কয়েক বছর আগে মুক্তি পেয়েছিল সুজিত সরকারের ছবি ‘পিকু’। দীপিকা পাড়ুকোন ছিলেন তাতে। তাঁর বিপরীতে ইরফান খান। কিন্তু মূল ভূমিকায় অবশ্যই অমিতাভ বচ্চন। এক খিটখিটে বুড়ো, যে সারাক্ষণ কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভোগে। ছবি কিন্তু হিট। লোকজনের সঙ্গে একটু কথাবার্তা বললেই বোঝা যাচ্ছিল। দীপিকা কিংবা ইরফান আছেন ঠিকই, কিন্তু পিকু ছবির মূল আকর্ষণ অবশ্যই অমিতাভ বচ্চন। সুজিত সরকার অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মতো একটা একেবারে অন্যরকম চরিত্রে অমিতাভ বচ্চনকে এনে দর্শকদের মন জয় করে ফেলেছিলেন। অবশ্য সুজিত সরকারই যে প্রথম এরকম একটা কিছু ভেবে ফেলেছেন, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। এর আগে ব্ল্যাক, ভূতনাথ কিংবা পা -এর মতো অনেক ছবিতেই বৃদ্ধ অমিতাভ বচ্চনকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে নিয়ে এসে দর্শকদের রীতিমতো অভিভূত করে ফেলেছেন পরিচালকরা। এই সব ছবিতে কিন্তু অমিতাভ বচ্চন মোটেই স্টার নন। তাঁর অভিনয়ই মানুষকে টেনেছে।
আরও পড়ুন-মহিলা ক্রিকেটের তেন্ডুলকর মিতালি রাজ
আশ্চর্যের বিষয় হল, বলিউডের কোনও প্রাক্তন নায়িকাকে এভাবে কেন্দ্রীয় চরিত্রে এনে ছবি করার কোনও চেষ্টা কিন্তু সেভাবে চোখে পড়ে না। অমিতাভের সমসাময়িক নায়িকাদের মধ্যে হেমামালিনী, শর্মিলা ঠাকুর, জয়া ভাদুড়ী এমনকী রেখা— কারও ক্ষেত্রেই পরিচালকদের এরকম কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। অথচ এঁদের সকলেরই অভিনয়ক্ষমতা সুবিদিত। এর একটা কারণ সম্ভবত, মুম্বইয়ের সাধারণ কমার্শিয়াল ছবির নায়িকাদের ভূমিকাটা এখনও অনেকটা ফুলদানির মতো। নায়কের পাশে থেকে শোভাবর্ধনই তাঁদের মূল কাজ। তাই তাঁদের অভিনয়ক্ষমতা নিয়ে সেভাবে মাথা ঘামানো হয় না। বরং ধরেই নেওয়া হয় দর্শকরা হলে ভিড় জমান মূলত নায়কের আকর্ষণেই। বাংলা ছবির ক্ষেত্রে কিন্তু অবস্থাটা অনেকদিন পর্যন্ত ঠিক সেরকম ছিল না। টালিগঞ্জে সুচিত্রা সেনের দাপটের কথা তো আমরা সকলেই জানি। ১৯৫১ সালে ‘শেষ কোথায়’ ছবি দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল। তবে ছবিটি রিলিজ করেছিল অনেক পরে। সুচিত্রা সেনের প্রথম ছবি মুক্তি পায় ১৯৫৩ সালে, ‘সাত নম্বর কয়েদী’। কিন্তু তখনও তিনি নায়িকা নন, একজন ভীরু অভিনেত্রী মাত্র। কাজের খোঁজে প্রাণপণে চেষ্টা করছেন। যদিও সেই ১৯৫৩-তেই দেবকী বসুর ভগবান ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’-এ তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছে দর্শক। সেই বছরই মুক্তি পেয়েছে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। সেখানে রয়েছে উত্তম-সুচিত্রা রোম্যান্টিক জুটি। কিন্তু তারপরেও আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল সুচিত্রা সেনকে। ১৯৫৪-তে প্রেক্ষাগৃহে এল ‘অগ্নিপরীক্ষা’। উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন দু’জনের কাছেই এই ছবি ছিল আক্ষরিক অর্থেই অগ্নিপরীক্ষা। তাঁদের জুটি বাংলা ছবির দর্শকদের মনে ধরে কি না জানতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন দু’জনেই। ছবি সুপার-ডুপার হিট। শুরু হয়ে গেল উত্তম-সুচিত্রা জুটির জমানা।
