ট্রাইসোমি অসুখ

কোষের মধ্যে ক্রোমোজোমের সংখ্যাগত ও গঠনগত সমস্যা মানেই বিপদ। কারণ তা শিশুর জন্মগত ত্রুটি, শারীরিক এবং বুদ্ধি, বিকাশগত সমস্যা, জটিল রোগ এমনকী মৃত্যুর কারণও হতে পারে। যেমন ট্রাইসোমি ২১, ১৮ ও ১৩। এই তিনটি জিনগত অসুখ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে মার্চে পালিত হয় জাতীয় ট্রাইসোমি সচেতনতা মাস। লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

মার্চ হল জাতীয় ট্রাইসোমি (Trisomy Disorders) সচেতনতা মাস। কিন্তু কী এই ট্রাইসোমি? কেনই বা এই অসুখের জন্য সচেতনতার প্রসার এবং প্রচার জরুরি। ট্রাইসোমি হল একটি জেনেটিক অবস্থা। কোষ বিভাজনের ত্রুটির হলে ট্রাইসোমি (Trisomy Disorders) দেখা যায়। বেশিরভাগ মানুষের ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে অর্থাৎ মোট ৪৬টি ক্রোমোজোম হয়। এই ক্রোমোজমে থাকে ডিএনএ এবং অন্যান্য উপাদান যা মানবদেহ গঠনে সহায়ক। কিন্তু কিছু কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু মানুষের জিনে এই ক্রোমোজোম সংখ্যা থাকে ৪৭। অর্থাৎ অতিরিক্ত একটা ক্রোমোজম থাকে। অর্থাৎ তিনটি কপির ক্রোমোজম থাকে দুটো কপির পরিবর্তে। এটাই হল ট্রাইসোমি (Trisomy Disorders) অবস্থা। ওই একটা অতিরিক্ত ক্রোমোজোমাল ত্রুটির ফলে মানবদেহে তৈরি হয় জন্মগত নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। যেমন বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশগত সমস্যা থেকে শুরু করে গুরুতর শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। যার ফলে ট্রাইসোমি ত্রুটিযুক্ত শিশুর জন্মের পর পরিবারকে অনেক সমস্যার এবং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু মার্চকেই কেন বেছে নেওয়া হল ট্রাইসোমি সচেতনতা মাস হিসেবে? তার কারণ, মার্চ হল তিন নম্বর মাস এবং ট্রাইসোমি অর্থাৎ তিন ধরনের ক্রোমোজোমাল ত্রুটি অর্থাৎ ট্রাইসোমি ২১, ট্রাইসোমি ১৮ এবং ট্রাইসোমি ১৩। এই তিন ধরনের ত্রুটির কারণে হওয়া সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে পালিত হয় ট্রাইসোমি সচেতনতা মাসে। এই মাস জুড়ে বিভিন্ন সংস্থা সচেতনতার প্রচারে নানা কর্মসূচি পালন করে এবং যে পরিবার এই সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাঁদের চ্যালেঞ্জগুলোকে সর্বসমক্ষে তুলে ধরে।

ট্রাইসোমি ২১ বা ডাউন সিনড্রোম
ট্রাইসোমি ২১ যা সাধারণ ভাবে ডাউন সিনড্রোম নামে পরিচিত। এটাই কিন্তু সবচেয়ে কমন জিনগত ত্রুটি সংক্রান্ত অসুখ। জেনেটিক ডিজর্ডার থেকেই ‘ডাউন সিনড্রোম’ হয়। ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে ২১তম ক্রোমোজমে দু’টির বদলে তিনটি ক্রোমোজোম থাকে। তাই অসুখটি ‘ট্রাইজোমি-২১’ নামেও পরিচিত। প্রতিবছর এই মাসেই পালিত হয় বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবসও। যা জাতিসংঘের দ্বারা স্বীকৃত। এই দিনটি আবার শুধুমাত্র ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্তের অধিকার এবং রোগটি সম্পর্কে সচেতনতার উদ্দেশ্যে পালিত হয়। এই রোগ হলে শিশু শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিজনিত সমস্যা নিয়ে জন্ম নেয়। ডাউন সিনড্রোম হওয়ার সম্ভাবনা এক হাজার জনের মধ্যে একটি।

