নারীজাগরণের (women’s day) যে দীর্ঘ লড়াই তা শুধু সমাজের সঙ্গে নয়। আমাদের সঙ্গে বন্ধনে আবদ্ধ সেই সকল মানুষের সঙ্গে যারা মেয়েদের মনে করে খেলার পুতুল। এদের মধ্যে স্বামী হলেন সেই মানুষটি যিনি ভালবাসায় শ্রদ্ধায় তাঁর স্ত্রীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন আলোময় জীবনের দিকে, তবেই না কাদম্বিনী গাঙ্গুলির মতো ডাক্তার পেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু খারাপ অভিজ্ঞতার পরিমাণটা এতটাই বেশি যে, কলমের কালি যুগ যুগ ধরে তা লিখে রেখেছে। সেই কোন দশম শতকের দিকে পরিত্যক্তা গর্ভিনী নারী কাতরোক্তি করে ছিল— ‘হাঁউ নিরাসী খমণ ভতারি।/মোহোর বিগোআ কহণ ন জাই।’ স্বামী আমার বিবাগী, আমি তাই নিরাশ— আমার দুঃখ অবর্ণনীয়। শিব-পার্বতীর বিয়েতে বাসরের নারীদের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে নিজ নিজ জীবনের দুঃখকথা— ‘আর যুবতী বলে পতির বর্জিত দশন।/শাক-সুপ-ঘণ্ট বিনে না করে ভোজন।/ দড় বেঞ্জন আমি যেই দিনে রান্ধি।/মারয়ে পিঁড়ির বাড়ি কোণে বসযা কান্দি।’
তহলে দেখা যাচ্ছে সেই সুদূর অতীতকাল থেকেই নারীর এই বঞ্চিত জীবন যা সাহিত্যের পাতায় পাতায় খুব সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে। যতই নারীস্বাধীনতা নিয়ে কপচাই না কেন আজও নারীজগৎ কোণঠাসা। স্রোতে সমাজ যেভাবে বদলেছে, সমাজের দর্পণ ‘সাহিত্য’ও সেভাবে বদলেছে। মধ্যকাল পেরিয়ে আধুনিক কালে এসেও স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ক্ষোভ এবং অন্যের কাছে তার প্রকাশের কোনও পরিবর্তন হয়নি।
‘বিষবৃক্ষ’-এ সূর্যমূর্তি আপন স্বামীর কারণে কষ্ট পেয়ে ননদ কমলমণিকে লিখেছিল—’…অন্তঃকরণের ভিতর যে কষ্ট, তাহা কাহাকেও না বলিলে সহ্য হয় না। তুমি আমার প্রাণের ভগিনী, তুমি ভিন্ন আর আমাকে কেহ ভালোবাসে না । আর তোমার ভাইয়ের কথা তোমা ভিন্ন পরের কাছেও বলিতে পারি না। …আপনার দুঃখের কথা লইয়া তোমাকে অনেকক্ষণ জ্বালাতন করিয়াছি। তুমি না জানি কত বিরক্ত হইবে। কিন্তু কি করি ভাই তোমাকে মনের দুঃখ না বলিয়া কাহাকে বলিব?’