এই সময়ের ছবিগুলো একটু ভাল করে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, এখানে কিন্তু সুচিত্রা সেনের ভূমিকা কখনওই ফুলদানির মতো নয়। ছবিতে তাঁর চরিত্রটি নায়কের মতো সমান গুরুত্ব না পেলে ম্যাডাম সুচিত্রা সেন অভিনয় করতে রাজি হতেন না মোটেই। সিনেমার পোস্টারে যে তাঁর নাম আগে রাখতে হত সে-কথাও তো সকলের জানা। অভিনয়ও করতেন সমান দাপটে। উত্তমকুমার ছাড়া অন্য নায়কদের সঙ্গে তাঁর কিছু ছবি, যেমন— ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘সাতপাকে বাঁধা’, ‘দত্তা’ কিংবা ‘দেবী চৌধুরাণী’তে তাঁর ভূমিকা নিশ্চিতভাবেই নায়কের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সুচিত্রা সেন অভিনীত শেষ ছবি ১৯৭৮ সালে, ‘প্রণয়পাশা’। তখন তাঁর বয়স আনুমানিক ৪৯ বছর। তখনও তিনি অসাধারণ সুন্দরী, অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে আর নায়িকার ভূমিকায় মানাচ্ছিল না। সেই সময় ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন বয়স্কা মহিলা, যাঁর অভিনয়ের আকর্ষণই ছবির কেন্দ্রবিন্দু, এমন কোনও ভূমিকার জন্য তাঁকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায় না। তারপরই তো তিনি স্বেচ্ছানির্বাসনেই চলে গেলেন। যদিও উত্তমকুমার কিন্তু তাঁর অভিনয় জীবনের শেষদিকে ক্রমশ গাছের ডাল ধরে গান-করা নায়কের ছবিতে অভিনয় করা থেকে সরে আসছিলেন। অগ্নিশ্বরের মতো কিছু ছবিতে তো তিনি রীতিমতো মধ্যবয়স্ক। যদিও এই ধরনের কোনও ভূমিকায় অভিনয়ের প্রস্তাব দিলে সুচিত্রা সেন তা নিতেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। হয়তো নিতেন না। কারণ দর্শকদের মনে তাঁর যৌবনের সৌন্দর্যকেই চিরন্তন করে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু তাঁর সমসাময়িক অন্য নায়িকারা তো স্বেচ্ছানির্বাসনে যাননি। সুপ্রিয়া, মাধবী, সাবিত্রী, সুমিত্রা, সন্ধ্যা নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। তারপর দিদি, বৌদি থেকে ক্রমশ মাসি-পিসি হয়ে ঠাকুমা-দিদিমাতেও গিয়ে পৌঁছেছেন। এঁরা সকলেই অত্যন্ত শক্তিশালী অভিনেত্রী। কিন্তু টালিগঞ্জের পরিচালকেরা কখনও এঁদের বয়স্ক কেন্দ্রীয় চরিত্র করে ছবিতে এনে, একেবারে অন্য ধরনের ছবি করার কথা ভাবেননি বা সেরকম ঝুঁকি নিতে চাননি। উত্তম-সুচিত্রা জমানার এই নায়িকাদের এখন বয়স অনেকটাই বেশি। সুপ্রিয়াদেবী চলে গেছেন। মাধবীও অভিনয় করেন না বললেই চলে। