ভারতের সর্বত্র, বিশেষত বিজেপি শাসিত রাজ্যেগুলিতে সাম্প্রদায়িকতার যে চোরাস্রোত বইছে, তার বিরুদ্ধে জনগণকে সতর্ক করে চলেছে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, বহরমপুর থেকে আসানসোল, ত্রিপুরা থেকে অসম, দিল্লি থেকে উত্তরপ্রদেশ, এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত চষে বেড়াচ্ছেন, ভাগাভাগির রাজনীতির বিরুদ্ধে, বিদ্বেষের অঙ্কে মেরুকরণের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে। প্রশাসনকে সরাসরি মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দেওয়াটা এক্ষেত্রে খুবই সহায়ক হয়েছে। একই ভাবে নবান্নে নিজেকে আটকে না রেখে মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে নিজে জেলা প্রশাসনের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন, বিভিন্ন জেলা পরিদর্শন করে বিডিও, এসডিও, ডিএম, জেলা সভাধিপতিদের মুখোমুখি বসে সমস্যার কথা শুনছেন এবং সমাধানের পথ বলে দিচ্ছেন, সেটাও ঘৃণা বিদ্বেষ ভ্রাতৃঘাতী ছিন্নমস্তা রাজনীতির বিপরীতে উন্নয়নমুখিনতার প্রবাহ পরিবেশ রচনায় বিশেষ সহায়ক।
আরও পড়ুন-কংগ্রেসের জন্যই মোদির শক্তি বৃদ্ধি, তোপ দাগলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
একই সঙ্গে আরও একটা কথা মানতে হবে। সংখ্যালঘু বঙ্গবাসীর উন্নতির বিষয়ে জননেত্রী অনেক, অনেক বেশি সিরিয়াস। নেহাত কথার কথা না আওড়ে তিনি সমাজের সার্বিক বিকাশের প্রতি মনোনিবেশ করেছেন। আর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানুষজনও বুঝে গিয়েছেন, সার্বিকভাবে সমাজ উন্নয়ন মানেই তাঁদেরও উন্নয়ন। তাঁরা সমাজবিচ্ছিন্ন কেউ নন। সুতরাং আলো ছড়ালে তাঁরাও অন্ধকারে থাকবেন না। মা-মাটি-মানুষের সরকার তাই নিছক সংরক্ষণের তাস খেলে নয়, উন্নয়নের জোয়ার এনে সংখ্যালঘুদেরও সেই স্রোতে সামিল করেছে।
পাশাপাশি, বিভিন্ন জায়গায় মসজিদ, কবরস্থান, ইদ্গাহ সংস্কারের জন্য ওয়াকফ বোর্ডকে সক্রিয় করে তোলা হয়েছে। রাজ্যে ওয়াচ টাওয়ার ও হস্টেল নির্মাণ করা হয়েছে। রাজ্যে এই প্রথম এত বেশি সংখ্যায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নেতারা রাজ্যের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধিকার অর্জন করেছেন। পঞ্চায়েতে সংখ্যালঘুদের এত বড় সুযোগ অন্য কোনও দল বা সরকার দেয়নি। এর পাশাপাশি দুয়ারে সরকার, স্বাস্থ্য সাথী, কন্যাশ্রী, সবুজ সাথী থেকে একাধিক প্রকল্প থেকে সুবিধা অন্য সবার মতো সংখ্যালঘু মানুষও পেয়েছেন।
ফলে সামগ্রিক বিচারে এই উন্নয়নকে সার্থক বলা যায় অনায়াসেই। বামসরকারের রাজত্বে সংখ্যালঘুদের শিক্ষা, চাকরি, বাসস্থান — সবদিক থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। মমতা-সরকার এই বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে প্রকৃত উন্নয়ন কাকে বলে। চাকরির জন্য সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে মুসলমান সমাজ জিজ্ঞাসিত হয়েছিল তাঁরা মুসলমানদের জন্য কারাগারেও সংরক্ষণ চাইছেন কি না। বল হয়েছিল, মাদ্রাসা-মক্তব হল সন্ত্রাসবাদের আখড়া। মনে রাখতে হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতা সংখ্যালঘিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে বহুগুণে ধ্বংসাত্মক আর শক্তিশালী। ওই ধরনের অযৌক্তিক কথা বলে বাম আমলে কার্যত সংখ্যাগরিষ্ঠ মৌলবাদকেই প্রশ্রয় দেওয়ার আয়োজন হয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতাবাদী রাজনীতি মুসলমানদের অস্তিত্বকেই ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, জহরলাল নেহরু একথা স্পষ্ট করে লিখেছিলেন। এর সত্যতা বারবারই প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে তা আরও প্রকটিত।