লক্ষণ
ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুর নাক এবং মুখের গঠন আর পাঁচজনের মতো হয় না৷
মুখের আকার অন্যদের তুলনায় ছোট হয়ে থাকে৷
মুখের মতো গলাও ছোট হয়ে থাকে।
হাত এবং পায়ের আকারও ছোট হয় এবং আঙুলও লম্বা হয় না।
হৃৎপিণ্ডজনিত সমস্যা, অন্ত্রের অস্বস্তি, দৃষ্টি এবং শ্রবণজনিত সমস্যা নিয়ে জন্মায়৷
থাইরয়েড সম্পর্কিত সমস্যা, রক্তের সমস্যা, মনে রাখার সমস্যা, অস্থিসন্ধি এবং হাড় দুর্বল হয়৷
৩৫ বছরের বেশি বয়সি মহিলা মা হলে তাঁদের গর্ভস্থ শিশুর ডাউন সিনড্রোমের ঝুঁকি বেশি থাকে। ডাউন সিনড্রোমে শারীরিকভাবে কোনও অঙ্গ প্রভাবিত না হলে এটা কোনও গুরুতর রোগ নয়। এই ধরনের শিশুদের আলাদা স্কুল রয়েছে। স্পিচ থেরাপি, বিহেভিয়ার থেরাপি, কাউন্সেলিং, ভাল খাদ্যাভাস, নিয়মিত চেকআপ-এ এই ধরনের শিশুরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।

ট্রাইসোমি ১৮ বা এডওয়ার্ড সিনড্রোম
ট্রাইসোমি ১৮-কে সাধারণভাবে বলা হয় এডওয়ার্ড সিনড্রোম। এটাও একটা জেনেটিক রোগ। এটি সেই ক্রোমোজোমাল অস্বাভাবিকতা যেখানে ১৮ নম্বর ক্রোমোজমের অতিরিক্ত একটা কপি থাকে। ট্রাইসোমি ১৮ অসুখটি কিন্তু বেশ বিরল। এর ফলে শিশুর বিকাশগত দিক বাধাপ্রাপ্ত হয়। গর্ভস্থ অবস্থাতেই বাড়বৃদ্ধি কম হয়। ছোট আকারে জন্ম হয়। জেনেটিক টেস্টের মাধ্যমে এই রোগ শিশুর জন্মের আগেই নির্ধারণ করা সম্ভব। তাই ব্যবস্থা নেওয়ার অবকাশ থাকে। এডওয়ার্ডস সিনড্রোম নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশু ন্যূনতম ২ বছর—চোদ্দো বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। তবে সেই সংখ্যা খুব বেশি নয়। এই ধরনের শিশুরা হৃৎপিণ্ড, কিডনি, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং ক্র্যানিওফেসিয়ালের বিকাশের বিলম্ব এবং অস্বাভাবিকতার মতো স্বতন্ত্র ক্লিনিক্যাল বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।

লক্ষণ
এডওয়ার্ড সিনড্রোম-এ আক্রান্ত শিশুর ছোট বা অস্বাভাবিক আকৃতির মাথা হয়। ছোট চোয়াল হয়।
অস্বাভাবিক কম ওজন নিয়ে জন্ম হয়।
হার্টে ত্রুটি থাকে, বাড়বৃদ্ধি দেরিতে হয়।
অনুন্নত এবং মুষ্টিবদ্ধ আঙুল থাকে, সোজা করা কঠিন হয়।
যেহেতু গভার্বস্থায় এটি ধরা পড়ে তাই প্রসবের আগেই গর্ভাবস্থা সমাপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসক। কারণ এই রোগটির নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা নেই।

আরও পড়ুন-বিচারপতির বাসভবনে কোটি টাকা রাজ্যসভায় আলোচনার দাবি তৃণমূলের

ট্রাইসোমি ১৩ বা পাটাউ সিনড্রোম
ট্রাইসোমি ১৩ অসুখটিকে সাধারণভাবে পাটাউ সিনড্রোম বলা হয়। এই জিনগত ত্রুটির অসুখে ক্রোমোজম ১৩-এর তিনটি কপি থাকে। যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এটাও জন্মগত ত্রুটি হিসেবেই শনাক্ত করা হয়। জন্মের আগে আলট্রাসাউন্ড-সহ বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে ট্রাইসোমি ১৩ নির্ণয় করা যায়।

লক্ষণ
পাটাউ সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুর মস্তিষ্কের সমস্যা, যেমন ছোট মাথা বা মস্তিষ্কের অস্বাভাবিকতা।
চোখের সমস্যা থাকে। ছোট চোখ হয়।
মুখ ও তালুর ফাটল থাকে।
অতিরিক্ত অঙ্গ থাকে।
হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারে শিশু।
শারীরিক বৃদ্ধি ও বিকাশে সমস্যা হয়।
পাটাউ সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুটির ঠোঁট ফাটা, নাক ছোট হয়ে যায়, নাক ফাটা বা কাটা হয়।
ট্রাইসোমি ১৩ আক্রান্ত শিশুরা নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে জন্মের পর খুব বেশিদিন বাঁচে না এবং যারা বাঁচে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সমস্যা দেখা যায়। পরিবার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। এরও কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, তবে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন চিকিৎসা ও পুনর্বাসন পদ্ধতির প্রয়োজন হতে পারে।

Latest article