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় যদিও এখনও রুপোলি পর্দার সঙ্গে যুক্ত আছেন কিন্তু তাঁর শরীরের ক্ষমতা কমে এসেছে অনেকটাই। এঁদের পরবর্তী পর্যায়ের নায়িকাদের মধ্যে তিনজন, শর্মিলা, অপর্ণা এবং মৌসুমি এখনও রীতিমতো গ্ল্যামারাস। অথচ তাঁদের নিয়েও কিন্তু টালিগঞ্জের পরিচালকদের মোটেই তেমন কোনও মাথাব্যথা নেই। যদিও সুযোগ পেলে তাঁরা যে কী করতে পারেন তার উদাহরণ কিন্তু দিব্যি রয়েছে।
প্রথমেই আসা যাক মৌসুমির কথায়। টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়া মৌসুমিকে চিনেছে ‘বালিকা বধূ’ ছবিতে। পরিচালক তরুণ মজুমদার। মৌসুমির নাম কিন্তু আদতে ছিল ইন্দিরা। নাম কী করে বদলাল সে-ও এক ভারি মজার গল্প। ছবি শুরু হওয়ার পর তরুণ মজুমদার বললেন, ইন্দিরা বড্ড কমন নাম। ও নাম ছবিতে চলবে না। নতুন নাম ভাবা শুরু হল। একদিন বাড়িতে বসে ইন্দিরা আর তার দিদি মন্দিরা ভূগোল পড়ছে। সেখানে রয়েছে মৌসুমি জলবায়ুর কথা। মন্দিরা হঠাৎ বলে বসল, এই মৌসুমি নামটা তনুদাকে বল। এটা বেশ ভাল। পছন্দ হয়ে গেল তনুদা অর্থাৎ তরুণ মজুমদারের। ব্যস, ইন্দিরা নাম বদলে হয়ে গেল মৌসুমি। বয়স তখন মাত্র দশ। ক্যালকাটা মুভিটোন স্টুডিওর পাশে বাড়ি। গেছো মেয়ে। পাঁচিল ডিঙিয়ে মাঝে-মধ্যেই স্টুডিওর ভিতরে ঢোকা আর তারপর গোঁফঅলা দারোয়ানের তাড়া খাওয়ার অভ্যাস ছিল। এরই মধ্যে কখন স্কুল যাওয়া-আসার ফাঁকে তরুণ মজুমদার তাঁকে লক্ষ্য করেছেন সে তো আর জানা নেই। কিন্তু একদিন সেই গুঁফো দারোয়ানই তাঁকে ডেকে নিয়ে গেল তরুণ মজুমদারের কাছে।
তনুদা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, সিনেমা করবে? আমি তো দিব্যি ঘাড় নেড়ে বলে দিলাম হ্যাঁ। তনুদা বললেন হ্যাঁ যে বলছ, বাবা রাজি হবেন তো? তার আগের দিনই বাড়িতে আমাদের তিন ভাই-বোনের সঙ্গে বাবার ঝগড়া হয়েছিল। বাবা রেগে বলেছিলেন, দেশও স্বাধীন, তোমরাও স্বাধীন, যা খুশি তাই কর গিয়ে। আমিও সেই ডায়লগটাই তনুদাকে দিয়ে দিলাম। অবশ্য আমার ডায়লগে কোনও কাজ হয়নি। তরুণ মজুমদারের প্রস্তাবে বাবা সরাসরি না বলে দিয়েছিলেন।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য সন্ধ্যা রায়ের মধ্যস্থতায় ছবিতে অভিনয় করা হল। মুক্তি পেল ‘বালিকা বধূ’। তারপরের গল্প তো এককথায় ইতিহাস। বালিকা বধূর পর অজয় করের ‘পরিণীতা’। তারপর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছেলের সঙ্গে বিয়ে। মুম্বই চলে যাওয়া। ‘কাচ্চে ধাগে’, ‘অনুরাগ’, ‘মঞ্জিল’-এর মতো ছবিতে অভিনয়। এককথায় একটা সাতরঙা রামধনুর মতো জীবন। এমন অসামান্য অভিনয় করতেন মৌসুমি যে গুলজার একবার তাঁকে বলেছিলেন, তুমি হচ্ছ সবথেকে কুঁড়ে নায়িকা। যে-কাজ করতে অন্যদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় সেই কাজ তুমি তিন তুড়িতে করো। আর সেজন্য মোটেই পরিশ্রম করতে চাও না!
