মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। এই বচনের সপক্ষে দৃষ্টান্ত এক সে বড়কর এক। এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায়।
প্রথমেই আসি মহারাষ্ট্রের কথায়।
ফি বছর মহারাষ্ট্রের বিদ জেলা থেকে বিভিন্ন রাজ্যের আখ খেতে কাজ করতে যান প্রায় দেড় লক্ষ শ্রমিক। বিদের পরিযায়ী শ্রমিকদের এই দলে রয়েছেন প্রায় ৮০ হাজার মহিলা। তাঁদের মধ্যে ৮৪৩ জন কাজে যাওয়ার আগে হিস্টেরেক্টোমি (জরায়ু অপসারণ) করিয়েছেন। অধিকাংশের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। আবার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেই খেতে কাজ করেছেন ১ হাজার ৫২৩ মহিলা। ৩ হাজারের বেশি মহিলা শ্রমিক অ্যানিমিয়ার শিকার। সদ্যসমাপ্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্টেই প্রকাশ পেয়েছে দারিদ্র ও শোষণের এই করুণ ছবি। প্রতি বছর দীপাবলির সময় বিদ থেকে গুজরাত-সহ একাধিক রাজ্যে পাড়ি দেন শ্রমিকরা। আখ কাটতে বিভিন্ন খেতে পৌঁছে যান। ছ’মাস কাজ করে আবার মার্চ-এপ্রিল নাগাদ বাড়ি ফিরে আসেন তাঁরা। সরকারি প্রকল্পের অংশ হিসেবে কাজে যাওয়ার আগে ও ফেরার পর শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। এবারও চেক আপ হয়েছিল। তাতেই সামনে এসেছে হাড়হিম করা এই তথ্য। রিপোর্ট অনুযায়ী, ৮৪৩ মহিলা শ্রমিক জরায়ু অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচার করিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৪৭৭ জনের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। তলপেটে ব্যথা, সংক্রমণ সহ বিভিন্ন কারণে যাতে কাজে কামাই না হয়, তার জন্যই এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে কার্যত বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। অন্যদিকে, পেট চালাতে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় খেতে কাস্তে হাতে কাজ করেছেন ১ হাজার ৫২৩ জন। বিদের ম্যাটার্নাল অ্যান্ড চাইল্ড ওয়েলফেয়ার অফিসার জানাচ্ছেন, আখ খেতের পরিযায়ী শ্রমিকদের রুটিন স্বাস্থ্যপরীক্ষার রিপোর্ট থেকেই এই তথ্য জানা গিয়েছে।
এবার আসি দুর্নীতি প্রদেশের প্রসঙ্গে।
দুর্নীতি প্রদেশ মধ্যপ্রদেশ। দুর্নীতি তথায় স্ফীতকায়।
৫০ হাজার সরকারি কর্মী, প্রত্যেকেই ভুয়ো! সেও কি সম্ভব? যত সংখ্যক সরকারি কর্মী মধ্যপ্রদেশে কাজ করেন, তার ৯ শতাংশ! প্রত্যেকের এমপ্লয়ি আইডি রয়েছে। তার মধ্যে ৪০ হাজার পার্মানেন্ট, আর ১০ হাজার কন্ট্রাকচুয়াল। প্রত্যেকের বেতনই ট্রেজারি থেকে তোলা হয়েছে। সব মিলিয়ে ২৩০ কোটি টাকা। তাঁরা সবাই ভুয়ো। গোলমাল কিছু একটা আছে… সেটা বোঝা মাত্রই মধ্যপ্রদেশের অর্থ দফতর এই ৫০ হাজার কর্মীর বেতন ছাড়া হয়নি। সেটাও প্রায় ছ’মাস। কিন্তু এতদিনেও কোনও আলোড়ন পড়েনি। অর্থাৎ কোনও কর্মী দাবি করেননি যে, তিনি বেতন পাচ্ছেন না। তাহলে একটা বিষয় নিশ্চিত, এই বিপুল সংখ্যক কর্মচারীই ‘ভূতুড়ে’! দিন তিনেক আগে দেশ ও রাজ্যের ছোটবড় সব সংবাদ মাধ্যমে এই খবর ছড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওই একদিন। তারপর কী হল? মধ্যপ্রদেশের ড্রয়িং অ্যান্ড ডিসবার্সিং অফিসারদের ব্যাখ্যা তলব করেছিল ট্রেজারি। তাঁরা কী জবাব দিলেন? এত বড় দুর্নীতি, অথচ পরদিন থেকে মধ্যপ্রদেশ তথা জাতীয় মিডিয়ায় এ-নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই কেন? বিরোধীরাই বা কেন এ-ব্যাপারে মুখ খুলছে না? এই কোনও প্রশ্নের উত্তর নেই। স্রেফ চাপা পড়ে যাচ্ছে বা দেওয়া হচ্ছে। কেন? এই রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ নয় বলে? নাকি শাসকের রং গেরুয়া বলে?