স্বামীকে আঁকড়ে থাকতে চায় নারী (women’s day)। কিন্তু তার পরিবর্তে তাঁর প্রাপ্য কী? বঞ্চনা? বিশ্বাসঘাতকতা? অত্যাচার? আঠারো শতকের দরবারি নাগরিকতার আভিজাত্যেও দুই পত্নীকে নিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের সুখী সংসারের ছবি ভারতচন্দ্রের কাব্যে যেমন দেখেছি, তেমনই ‘নারীগণের পতিনিন্দা’ও উন্মুক্ত করেছে বিবাহিত দম্পতির সম্পর্কের ভিতরকার নানা শূন্যতা।
উনিশ শতকের পরবর্তী সময়ে দাম্পত্য সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়াতে নারীদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। তারা বারবার চেষ্টা করে খাঁচার জাল কেটে বেরতে। কেউ পেরেছে। আবার কেউ খাঁচার মৃত কোকিলটা হয়ে থেকে গেছে। বিবাহিত জীবনে স্বামী-স্ত্রীর জোড় না মেলার ঘটনা, রবীন্দ্রনাথের কন্যা মীরার দাম্পত্যের অ-সুখটুকু তাঁকে বেদনার্ত করেছিল। তাই ‘ভাল না বাসলেও ভাল স্ত্রী হওয়া যায়, নইলে সংসার চলবে কী করে?’ কিংবা আত্মমর্যাদার ক্রমপীড়নে বিচ্ছেদস্তর পর্যন্ত যাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলি ‘যোগাযোগ’র ভাবনার আশ্রয় হয়ে উঠেছে। জীবনের ক্ষোভ থেকে সাহস সঞ্চয় করে যে নিজের জীবনের মূল্য বুঝতে পেরেছে সেই পেরেছে সরাসরি বলতে, ‘তোমাদের অভ্যাসের অন্ধকার আমাকে ঢেকে রেখে দিয়েছিল। ক্ষণকালের জন্য বিন্দু এসে সেই আবরণের ছিদ্র দিয়ে আমাকে দেখে নিয়েছিল। সেই মেয়েটাই (women’s day) তার আপনার মৃত্যু দিয়ে আমার আবরণখানা আগাগোড়া ছিন্ন করে দিয়ে গেল। আজ বাইরে এসে দেখি, আমার গৌরব রাখবার আর জায়গা নেই। আমার এই অনাবৃত রূপ যার চোখে ভাল লেগেছে, সেই সুন্দর সমস্ত আকাশ দিয়ে আমাকে চেয়ে দেখেছেন। এইবার মরেছে মেজো বউ। …আমিও বাঁচব। আমি বাঁচলাম।’
আরও পড়ুন: প্রয়াত বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ সমরাদিত্য পাল, শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর
মানিকবাবুও কুসুমের দাম্পত্যের কোনও বিস্মৃত ও সুখী চিত্র আঁকতে পারেননি। ভারতীয় নারীর প্রচলিত নম্যতার প্যাটার্ন ভেঙে সদর্পে বলেছে সে, ‘লাল টকটকে করে তাতানো লোহা ফেলে রাখলে তাও আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে যায়, যায় না? সাধ আহ্লাদ আমার কিছু নেই, নিজের জন্যও কোনও সুখ চাই না, সব তেঁতো হয়ে গেছে।’ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘মানবজমিন’-এ নায়িকার অসুখী দাম্পত্যে শুধু কর্তব্য করে যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়েছে একটাই
প্রশ্ন, ‘আমি কি পেলাম’?
উত্তর, আধুনিককালেও এই ধারা অপরিবর্তিত। দাম্পত্য সমস্যার সমাধান মেলেনি। নবীন লেখিকা সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শঙ্খিনী’র পাতায় মেলে হাজারো দাম্পত্য সমস্যায় ঘেরা রাত্রির জীবনকথা। রাত্রি-দিনের পর দিন স্বামীর অনাগ্রহ অনাচার, অবৈধ সম্পর্ক মেনে নিতে নিতে অবসাদগ্রস্ত হতে থাকে। আত্মপীড়ন করতে থাকে। দাম্পত্য ফিকে হয়ে আসতে থাকে, নিজের প্রতি অভিমানে দুটি শিশুকে অনাথ করে বিদায় নেয় জগৎ থেকে। তবে এটাই কি পরিণতি মেয়েদের?
ভালবাসার স্বপ্ন নিয়ে বাসা বাঁধে যে নারী-পুরুষ, অকস্মাৎ কেন ওঠে সেখানে ঝড়? নিমেষের মধ্যে টলে ওঠে যুগলের সংসার। হাজার বছর ধরে এখনও কেন লেখকদের কলম ধরতে হয় নারীদের (women’s day) মনের গহনে প্রবেশ করে তাদের অন্তরজ্বালাকে সমাজের সামনে সাহিত্যের আকারে তুলে ধরতে? স্বামীর প্রতি ক্ষোভ, অভিমান, অভিযোগের নির্মম পরিবেশ আগামী দিনে বদলাবে এই আশাটুকু করা যায় মাত্র।