অনেক পরে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’তে অভিনয়ের সময় উত্তমকুমারও নাকি বলেছিলেন, তুই তো দেখছি অনেক জায়গায় আমাকেও খেয়ে ফেলেছিস। ওগো বধূ সুন্দরীর বেশ কিছু বছর পরে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’। সেখানেও নায়িকা। কিন্তু তারপর বাংলার পরিচালকেরা যেন ভুলেই গেলেন মৌসুমিকে। অথচ তখন হিন্দিতে অভিনয় করা কমে গেছে। হাতে সময় যথেষ্ট। চরিত্রাভিনেত্রী হিসাবে তাঁকে ফিরিয়ে আনতে কোনও সমস্যাই ছিল না। অনেক বছর পরে পর পর দুটি ছবিতে আবার চমকে দিলেন মৌসুমি। দুটিই অপর্ণা সেনের। প্রথমটি ‘জাপানিজ ওয়াইফ’। সেখানে রাহুল বোসের মাসির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন মৌসুমি। একেবারে অন্যরকম একটা চরিত্র। গ্রাম্য বিধবা। হাসি-মজা-ঠাট্টা-তামাশা করতে ভালবাসে। অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন মৌসুমি। অপর্ণা সেন নিজেই বলেছেন, স্নেহময়ের মাসির চরিত্রে মৌসুমি এক কথায় আনপ্যারালাল। ওই গ্রাম্য বাচনভঙ্গি, কথার সুর, শরীরী ভাষা— এগুলো ও যেরকম অনায়াসে করেছে, কল্পনা করা যায় না। কমিক টাইমিংও অসাধারণ। জাপানিজ ওয়াইফের বছরখানেক পরেই অপর্ণা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে করলেন ‘গয়নার বাক্স’। বুড়ি পিসির ভূতের চরিত্রে মৌসুমি। সে ছায়ার মতো আসে, ধোঁয়ার মতো যায়। দর্শকেরা আর সোমলতা ছাড়া তাকে আর কেউ দেখতে পায় না। ছবিতে কঙ্কণা, শাশ্বত, শ্রাবন্তী অনেকেই আছেন ঠিকই, কিন্তু গয়নার বাক্সের গয়নাগুলি সবই দখল করে নিয়েছিলেন মৌসুমি একাই। অপর্ণার নিজের ভাষায়, এই চরিত্রটার জন্য মৌসুমিকে বেছেছিলাম কারণ ওর মধ্যে একটা অসম্ভব উচ্ছ্বাস আছে। যেটা খুন এনডিওরিং। তা ছাড়া মিসচিভিয়াস এলিমেন্টও আছে। এই ছবিতে পিসিমার চরিত্রের জন্য ওটা খুব দরকার ছিল। কারণ তা না হলে চরিত্রের মজাটা ঠিক আসে না। মৌসুমি সাংঘাতিক ভার্সেটাইলও। চরিত্রের বাঁকগুলো চমৎকার ফুটিয়েছে। বিশেষ করে কঙ্কণার সঙ্গে কৌশিকের প্রেমটাতে উসকানি দেওয়া। ইনফ্যাক্ট এই চরিত্রে আমি প্রথমে শর্মিলার কথা ভেবেছিলাম। তারপর একটা সময় নিজে করব কি না তাও ভাবছিলাম। কিন্তু দুটো ভাবনাই বাদ দিলাম একটাই কারণে, আমার আর শর্মিলার মধ্যে শহুরে ভাবটা বড্ড বেশি। নিপাট গ্রাম্যচরিত্রে আমাদের ঠিক মানায় না। সেদিক থেকে মৌসুমি একদম ঠিকঠাক চয়েজ।
গয়নার বাক্স মুক্তি পাওয়ার পর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। বাংলা ছবির তালিকায় যোগ হয়েছে অনেক নতুন নাম। এসেছেন বেশ কয়েকজন নতুন পরিচালকও। মৌসুমি কিন্তু কোনও নতুন ছবিতে কাজ করার জন্য ডাক পাননি। যেভাবে দীর্ঘদিন কোনও বাংলা ছবিতে অভিনয় করার সুযোগই পাননি শর্মিলা ঠাকুর। ঋতুপর্ণ ঘোষের শুভ মহরতে তাঁকে বহুদিন বাদে পেয়েছিল বাঙালি দর্শক। সঙ্গে ছিলেন রাখি গুলজার। আরও এক অত্যন্ত শক্তিশালী বাঙালি অভিনেত্রী। অপর্ণা সেনের ‘পরমা’ ছবিতে রাখির অভিনয় তো এককথায় মাইলস্টোন। এঁদের যিনি রুপোলি পর্দায় ফিরিয়ে