আসলে, সাধারণ মানুষের চাহিদাও সাধারণ। তারা চায় প্রত্যেক এলাকায় আধুনিক মানের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠুক। এই চাহিদা পূরণের ব্যাপারে জননেত্রী ভীষণ সিরিয়াস। এজন্যই ২০২১ নির্বাচনের দিকে নজর দিলে দেখা যাচ্ছে রাজ্যের ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটের বেশিরভাগটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আছে। সারা দেশেও এই দৃশ্যের পুনরাভিনয় প্রয়োজন। দেশ ও দশের স্বার্থেই তা প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে কয়েকটা দৃষ্টান্ত।
মুর্শিদাবাদ জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার দাবী দীর্ঘদিন ধরে করে আসছেন জেলার মানুষ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খানিকটা হলেও সে দিকে অগ্রসর হতে পেরেছেন। মুর্শিদাবাদ জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন চালু হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারের দৌলতে।
৩৪ বছরের বাম জমানায় সংখ্যালঘুদের সামাজিক সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের কোন চেষ্টাই করা হয়নি। তাই রাজ্যের ২৩টা জেলায় বামফ্রন্টের পার্টি সম্পাদক আছেন, কিন্তু কোনও মুসলিমকে আজও সম্পাদক পদে বসাতে পারেননি বাম নেতারা। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে কয়েকজনকে জেলা পরিষদের সভাধিপতির আসনেও বসিয়েছেন।
আশার কথা, মানবীয় চিন্তাচর্চায় যথার্থ আগ্রহী সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মেধাজীবী, সাহিত্যিক, শিল্পী, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, সমাজ-রাষ্ট্রচিন্তক, সর্বোপরি আম-জনতার মধ্যে থেকে সচেতন অংশটি কেন্দ্র সরকারের শাসনের প্রশাসনিক বদমায়েশি সম্পর্কে নিরন্তর প্রতিবাদী হয়ে উঠছেন। কৃষক বিদ্রোহ দমনের জন্য চলছে নানান পীড়ন। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘিষ্ঠ উভয় সমাজ থেকে উঠে আসা প্রাবন্ধিকরা কিন্তু কৃষিজীবী প্রান্তিক মানুষদের ভাবনাচিন্তাকে তুলে ধরছেন। সেই সূত্রে সংখ্যালঘুদের দাবি-দাওয়াগুলোও আর ভারতের আকশে আর গুমরে মরছে না। বাতাসে ভাসছে।
তার ফলেই সীমাহীন রাজকীয় ক্ষমতানির্ভর সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে ঘাড়ে-গর্দানে এক হয়ে যাওয়া বিজেপির রাজাবাবুরা এতদিনে যে সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষদের সামাজিক উপস্থিতিকেই স্বীকার করত না, আজ তারাই বেমক্কা নির্লজ্জভাবে ছুটে যাচ্ছেন সংখ্যালঘু ও দলিতদের কাছে। কলাপাতায় খেলেই বাংলা জয় করা যায় না, সে শিক্ষা যে বাংলার মানুষ ভালভাবেই বুঝিয়ে ছেড়েছেন।
আসলে, সংখ্যালঘুরা চান সমদৃষ্টিসম্পন্ন সামাজিক বিকাশ। গত বিধানসভা নির্বাচনের রায়ে সে কথাটাই মান্যতা পেয়েছে। আগামী লোকসভা নির্বাচনেও এই বিষয়টা যে বিশেষ গুরুত্ব পাবে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন-নিবেদিতার কালীচর্চা
জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়ে দিয়েছেন বৈষম্য না করেও উন্নয়ন করা যায়। উন্নত, ঐক্যবদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রগতিশীল বাংলা ও দেশ গড়ার লক্ষ্যে তিনিই তাই কাণ্ডারি হয়ে ওঠার জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি। জলসাঘরের ছবি বিশ্বাস হয়ে যে বা যারা তাঁর এই গুরুত্বকে মানতে পারছে না বা চাইছে না, তাদেরও এবার বুঝতে হবে, উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকলে ঝড় প্রতিহত করা যাবে না।
গণতন্ত্র ও সংবিধান বাঁচাতে দেশের সাধারণ নাগরিকদের পাশাপাশি বিরোধী নেতাদেরও আরও সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।