উইলিয়াম শেক্সপিয়র তাঁর All’s Well That Ends Well (সব ভাল যার শেষ ভাল) নাটকে লিখেছিলেন, Good alone is good without a name. vileness is so. অর্থাৎ কোনও নাম ছাড়াই ভাল নিজেই ভাল, খারাপও ঠিক তাই।
সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ভারতীয় অর্থনীতির পরিসংখ্যানের হ্যান্ডবুক ২০২০-’২১ সালে করোনার ধাক্কায় যেখানে ভারতের আর্থিক সমৃদ্ধি প্রায় ২৪ শতাংশ কমেছিল, ২০১১-’১২-র স্থির দামের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু নিট এনএসডিপি বা রাজ্যের মাথাপিছু প্রকৃত নিট আয় সেখানে বৃদ্ধি পেয়েছে।
আরও পড়ুন-ত্রিপুরা: তিন শতাধিক কর্মী-সমর্থকের যোগদান তৃণমূল কংগ্রেসে, শুরু পুরভোটের প্রার্থী তালিকা তৈরির কাজ
২০১৯-’২০-তে অর্থাৎ কোভিড অতিমারির আগের পর্বে মাথাপিছু প্রকৃত নিট আয় ছিল ৭১,৭১৯ টাকা। ২০২০-’২১-এ তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭২,২০২ টাকা। রাজ্যে একবছরের মধ্যে মাথাপিছু নিট আয় বেড়েছে ৪৮৩ টাকা।
ভারতের যে রাজ্যগুলি বিশেষ সাহায্য পায় সেগুলিকে হিসাবের মধ্যে না-ধরলে দেখা যাচ্ছে দেশের মধ্যে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির অঙ্কে পশ্চিমবঙ্গ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত। এই সময়পর্বে মাত্র তিনটি রাজ্যে মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এই রাজ্যগুলি হল তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার। বলা বাহুল্য, বিহারে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় কম।
ভারতে গড় মাথাপিছু নিট প্রকৃত আয় পক্ষান্তরে হ্রাস পেয়েছে। এই হ্রাসের হার ৮.৩৬ শতাংশ। এক বছরে মাথাপিছু নিট প্রকৃত আয় কমে দাঁড়িয়েছে ৭,৯০৭ টাকায়।
অথচ পশ্চিমবঙ্গে নিট মাথাপিছু প্রকৃত আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৮৩ টাকা। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই বৃদ্ধি পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্য সরকারের মুকুটে আর একটি পালক।
যাঁরা বলেন মা-মাটি-মানুষের সরকার রাজ্যের হাল ধরার পর রাজ্যবাসীর প্রকৃত মাথাপিছু আয়ে ভাটার টান, তাঁরা প্রকৃত তথ্য জানেন না, কিংবা জেনেও মিথ্যা বলেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান বলছে, গত ৯ বছরে, অর্থাৎ ২০১১-’১২ থেকে ২০২০-’২১— এই কালপর্বে রাজ্যের প্রকৃত নিট মাথাপিছু আয় ৪০.০৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১১-’১২-তে এই আয়ের পরিমাণ ছিল ১১,৫৪৩ টাকা। ২০২০-’২১-এ তা দাঁড়িয়েছে ৭২,২০২ টাকায়। এই সময়কালে কোনও বছরেই রাজ্যের প্রকৃত নিট মাথাপিছু আয় কমেনি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাম জামানায়, ২০০৪-’০৫ অর্থবর্ষের স্থির দামের ভিত্তিতে, ২০০৪-’০৫ থেকে ২০১০-’১১— এই ৬ বছরে পশ্চিমবঙ্গে নিট মাথাপিছু আয় বেড়ে ছিল মাত্র ৮,৬৬৫ টাকা। ২০০৪-’০৫ ছিল ২২,৬৪৯ টাকা। ২০১০-’১১-তে তা বেড়ে হয়েছিল ৩১,৩১৪ টাকা। উল্টোদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে নিট মাথাপিছু আয় বেড়েছে ২০,৬৫৯ টাকা।
জননেত্রীর প্রশাসনিক দক্ষতা ও কর্মকৌশলের সৌজন্যে গড়ে প্রতিবছর মাথাপিছু আয়ের নিট পরিমাণ বেড়েছে ২,২৯৫ টাকা। আর বাম আমলে, এই বার্ষিক গড় বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ১,৪৪৪ টাকা। সুতরাং, দেখাই যাচ্ছে, বামফ্রন্ট জমানার চেয়ে বর্তমান সরকারের আমলে রাজ্যে প্রকৃত মাথাপিছু নিট আয় গড়ে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
কেন কোভিড অতিমারিপর্বে রাজ্যের নিট মাথাপিছু আয় বাড়ল অথচ সারা দেশে তা কমল?
