশি ভালোবাসি। আগে যখন চাকরি করতাম, তখন সম্পাদনার কাজই করতাম। এখনও একটি ইংরেজি প্রকাশনা সংস্থায় ফ্রিল্যান্স সম্পাদনার কাজ করি। এর পাশাপাশি যখন লেখার ইচ্ছে হয়, তখন লিখি।
লিটল ম্যাগাজিনের সমস্যার কথা একটু বলবেন?
লিটল ম্যাগাজিনের মূল সমস্যা বিপণনের জায়গাটা। লিটল ম্যাগাজিন মেলা আর বইমেলা ছাড়া আমাদের বই-পত্রিকা বিক্রির কোনও জায়গা নেই। কলকাতার ও বিভিন্ন জেলার যেসব বইবিপণি লিটল ম্যাগাজিন রাখে ও বিক্রি করে, তাদের বেশিরভাগই পেমেন্ট দেওয়ার ব্যাপারে উদাসীন!
পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি আপনি অটিজম নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। বিষয়টা নিয়ে কিছু জানাবেন?
আমার ছেলের অটিজম আছে বলেই হয়তো অটিজম নিয়ে আমার পড়াশোনার শুরু। অটিজম নিয়ে স্পেশ্যাল এডুকেশন কোর্সও করছি আমি। অটিজম নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে আমাদের সমাজে। অনেকে মনে করেন অটিজম একটি রোগ যা চিকিৎসা করে সারিয়ে দেওয়া যায়। অনেকে ভাবেন অটিস্টিক মানুষেরা মানসিক রোগী, মেন্টালি রিটার্ডেড বা ইন্টেলেকচুয়ালি ডিজেবল। এই ধারণাগুলো সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। অটিজম একটি কন্ডিশন, একটি অবস্থা, যা অটিস্টিক মানুষের সারাজীবন থাকে। অটিজম রোগ নয়, তাই একে সারিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ অবান্তর। অটিজম ইন্টেলেকচুয়াল ডিজেবিলিটিও নয়। অটিস্টিক মানুষদের বোধবুদ্ধি অনেক প্রখর, তাঁরা সবকিছু বোঝেন, কিন্তু নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার জায়গাটায় তাঁদের কিছু অসুবিধে থাকে। ডিজেবিলিটি যদি কোথাও থাকে সেটা ওই সোশ্যাল স্কিল আর কমিউনিকেশনের জায়গাটায়। কথোপকথন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলা, সমাজে মেলামেশা করার জায়গাটায় তাঁরা পিছিয়ে থাকেন। সঠিক থেরাপির মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যায়। এই সচেতনতাটা আমাদের সমাজে বড় অভাব। অটিস্টিক মানুষকে পাগল, অ্যাবনরমাল, মানসিক রোগী ইত্যাদি বলে দাগিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা আছে। স্কুলজীবন থেকে শুরু করে চাকরি-জীবন, পারিবারিক-জীবন, সব জায়গাতে একই ছবি। এ-সবের বিরুদ্ধেই আমার লড়াই। যদি একজনকেও সচেতন করতে পারি, ভুল ধারণাগুলো ভেঙে দিতে পারি, সেটুকুই হবে আমার প্রাপ্তি।