কেন্দ্রীয় সরকার নতুন শিক্ষাব্যবস্থার আড়ালে, এনইপি, ২০২০ নামক অস্ত্রে ঘায়েল করতে চাইছে ভারতীয় সংবিধানকেই। কেন না, একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, ‘নিউ এডুকেশন পলিসি’ এবং নয়া ‘ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক’-এর মাধ্যমে গৈরিকীকরণের ভয়ঙ্কর প্রকল্প চালু করার চেষ্টা চলছে। তার ফলে সংবিধান-স্বীকৃত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি ধ্বংস হবে। বিজেপি শাসিত ভারতবর্ষের শিক্ষাপদ্ধতি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটকের একটি গান মনে পড়ে। ধনঞ্জয় বৈরাগী রাজাকে উদ্দেশ্য করে গেয়ে উঠেছিল— ‘রইল বলে রাখলে কারে? / হুকুম তোমার ফলবে কবে?/ টানাটানি টিঁকবে না, ভাই,/ রবার যেটা সেটাই রবে।…
এবছর মার্চ মাসে একটি ভাষণে মেকলে প্রবর্তিত ঔপনিবেশিক শিক্ষা নীতিকে উৎখাত করে স্বদেশের এবং স্ব-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে নতুন শিক্ষাপ্রণালীর প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের কথা অবশ্য নতুন নয়। ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ এবং মহাত্মা গান্ধী এই বিকল্পসন্ধানের দুই উজ্জ্বল পথিকৃৎ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এমে সেজেয়ার কিংবা এন্গুগি ওয়া থিওংগো স্ব-স্ব পরিপ্রেক্ষিতে নিজস্ব ধারার শিক্ষায় আমূল পরিবর্তনের দিশারি। কিন্তু ‘হিন্দুত্ববাদী’ প্রকল্পের সমস্যা লুকিয়ে আছে অন্যত্র। ‘ভারতীয়’ ইতিহাস, ‘ভারতীয়’ সংস্কৃতি, ‘ভারতীয়’ ঐতিহ্য হিসেবে তাঁরা সর্বদাই বিশেষ ‘হিন্দু’ ধর্মীয় পরিচয়টিকে একমাত্র বিষয় বলে মনে করেন। তাঁদের সেই ‘হিন্দুত্ব’টিও উদারতাহীন, মুক্ততাহীন এক শ্বাসরোধী ঘৃণানির্ভর অস্তিত্ব। ফলে, প্রকৃতপক্ষে তাঁরা শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষিত ছাত্র-যুব-তরুণ প্রজন্মের শ্বাস রুদ্ধ করে দিতে চাইছেন। ‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান’-এর ভারতবর্ষকে ভেঙেচুরে ত্রাস আর সন্ত্রাসের আবহে ফিরিয়ে দিতে চাইছেন অন্ধকার যুগে।
পাঠক্রম (Curriculum) এবং পাঠ্যসূচি (Syllabus) হয়ে ওঠে যেকোনও স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের মতবাদ চাপানোর প্রধান এলাকা। হিটলারের জার্মানি, মুসোলিনির ইতালি এবং স্তালিনের সোভিয়েত রাশিয়ায় সেই চিহ্ন ব্যাপকভাবে দেখা গিয়েছে। বিজেপি এবং তার সহযোগী ‘হিন্দুত্ববাদী’ সংগঠনগুলি বিশেষত আরএসএস সেই একইভাবে ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্তচিন্তা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে। তারই নানা চিহ্ন ফুটে উঠছে একটির পর একটি পদক্ষেপে। তারা আসলে বহুস্বর, বহুপরিচয়, বহু দার্শনিকতার ভারতবর্ষকে ‘একচালা’ বানাতে চায়। পাঠক্রম, পাঠ্যসূচি পরিবর্তন তার প্রথম ধাপ। নিজেদের মতাদর্শ চাপাতে এরা ইচ্ছেমতো বাদ দিতে থাকে নানা প্রসঙ্গ। বিভিন্ন গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা ভাষাপরিচয়কে গুঁড়িয়ে দিতে এরা বদ্ধপরিকর। এই নতুন শিক্ষাব্যবস্থা বাংলা এবং বাঙালির পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। কেন না, রাজ্যের নিজস্ব বহুবৈচিত্রময় সংস্কৃতি, ইতিহাস, সম্প্রীতি-সংহতির জনপরিসর বিনষ্টির দিকে চলে যাবে। যুক্তি-সহমর্মিতা-সহযোগের পরিবর্তে বিদ্বেষ- বিভাজন-ঘৃণা হবে সর্বময় কর্তা। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল বিচার-বিতর্কের মধ্য দিয়ে স্বদেশ-বিশ্বজগৎ-ব্যক্তির প্রকৃত নির্যাস উদ্ঘাটন। জিজ্ঞাসু মন তার বুনিয়াদ, আধুনিক বিজ্ঞান-দর্শন-ইতিহাস চিন্তায় তার বিকাশ।
কিন্তু, কিন্তু কী দেখছি আমরা? কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন স্কুলবোর্ডে সিলেবাস (Syllabus) বা পাঠক্রম (Syllabus) থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে অসহযোগ আন্দোলন, ঠান্ডাযুদ্ধ থেকে ইসলামি শাসনের এশিয়া বা আফ্রিকায় উত্থানের পরিপ্রেক্ষিত, এমনকী মোঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস। একটু লক্ষ করলেই বোঝা যাবে, বিশেষ ধর্ম-দর্শনভুক্ত সম্প্রদায়কে পূর্ণত নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াই এদের উদ্দেশ্য। সেই প্রক্রিয়াতেই বাদ পড়ে যায় ফৈয়জ আহমেদ ফৈয়জ-এর কবিতা। এই সেই কবি যাঁর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়নের তালিকাভুক্ত হয়েছিল। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনীতি’ অধ্যায়ে ফৈয়জ আহমেদ ফৈয়জের দুটি কাব্য পঙ্ক্তিকে মুছে দেওয়া হয়েছে। এটিও লক্ষণীয়। কে জানে, ওই অধ্যায়টিও আগামী দিনে বাদ পড়বে কি না! আজ শঙ্কিত মনে ভাবি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বা ‘সাম্প্রদায়িকতার বিপদ’—এমন সব শব্দ ব্যবহারই নিষিদ্ধ হবে কি না!