একটা ব্যাখ্যা অবশ্য দিয়েছে মধ্যপ্রদেশ সরকার। তাদের দাবি, কোনও ভূতুড়ে কর্মী নেই! কীভাবে? ডবল ইঞ্জিন সরকারের ব্যাখ্যা, মোট ৪৪ হাজার ৯১৮ জন কর্মী নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তাঁদের মধ্যে ২১ হাজার ৪৬১ জন মারা গিয়েছেন। ৪ হাজার ৬৫৪ জন অন্যত্র ডেপুটেশনে রয়েছেন। ১০ হাজার ৮৮৫ জন হয় অবসর নিয়েছেন, না হয় ইস্তফা দিয়েছেন। ৪৮৩ জনকে বিনা বেতনে সাসপেন্ড করে রাখা হয়েছে। বাকিদের বিবিধ নানা জায়গায় দেখানো হয়েছে। সোজা কথায়, তাঁরা ন্যায়সঙ্গতভাবেই বেতন পাচ্ছেন না। এখানেও প্রশ্ন অনেক। ২১ হাজার কর্মী মারা গেলেন, আর সেই তথ্য ট্রেজারির খাতায় ছ’মাসেও উঠল না? সেটা তো পরবর্তী বেতনের আগেই নথিবদ্ধ হওয়ার কথা ছিল। হয়নি কেন? একই যুক্তি খাটে অবসর, ভলান্টিয়ারি রিটায়ারমেন্ট এবং ইস্তফার ক্ষেত্রেও। ডেপুটেশনে কোনও কর্মী গেলে, সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর ডেটা আপডেট করতে হয়। রাজ্য সরকারের সরাসরি পে-রোলের বাইরে গেলে তো বটেই। আর মৃতদের তথ্য? ছ’মাস দেরি হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
১৯৯০ সালে শুরু হওয়া ব্যাপম দুর্নীতি থেকে হাল আমলের বেতন কেলেঙ্কারি, মধ্যপ্রদেশকে টেক্কা দেওয়া ভূভারতের কোনও রাজ্যের পক্ষেই সম্ভব নয়। ফারাক শুধু একটাই— পশ্চিমবঙ্গ হলে তার প্রচার বিশ্বজুড়ে হয়। কিন্তু মধ্যপ্রদেশের দুর্নীতি চাপা পড়ে যায় ডবল ইঞ্জিনের প্রতাপে।
মোদির ভারতে ধনী আরও ফুলেফেঁপে উঠছে। আর গরিব তলিয়ে যাচ্ছে দারিদ্রের গহ্বরে। অথচ রাস্তার মোড়ে, জনসভায়, টিভির পর্দায় প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর তাঁবেদাররা ৪ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি নিয়েই হুঙ্কার দিয়ে চলেছেন। তাঁরা একটা হিসেব মানুষের সামনে রাখুন— সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলির আওতায় দেশের মোট কত মানুষ পড়েন! কোনও ব্যক্তি একটিও সামাজিক প্রকল্পে নাম লিখিয়ে থাকলে, সেই হিসেব যেন তালিকায় থাকে। তা সে আয়ুষ্মান ভারত হতে পারে, সবুজসাথী, কিংবা লাডলি বহেন। দেখবেন… তালিকা বানাতে দেশ উজাড় হয়ে যাবে। এটাই প্রকৃত সত্যি।
আরও পড়ুন-মৃত্যু মিছিল! কালো করে দেওয়া হল এয়ার ইন্ডিয়ার প্রোফাইল
আর একটা বিষয় হল জাল নোট। নোট বাতিলের ঘোষণার দিন জাল নোট আটকাবেন বলে রীতিমতো হুঙ্কার দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। সেই হুঙ্কারে সোচ্চারে গলা মিলিয়েছিলেন তাঁর পারিষদবর্গ। অথচ বছর দশেক পর তার পরিণতি হল মোদির সাদা পোশাকে কালি ছিটিয়ে দিয়েছে খোদ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তারা জানিয়েছে, মাত্র একবছরে (২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে) দেশের ৫০০ টাকার জাল নোট বেড়েছে রেকর্ড, ৩৭.৩ শতাংশ। এটা বাজেয়াপ্ত হওয়া জাল নোটের পরিসংখ্যান থেকে জেনেছে সর্বোচ্চ ব্যাঙ্ক। এর বাইরেও যে বাজারে কয়েক হাজার কোটি টাকার জাল নোট ‘আসল’ হয়ে রাজত্ব করছে, তা সহজেই অনুমেয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য দেখাচ্ছে, শুধু গত অর্থবর্ষে জাল ৫০০ টাকার নোটের আর্থিক অঙ্ক ৫ লক্ষ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। তার আগের আর্থিক বছরে ছিল ৪ লক্ষ ২৮ হাজার কোটি টাকা। ৫০০ টাকার পাশাপাশি ২০০ টাকার জাল নোট বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩.৯ শতাংশ। জালিয়াতি কারবারের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ১০, ২০, ৫০, ১০০ টাকার নোটও। ধরা যাক, নগদহীন অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ঘোষণার কথা। এ বিষয়েও সেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে বাজারে লেনদেন হওয়া নোটের সংখ্যা এবং তার মূল্য তার আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে যথাক্রমে ৫.৬ শতাংশ এবং ৬ শতাংশ। তাই এই বেশি পরিমাণ নোট ছাপানোর খরচও ২৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। মোদির ঘোষণার সবচেয়ে সাড়া জাগানো দাবি ছিল, কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। কারণ কালো টাকা সন্ত্রাসবাদীদের তহবিলে ঢুকছে, দুর্নীতির উৎসও কালো টাকা। ঘোষণার দশ মাস পর দেখা গেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানাচ্ছে, বাতিল হওয়া ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের প্রায় ৯৯ শতাংশই তাদের কাছে ফেরত এসেছে। প্রশ্ন ওঠে, যেখানে ৯৯ শতাংশ নোটই বদলে ফেলা হয়েছে সেখানে নোট বাতিল কি কালো টাকা সাদা করার প্রকল্প ছিল? ঘটনা হল, আজও কালো টাকা উদ্ধার নিয়ে কোনও তথ্যনিষ্ঠ রিপোর্ট মোদি সরকারের তরফে প্রকাশ্যে আনা হয়নি। ফলে দেশবাসীর পক্ষে প্রকৃত সত্যের নাগাল পাওয়া কঠিন।
সব মিলিয়ে চূড়ান্ত ব্যর্থ মোদি জমানা।