সাহিত্য অকাদেমির সর্বোচ্চ সম্মান ‘ফেলো’। এইবছর নির্বাচিত হয়েছেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন ভাষার ৭ জন ভারতীয় লেখক পাচ্ছেন এই সম্মান। তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য ইংরেজি ভাষার লেখক রাসকিন বন্ড। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ফেলো নির্বাচিত হওয়ায় খুশি বাংলার সাহিত্য জগৎ। অনেকেই তাঁদের ভালোলাগার কথা জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: অজানা অচেনা বিদ্যাসাগর
এই সম্মান প্রথম পেয়েছেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। ১৯৬৮ সালে। প্রথম বাংলা ভাষার সাহিত্যিক হিসেবে এই সম্মান পেয়েছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৬৯ সালে। তিনি এই সম্মান পেয়েছেন দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে। তারপর ভারতের বিভিন্ন ভাষার বহু কবি-সাহিত্যিক পেয়েছেন এই সম্মান।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরে বাংলা ভাষার লেখক হিসেবে এই সম্মান পেয়েছেন ভাষাচার্য সুকুমার সেন। ১৯৭৩ সালে। তারপর একে একে অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯৮৯), আশাপূর্ণা দেবী (১৯৯৪), সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯৯৬), শঙ্খ ঘোষ (২০০৪), নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (২০১৬) পেয়েছেন এই সম্মান।
যাঁরা অমর সাহিত্যের স্রষ্টা, তাঁদেরই এই সম্মান জানানো হয় সাহিত্য অকাদেমির পক্ষ থেকে।
২০২১ সালে সাহিত্য অকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হলেও, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সাহিত্য অকাদেমি পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৮৮ সালে, ‘মানবজমিন’ উপন্যাসের জন্য। এর পাশাপাশি তিনি পেয়েছেন বিদ্যাসাগর পুরষ্কার (১৯৮৫), বঙ্গবিভূষণ (২০১২) এবং আনন্দ পুরষ্কার (১৯৭৩, ১৯৯০)।
গল্প লেখা দিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁর সাহিত্যজীবন। প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘জলতরঙ্গ’। ছাপা হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’। অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলায় জন্ম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের। দেশভাগের সময় তিনি পরিবারের হাত ধরে চলে এসেছিলেন এইপারে। সেই দিনগুলো তিনি ভুলতে পারেননি। কিছু ঘটনা আজও তাঁকে পীড়া দেয়। প্রথম উপন্যাস ‘ঘুনপোকা’য় ধরা পড়েছে দেশভাগের যন্ত্রণা, উদ্বাস্তু সমস্যা। কাহিনীর মূল চরিত্র শ্যাম। মনে করা হয়, এই চরিত্রের মধ্যে লেগে রয়েছে লেখকের আদল।
নিজেকে তিনবঙ্গের মানুষ মনে করেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। জন্ম পূর্ববঙ্গে। বেড়ে উঠেছেন উত্তরবঙ্গে। থাকেন দক্ষিণবঙ্গে, কলকাতায়। একটা সময় শিক্ষকতা করেছেন। পরে পত্রিকা অফিসে চাকরি।
লেখালিখির বাইরে অন্য কিছু করতে চাননি তিনি। চিরকাল এড়িয়ে গেছেন ভক্তমণ্ডলীদের। তাঁকে ঘিরে একটা বৃত্ত রচিত হোক, চাননি কোনোদিন। তাঁর সাহিত্য জনপ্রিয় হলেও, আপাত জনপ্রিয় সাহিত্য রচনা তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি চিরকাল চেয়েছেন মননশীল সাহিত্য রচনা করতে, বিষয় ও ভাবনার গভীরে পৌঁছতে।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাঙালি সমাজ জীবনে ভাঙন, চরম অস্থিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় তাঁর গল্প-উপন্যাসে বারবার উঠে এসেছে। তার গল্পে ফুটে উঠেছে একবিংশ শতাব্দীর মানুষদের সুখ-দুঃখ, ঘাত-প্রতিঘাত, ব্যক্তিসত্তা, সমাজ-বাস্তবতা। আধ্যাত্মিকতাবাদের মধ্যে সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন, অনুসন্ধান করে চলেছেন জীবনের সত্যতা।
নিজের লেখালিখি সম্পর্কে তিনি একবার বলেছেন, ‘হঠাৎ একটা লাইন এসে যায়। ওই যেমন তুলোর থেকে একটা একটা করে সুতো বেরিয়ে আসে, তেমনি ওই লাইন থেকে শব্দেরা ভিড় জমায়। ভাবনা শুরু হয়, চরিত্র আসে, ঘটনা আসে। আমি শব্দ দিয়ে ছবি দেখতে আরম্ভ করি।’
উজান, কাগজের বউ, দূরবীন, পারাপার, ফুলচোর, পার্থিব, গুহামানব, শ্যাওলা, কাছের মানুষ, খুদকুঁড়ো, দৃশ্যাবলী, বোধন ও বিসর্জন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। লিখেছেন অসংখ্য মর্মস্পর্শী গল্প। বড়োদের পাশাপাশি লিখেছেন শিশু-কিশোরদের জন্যও। তাঁর ভূত ছোটদের ভয় দেখায় না। বন্ধুর মতো মেশে। লিখেছেন গোয়েন্দা উপন্যাস। জনপ্রিয় হয়েছে শবর দাশগুপ্ত গোয়েন্দা চরিত্রটি। তাঁর কাহিনী নিয়ে তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র।
কম কথার মানুষ তিনি। বরাবর নিজেকে প্রকাশ করেছেন শুধুমাত্র লেখনীর মধ্যে দিয়ে। তবে সময় বিশেষে সামান্য হলেও গলা চড়িয়েছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন।
বয়স ৮৫। অসুস্থ। তবু শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আজও পাঠকদের জন্য লিখে চলেছেন। কিছুদিন আগেই প্রয়াত হয়েছেন তাঁর স্ত্রী সোনামন মুখোপাধ্যায়। ভারাক্রান্ত মন। তারমধ্যেই খবর এল, সাহিত্য অকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন ‘মানবজমিন’ স্রষ্টা। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হবে এই সম্মান।
আরও পড়ুন: বিদ্যাসাগরের মশাল এখন জননেত্রীর হাতে
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া :
“সাহিত্য অকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হয়েছি, এটা আনন্দের। তবে আলাদা করে কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। পাঠকের ভালোবাসা পেতে আমার ভালো লাগে। আমি আরও বেশি ভালোবাসা পেতে চাই। এটা পেলেই আমি সবথেকে বেশি খুশি হবো।”