গত বছরের অগাস্টের কথা। সুপ্রিম কোর্ট, ভারতের শীর্ষ আদালত, নরেন্দ্র মোদির সরকারের কাছে একটা তথ্য জানতে চায়। তার জবাবে সরকারের তরফে জানান হয়, প্রায় ১২২ জন আইনসভার সদস্যের বিরুদ্ধে প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট বা অর্থপচার রোধ আইনে (Prevention of Money Laundering Act) মামলা জারি আছে। এই ১২২ জনের মধ্যে মোট তিনজন শাসক শিবিরের অর্থাৎ বিজিপির সদস্য। তার মানে নিশ্চয় এমনটা নয় যে শাসক শিবিরের প্রায় সব সদস্য একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা।
তার মানে এটাই যে, বেছে বেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনটিকে (Prevention of Money Laundering Act) কাজে লাগানো হচ্ছে।
সিবিআইয়ের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। বিরোধী শিবির থেকে গেরুয়া শিবিরে যাওয়া মাত্র কতজন নেতানেত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যত বন্ধ রেখেছে ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্ট রেট) এবং কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই? এককথায়, এরকম নেতানেত্রীর সংখ্যা অগুনতি। পশ্চিমবঙ্গ, অসম, মহারাষ্ট্র, অরুণাচল প্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাট, কর্ণাটক, গোয়া— সর্বত্র এর উদাহরণ বিরাজমান।
এতেই প্রমাণিত, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থকরণ ছাড়া ইডি আর সিবিআইকে কোনও কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
এটাও প্রমাণিত, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, গদি বাঁচানোর জন্য, ইডি সিবিআই-কে ব্যবহার করাটাই এখন দস্তুর।
এদের জাগিয়ে তোলার সময়টা লক্ষ্য করলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে।
রাজ্যে ভোট এলেই ইডি সিবিআই-কে লেলিয়ে দেওয়া হয়। জনমানসে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টার হাতিয়ার হয়ে ওঠে তারা। পশ্চিমবঙ্গে গত বিধানসভা নির্বাচনেই এটা দেখা গিয়েছিল।
রাজ্যে বিরোধী কোনও দল ক্ষমতাসীন হলে, রাজ্যব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতেও ইডি আর সিবিআইকে লেলিয়ে দেওয়া হয়। কর্ণাটকে এটা দেখা গিয়েছে।
রাজ্যে ক্ষমতাসীন সরকারকে অগণতান্ত্রিকভাবে সরিয়ে দেওয়ার পর অস্থির আবহ বজায় রাখার জন্যও এটা করা হয়। সাম্প্রতিককালে মহারাষ্ট্রে এ জিনিস দেখা গিয়েছে।
আদালতে মামলা-মোকদ্দমা করে যতটা না ক্ষতি করা যায় তার থেকে অনেক তাড়াতাড়ি, অনেক বেশি ক্ষতি করা যায় ইডি-সিবিআই ব্যবহার করলে। তথ্য প্রমাণের দায় ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত। অভিযোগ কতটা সত্য, সেকথা বলতে পারে আগামী, অনাগত কাল। আপাতত ভাবমূর্তিতে কাদা লেপন করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নেওয়ার কাজটা সুসম্পন্ন হয়ে গেল। ব্যস! অযুত প্রশ্ন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা, সেসবের ফল কী, কেউ জানে না। এফআইআর হল না, হলেও নাম কা ওয়াস্তে। চার্জশিটের বালাই নেই। কিন্তু নিগ্রহ তো করা গেল। ব্যস!
এই সহজসত্যিগুলো মোদি-শাহরা বুঝে নিয়েছেন। তাই তাঁদের দুই ভাই, ইডি ও সিবিআই। তাদের কাজে লাগিয়েই রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণ।
আরও পড়ুন: ২৫শে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ নীতীশের
২০১৪-তে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তখন থেকে এখনও পর্যন্ত মোটামুটি ৩,০১০টা অভিযান ইডি চালিয়েছে। তার আগের দশ বছরে যেখানে ইডির অভিযানের সংখ্যা ছিল মোটে ১১২টি! শেষ পর্যন্ত অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে ০.৫ শতাংশ কেসে। হাজতে গিয়েছেন কেবল ২৩ জন অভিযুক্ত।
এই তথ্য পরিসংখ্যান যা বলছে তা একটি বাক্যেই কেবল প্রকাশ করা যেতে পারে। ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’।
আচ্ছা! এই সরকার কি সত্যিই চায় দোষীদের শাস্তি হোক? না কি চায়, মামলা রুজু করার পর সেটা ঝুলে থাকুক। স্রেফ রাজনৈতিক বিরোধীদের ভয় দেখানো জারি থাকুক। দোষ প্রমাণ নয়, হুমকি আর হুঁশিয়ারি প্রদানের মাধ্যম হোক পিএমএলএ।
সরকারের কাজকর্ম দেখলে তেমন মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ, গত দু’বছর পিএমএলএ-র আপিল ট্রাইবুনালের প্রধান বিচারক নিয়োগের কোনও সদিচ্ছা এই সরকারের তরফে দেখা যায়নি।
গত ডিসেম্বরেই মোদি-শাহ-র সরকার আইন করে ইডি ও সিবিআই-এর প্রত্যেক ডিরেক্টরের কার্যকাল বাড়িয়ে পাঁচ বছর করেছে। কিন্তু বলা হয়েছে, একেবারে নয়; খেপে খেপে, একলপ্তে এক বছর করে বাড়িয়ে এই পাঁচ বছর কার্যকাল বৃদ্ধি করা হবে। ফলে, ডিরেক্টররা ভয়ে ভয়ে থাকেন। পান থেকে চুন খসলে যদি কাজের আয়ু আর না বাড়ে! এই ভয়টা যাতে আধিকারিকদের কাজকর্মকে প্রভাবিত না করে, সেজন্য আম্বেদকর সরকারি আধিকারিকদের নির্দিষ্ট কার্যকালের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই ভাবনা যে ধুলোয় পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে, তা বেশ বোঝা গিয়েছে বিনীত নারায়ণ এবং অলোক বর্মা সংক্রান্ত মামলায়। সিবিআই ডিরেক্টরের কার্যকাল না-বাড়ানোর জন্য শীর্ষ আদালতের যে নির্দেশ ছিল, সেটাও অমান্য করা হয়েছে অবলীলায়।
এই অবস্থায় বদল না এলে ভারতীয় গণতন্ত্র বৃহত্তর বিপদের সম্মুখীন হবে। যা ঘটছে তা আদৌ স্বাস্থ্যকর নয়। এই অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মোকাবিলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, আসতেই হবে।