২০২০-’২১ অর্থবর্ষে লকডাউন চলেছে বহুদিন ধরে। অর্থনীতির স্বাভাবিক চাকা তখন বন্ধ ছিল। সারা দেশের ক্ষেত্রে এটা যেমন সত্যি, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও তাই।
কিন্তু রাজ্যে ছিল সরকারি জনমুখী বিভিন্ন প্রকল্প। তাতে ব্যয়িত হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্নেহের পরশ, আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য জয় জোহার, তফসিলি জাতির জন্য বন্ধু প্রকল্প, লোকপ্রসার প্রকল্প, ছাত্রছাত্রীদের জন্য ট্যাব কেনার অর্থ প্রদান, বিধবাভাতা, বার্ধক্যভাতা, একশো দিনের কাজ— এ সব নানা খাতে রাজ্য সরকার আম-জনতার হাতে অর্থ পৌঁছে দিয়েছেন। তাতে বৃদ্ধি পেয়েছে চাহিদা। অন্য রাজ্যগুলিতে এরকম কোনও জনমুখী প্রকল্প চালু হয়নি। তাহলে বৈপরীত্যের অনিবার্য প্রভাবে অন্যত্র যখন অর্থনীতির চাকা বন্ধ, তখন পশ্চিমবঙ্গে তা কিছুটা হলেও সচল ছিল। আর তারই প্রতিফলন নিট মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির অঙ্কে।
অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় অর্থনীতির ছবিটা দেখুন। নোটবন্দির ধাক্কায় সমৃদ্ধি, বেকারত্ব, ব্যাঙ্ক-সুদ— সবক্ষেত্রে করোনা অতিমারির আগের বছর পর্যন্ত ভারতীয় অর্থনীতি তলানিতে পৌঁছেছিল। কোভিডপর্বের আগের বছরই ২০১৯-’২০-তে দেশের আর্থিক সমৃদ্ধি কমতে কমতে ৪.২ শতাংশে ঠেকেছিল। এটা ছিল এগারো বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ২০২০-তে করোনার প্রথম ঢেউ বেকারত্ব বাড়িয়ে দেয়। দেশে কয়েক কোটি মানুষ কর্মহীনতার শিকার হন। ছবিটা বদলানোর জন্য রঘুরাম রাজন থেকে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়— প্রত্যেক অর্থনীতিবিদ একটাই কথা বলেছিলেন। তাতে গলা মিলিয়েছিল বিশ্বের স্বনামধন্য রেটিং সংস্থাগুলোও। বারবার বলা হয়েছিল, ঋণ দিলে শুধু চলবে না। হাল ফেরাতে হবে চাহিদার। যদি মূল্যবৃদ্ধি হয়, ক্ষতি নেই। যদি ব্যয়বৃদ্ধি হয় তাতেও দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির হাল ফেরাতে আর্থিক ত্রাণ প্রকল্প অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সেক্ষেত্রে পরামর্শে কর্ণপাত করেননি। চাহিদা বৃদ্ধির দিকে নজর না দিয়ে জোগান বৃদ্ধির দিকে বেশি নজর দেন। ২১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ত্রাণ প্রকল্পের প্রচারঢাক বেজেছে। কিন্তু এই অর্থের ৯০ শতাংশের বেশি ছিল ঋণ। আসল ত্রাণ প্রকল্পের পরিমাণ ছিল দেশের জিডিপির মাত্র ১.৮ শতাংশ। এরই মধ্যে গত বছরেও শিল্পপতিদের প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকার কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবু ব্যবসায়ীরা মোট লভ্য ঋণের ১০ শতাংশের বেশি গ্রহণ করতে চাননি। কারণ, বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা চাহিদা বৃদ্ধির দিকে নজর রেখে তবেই বিনিয়োগ করেন। এ-সবেরই নিট ফলস্বরূপ ভারতীয় অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির হারে প্রায় ২৪ শতাংশ পতন ঘটে। বিশ্বে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অঙ্কে ভারত সবার নিচে, সবার পিছে পৌঁছয়। সৌজন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের অনর্থনীতি বা বিষাক্ত অর্থনীতি।
আরও পড়ুন-বিশ্বভারতীতে নিয়োগ
এসব দেখলে শুনলে জানলে আইনস্টাইনের সেই কথাটা মনে পড়ে যায়। অজ্ঞতার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক হল অহংকার। মোদি সরকারের অযৌক্তিক অহংকারই দেশের অর্থনীতিতে বিপদ ডেকে এনেছে ও আনছে।