এই তালিকার শেষে আরও দুটি সংযোজন করতে চাইব। বাদ পড়েছে ‘গণতন্ত্র ও বিভিন্নতা’ অংশটিও। যেকোনও স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিই ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘বিভিন্নতা’ বা ‘বৈচিত্র’কে ভয় পায়। তারা চায় চিন্তাশক্তিবর্জিত একদল নৃশংস অনুগত ঘাতক। যারা প্রশ্ন করে না। বিরোধিতা করে না। প্রতিবাদ করে না। শুধু স্তুতি করে আর মান্য করে। শিক্ষা মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়। মানুষের চিন্তা করার শক্তিকেই ভয় পায় বিজেপি নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকার। সেজন্যই তারা হামলা চালাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। গণতন্ত্র নয়, তার ‘একনায়কতন্ত্র’ শেখাতে চায়, ঘৃণার ধর্মকেই অভ্যাস করাতে চায়। নতুন প্রকল্প হিসেবে আসেছ ‘বেদ’ এবং ‘বৈদিক গণিত’। প্রাচীন ভারতের এই মহাগ্রন্থ নিয়ে চর্চা হতেই পারে। কিন্তু, এই ধর্মোন্মাদদের হাতে কি তা বিভাজনের রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে না? ‘বেদ’ যেমন পাঠ্য হবে, তেমনই কি একই গুরুত্বে পাঠ্য হবে বৌদ্ধ, শিখ, ইসলাম, খ্রিস্টান থেকে জরাথ্রুস্ট বা অন্যান্য ধর্মের আদিগ্রন্থগুলি? বৈদিক গণিত যে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চায় অনেকাংশে অপ্রাসঙ্গিক— সেকথা জোরগলায় বলার পরিসর থাকবে কি? ভয় এখানেই। নতুন শিক্ষানীতি কি গোপনে ‘এক ধর্ম এক ভাষা এক স্বৈরতন্ত্র’ বা ‘হিন্দু হিন্দি হিন্দুস্তান’ নির্মাণেরই কৌশল নয়? স্কুল সিলেবাসে কী কী বাদ পড়ছে আর কী কী বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা চলছে, সেই নকশার দিকে তাকালে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে না। ঘটনাটি জঘন্য।
বাংলা-বাঙালি বিদ্বেষও কিন্তু মোদি জমানার শিক্ষানীতিতে গোপন থাকেনি। রবীন্দ্রনাথের ওপরও এসেছে আক্রমণ। প্রকৃতপক্ষে, বাংলার বহু বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যসাধনার ঐতিহ্য এঁরা সহ্য করতে পারেন না। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যেভাবে সারা ভারতের সামনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ঐক্যবদ্ধ উন্নয়নের দিশারি হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ, তাকে বিধ্বস্ত করতে চাইছে মোদি সরকার। বাংলার বিদ্যালয় শিক্ষায় পাঠক্রম পাঠ্যসূচি (Syllabus) এবং পাঠ্যপুস্তকে সমমর্যাদায় আত্মস্থ করা হয়েছে নানা জাতি, বর্ণ, ধর্ম, সম্প্রদায়কে। সেই নির্যাসকে বিনষ্ট করার উদ্যোগ নয়া শিক্ষানীতির মাধ্যমে ঘটাতে তৎপর ধর্মোন্মাদের দল। সংবিধানের পাতা তাদের হাতে ভূলুণ্ঠিত।
যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে ফিরে যাই। রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় স্পষ্ট উচ্চারণে জানিয়েছিল—
রাজা, ভুল করছ এই যে, ভাবছ জগৎটাকে কেড়ে নিলেই জগৎ তোমার হল। ছেড়ে রাখলেই যাকে পাও, মুঠোর মধ্যে চাপাতে গেলেই দেখবে সে ফসকে গেছে।
‘‘ভাবছ হবে তুমি যা চাও/
জগৎটাকে তুমিই নাচাও/
দেখবে হঠাৎ নয়ন মেলে/
হয় না যেটা সেটাও হবে।”
ধনঞ্জয়ের এই অবস্থান আমাদেরও কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠুক।