জনপ্রতিনিধিরা আইনসভায় কীভাবে কথা বলবেন তাই নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই। সম্প্রতি লোকসভার সচিবালয় থেকে অসংসদীয় শব্দের (Unparliamentary Words) তালিকায় নতুন কিছু শব্দ সংযোজিত হয়েছে। তাই নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। হওয়া উচিত। গণতান্ত্রিক দেশে বিতর্ক, আলোচনা, টিপ্পনী না থাকলে তা আর গণতান্ত্রিক থাকে না। সমাজের স্বাভাবিক ভদ্রতায় কিছু অশালীন শব্দ আমরা প্রকাশ্যে বলি না। যাঁরা বলেন তাঁদের নিন্দা করি। কিন্তু অশ্লীলতা আর টিপ্পনীর মধ্যে যে তফাত আছে তাকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
তবে এক্ষেত্রে যে বিষয়টি উল্লেখ্য তা হল— লোকসভা বা রাজ্যসভার কার্যবিবরণী থেকে কোন শব্দ বাদ পড়বে তা নির্ধারণ করার অধিকার যথাক্রমে স্পিকার ও চেয়ারম্যানের। যদি কোনও সদস্য তাঁর বক্তৃতার মুনশিয়ানায় কোনও শব্দ এমনভাবে ব্যবহার করেন যে তা মোটেও শব্দটিকে প্রধান করে তোলে না বরঞ্চ বক্তব্যের ভার বৃদ্ধি করে তবে পুরো বক্তব্যটি কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। মুশকিল হয় বক্তব্য পেশ না করে অনর্থক চেঁচামেচি করাতে। যাঁরা যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য পেশ করতে পারেন না তাঁরাই অন্যের বক্তব্যের সময়ে চেঁচামেচি করে গোলমাল সৃষ্টি করেন। তখন নানা শব্দ শোনা যায় যা আদৌ সংসদীয় রীতিনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কোনও সাংসদ যদি তাঁর বক্তব্যে বিরোধী সাংসদের বক্তব্যকে ‘নাটক’ প্রমাণ করতে পারেন সেক্ষেত্রে নাটক শব্দটি মোটেই অসংসদীয় (Unparliamentary Words) হতে পারে না। কিংবা ‘দেশদ্রোহী’ শব্দের চেয়ে ‘নৈরাজ্যবাদী’ বা ‘অ্যানার্কিস্ট’ তো ভাল শব্দ। অথচ দেখুন দেশদ্রোহী শব্দটি বাদ পড়ল না কিন্তু অ্যানার্কিস্ট বাদ পড়ল! কেন? সরকারের সমালোচনা মানে তো দেশের সমালোচনা নয়। সরকারের কেন্দ্রীকরণের ঝোঁককে বিরোধিতা করলে তা দেশদ্রোহী হবে কেন? অথচ নৈরাজ্যবাদ একটি রাজনৈতিক দর্শন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শ্রেণিকক্ষে বিস্তারিতভাবে পড়ানো হয়। স্বয়ং জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে বলা হয় ‘আলোকপ্রাপ্ত নৈরাজ্যবাদী’ কারণ তিনি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই হিংসা খুঁজে পেয়েছিলেন। সংসদীয় ব্যবস্থার তিনি ছিলেন ঘোরতর বিরোধী। তো তাঁর এই দর্শন শ্রেণিকক্ষে আলোচিত হবে অথচ সাংসদেরা উচ্চারণ করতে পারবেন না? আমাদের সাংসদেরা কি রাজনৈতিক দর্শনকে বাদ দিয়েই বিভিন্ন জাতীয় তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করবেন? তাই আবার হয় নাকি?
‘জুমলা’ শব্দটি তো আমরা আগে জানতামই না। অন্তত আমি জানতাম না। স্বয়ং বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে একটি টিভি সাক্ষাৎকারে ওই শব্দ ব্যবহার করতে শুনেছি ২০১৪-র নির্বাচনের পর। ধরে নিতে অসুবিধা নেই যে এ শব্দ (Unparliamentary Words) ব্যবহারে তাঁর আপত্তি নেই। তাহলে বিরোধীরা ব্যবহার করতে পারবেন না কেন? অবশ্যই, আবারও বলছি, চেঁচামেচির মাধ্যমে নয় বা শুধু ওই শব্দটি বারবার বলে যাওয়ার মধ্যে দিয়েও নয়, সুনির্দিষ্ট যুক্তির সাহায্যে কেউ যদি কোনও বক্তব্য পেশ করেন এবং সেই বক্তব্য অনুযায়ী জুমলা প্রাসঙ্গিক হলে ব্যবহার করা যেতেই পারে। আপত্তি কোথায়?
আসলে সমস্যা অন্যত্র। সংসদের উভয় কক্ষেই এখন শাসক এবং বিরোধী পক্ষের সাংসদদের বিতর্কের মান যথেষ্ট উন্নত নয়। এমনও দেখা যাচ্ছে যে যিনি ভাল বলেন তিনি বক্তৃতা থামিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এটি দুর্ভাগ্যজনক। বক্তব্যের বিষয়বস্তু অবশ্যই দলীয় আধারে নির্ধারিত হয়। কিন্তু তাকে উপস্থাপন করার যে মুনশিয়ানা তা বক্তার নিজস্ব। কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মুনশিয়ানার অভাব রয়েছে। এইটা নিয়ে সংসদ শুরুর আগে সর্বদলীয় বৈঠক করা যেতে পারত। সেখানে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে আসা অসম্ভব ছিল না যে একজন বক্তা তাঁর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরুপদ্রবে বক্তব্য উপস্থাপন করবেন। শব্দ নির্বাচন নিয়ে জলঘোলা করে সংসদীয় গণতন্ত্রের মৌলিক অবস্থানটিকেই আমরা নড়বড়ে করে দিচ্ছি না কি? যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে এটা ভাবা দরকার। এমন কথা বলছি না যে অতীতে সব ভাল ছিল আর এখনই খারাপ হয়ে গেছে। বস্তুত টিভি চ্যানেলের টক শো-র মতো যদি সংসদীয় বিতর্ক হয় তবে তার সমাধান কীভাবে হবে তা সমস্ত দলকে বসেই স্থির করতে হবে।
আরও পড়ুন: দ্বিজেন্দ্রলাল রায়-এর সাহিত্যচর্চা প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে
এ তো গেল রাগারাগির কথা। এবার একটু ভয়ের কথা বলি। আমরা অতি ব্যস্ত হয়ে পড়েছি রেগে-গিয়ে-বলা শব্দগুলো নিয়ে। যদিও যাঁরা ভাষাচর্চা করেন তাঁদের মতানুযায়ী যেকোনও শব্দার্থের যেমন সংকোচন হয় তেমন সম্প্রসারণও ঘটে। অর্থাৎ আজ একটি শব্দকে মনে হতেই পারে খারাপ। সমাজে ওই শব্দের ব্যবহারের পদ্ধতি অনুযায়ী তার সম্প্রসারণ ঘটে। আপনি যদি আজকে সেই শব্দটির ব্যবহার বাতিল করে দেন তবে সামাজিক বিচারে পিছিয়ে পড়তে হতে পারে। সংসদ সমাজের প্রতিফলন। সেখানে সংকোচন নয়, সম্প্রসারণই কাম্য। একটি ভাষা সমৃদ্ধ হয় তার শব্দভাণ্ডারের প্রাচুর্যের নিরিখে। ভাষা মৃত হয় গোঁড়ামির জন্য। প্রচলিত শালীন শব্দভাণ্ডারের উপযোগিতা না বাড়িয়ে যদি রক্ষণশীল হয়ে যাই, তবে মুশকিল!
এখানেই আবার ভয়ের প্রসঙ্গ এসে যায়। দুটি অত্যন্ত নিরীহ শব্দ যা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত তাকে কীভাবে ভয়ঙ্কর করে তোলা যায় তা আমরা নিকট-অতীতেই দেখেছি। একটি ‘ক্রনোলজি’, অন্যটি ‘নাগরিকত্ব’। এই দুটি শব্দ নিয়ে কি সমস্যা হওয়ার কথা? কিন্তু বলা হল, ‘আপ তো ক্রনোলজি সমঝ লিয়ে!’ কী ভয়ানক! কে নাগরিক থাকবেন, কে থাকবেন না তাই নিয়ে দেশ জুড়ে অনিশ্চয়তা আর আশঙ্কা। এই যে আমি, পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দু ঘটি, একদিন ভয়ের চোটে বাড়ির পুরনো আলমারি থেকে বাবার ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেটটা নামিয়ে যত্ন করে রেখে দিলাম! ভয় পেয়েছিলাম বলেই তো করলাম! নাগরিকত্বের মতো একটি অনির্বচনীয় আনন্দজনক অনুভূতিও কেমন করে জনসমাজে ভয় ধরিয়ে দিতে পারে তা বর্তমান প্রজন্ম দেখল। দেশ জুড়ে যে আন্দোলন হল সে তো সরাসরি এসব শব্দ ও অপ্রয়োজনীয় বাক্য প্রয়োগকে ঘিরেই। নয়তো দেশের সরকার যদি কিছু নতুন মানুষকে নাগরিকত্ব দেন, তাতে আপত্তির কিছু নেই। শুধু ধর্ম বিচার করে দিলে সংবিধান লঙ্ঘন করা হয় যে! ভয় ধরানো ক্রনোলজি শব্দটি (Unparliamentary Words) বাতিল তালিকায় নেই দেখলাম।
যাই হোক, শেষে একটু অতীতচারী হওয়া যাক। একবার সংসদীয় বিতর্ক চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহরু বলেছিলেন, ‘Jana Sangh is a communal party. I will crush the Jana Sangh.’
জনসঙ্ঘের নেতা, বিরোধী সাংসদ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সপাটে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘I will crush this crushing mentality.’
সংসদ শিশুদের বিদ্যালয় নয় যে ভাল-মন্দ শব্দের বিচার করতে হবে। সেখানে বিচার হোক বিতর্কের বিষয়বস্তুর। দমন করে নয়, প্রশ্রয় দিয়ে। সবাইকে সমান সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে। চিন্তার কিছু নেই, কারণ শেষ কথা বলবেন দেশের জনসাধারণ।