এনেছেন সেই অপর্ণা অবশ্য অভিনেত্রীর গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন প্রতিষ্ঠিত পরিচালক। বাংলা ছবির জগতে ইনটেলেকচুয়াল নায়িকা বলতে এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র তাঁকেই বোঝায়। যদিও অপর্ণা নিজে বলেন, আমার নিজের অভিনয় করতে কখনই তেমন ভাল লাগত না। একদম প্রথম দিকের কথা আলাদা। ‘সমাপ্তি’তে অভিনয় যখন করলাম তখন তো ক্লাস এইট। তারপর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়ে ‘বাক্সবদল’। মানিকদার ছবিতে অভিনয় করাটা একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা। কিন্তু অন্য সাধারণ বাংলা ছবিতে, ওই একটা সুন্দরী, লীলায়িত হাবভাবে অভিনয় করতে আমার ভাল লাগত না। দু-একটা ছবির কথা অবশ্য আলাদা। ‘মেমসাহেব’ করতে ভাল লেগেছিল, ‘এখানে পিঞ্জর’ বেশ ভাল। ‘জয় জয়ন্তী’ ছবিতে কাজ করার সময় মনে আছে, আমি নিজে নিজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাচ প্র্যাকটিশ করেছিলাম। তখন তো বাংলা ছবিতে ডান্স কোরিওগ্রাফার বলে কিছু ছিল না। তাই অভিনেতাদের অনেক কিছুই নিজেই ইমপ্রোভাইজ করতে হত। তবে এটা ঠিক যে আমি আসলে যেরকম ছবিতে অভিনয় করতে চাই, সেরকম ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পাইনি। কিন্তু সেরকম ছবি আমি বানাতে পারি। তাই অভিনয়ের থেকে পরিচালনার কাজ আমার বেশি পছন্দের। আমার মনে হয় আমার বুদ্ধি-মনন এসবের একটা স্ফুরণ হয় ছবি তৈরির সময়। যেমন ধরো, অনেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘পারমিতার একদিন’-এ তুমি অমন নিখুঁতভাবে উত্তর কলকাতার ভাষা কী করে ব্যবহার করলে, তুমি তো পুরোপুরি দক্ষিণ কলকাতার মানুষ। আমার প্রশ্নটা শুনে খুব মজা লেগেছিল। কারণ, আমার কাছে এটা কোনও সমস্যাই মনে হয়নি। আমি তো সাহিত্য পড়েছি, আমি জানি উত্তর কলকাতার ভাষা কেমন, সেটাই আমি প্রয়োগ করেছি ছবিতে। আমার বুদ্ধি-মেধার সম্পূর্ণ প্রতিফলন আমি আমার ছবিতে রাখতে চাই। ‘ইতি মৃণালিনী’তে আমি অভিনয় করেছি। ওরকম একটা চরিত্রে অন্য কেউ যদি আমাকে অভিনয় করতে বলত, আমি রাজি হয়ে যেতাম।
আরও পড়ুন-ইন্দিরাজির পুত্র ছিলেন সুব্রতদা
কিন্তু সেই সুযোগ তাঁকে কেউ এখনও পর্যন্ত দেয়নি। কয়েক বছর আগে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘চতুষ্কোণ’ ছবিতে অভিনয় করেছেন অপর্ণা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন চিরঞ্জিত, গৌতম ঘোষ, পরমব্রতও। কিন্তু ছবির মূল আকর্ষণ শুধুই অপর্ণা সেন, একজন পরিণত বয়স্ক নারীর ভূমিকায় অনায়াসে ঝড় তুলছেন প্রেক্ষাগৃহে, ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তেমন সুযোগ কিন্তু এখনও আসেনি। অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে যে পরীক্ষানিরীক্ষা বলিউড করতে পারে, তার থেকে অনেক ছোট মাপের ঝুঁকিও অপর্ণা, মৌসুমি বা শর্মিলাকে বাজি রেখে করার সাহস পায় না টলিউড। উল্টে দান ফেলে যাদের ওপর ভরসা করে পাশার দান উল্টে দিতে তাদের অনেকেরই জুড়ি মেলা ভার।