ভালবাসার দিনে হিংসার হিসাব

চলে গেল প্রেমদিবস। সেই আবহেও কি ভালবাসার শান্তির সুনিবিড় পীঠ হতে পারল সেই ভূমি, যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রীচৈতন্যের দীক্ষাগুরু ঈশ্বরপুরী, যেখানে জন্মভিটা সাধক কবি রামপ্রসাদের? ঐতিহ্যের উজ্জ্বল ক্যানভাসে যারা হত্যা হিংসা ও অমানবিকতার কলঙ্ক ছেটাতে চাইছে, তাদের চিনে নিন। জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করুন এই অপশক্তিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা নিয়ে। লিখছেন শমিত ঘোষ

Must read

ভালবাসার দিন। ভালবাসার উদযাপন। ব্রিটিশ আমলের জুট মিলের ধার দিয়ে একেরপর এক গঙ্গার ঘাট। যেসব ঘাট কত শত বছর ধরে কত কত ভালবাসার স্মৃতি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ যেখানে আজও কোনও এক বছর একুশের যুবতীর কপালে ভালবাসার চিহ্ন এঁকে দেয় তাঁরই কোনও সহপাঠী। সেই সব গঙ্গার ঘাট, যা গঙ্গার এপার ওপারের প্রেমিক প্রেমিকাদের নিশ্চিন্ত আশ্রয় হয়ে থেকেছে দশকের পর দশক, সেইসব গঙ্গার ঘাট হঠাৎ করেই কীভাবে যেন বহিরাগতদের আকুলস্থল হয়ে উঠল দু হাজার উনিশের পরবর্তী সময় থেকে। কাতারে কাতারে বহিরাগতদের দাপট বাড়ল। অজানা অচেনা মুখের সারি দখল নিলো শিল্পাঞ্চলের গঙ্গার ঘাটগুলোর। সন্ধ্যা হলেই সেই সব বহিরাগতদের বাহিনী দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করল। উনিশের লোকসভা নির্বাচন এবং তাঁর পরবর্তী গোটা ব্যারাকপুর লোকসভা জুড়ে যে সন্ত্রাসের ভয়াবহতা, তা দেখে শিউরে উঠেছিল গোটা রাজ্য, গোটা দেশ! ব্যারাকপুরের তৎকালীন সাংসদ অর্জুন সিংয়ের জল্লাদ বাহিনী তখন গোটা শিল্পাঞ্চল জুড়ে সন্ত্রাস চালাচ্ছে! এরপর হুগলি নদী দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। একুশের বিধানসভা এবং চব্বিশের লোকসভা পরপর দুটি বড় নির্বাচনেই শিল্পাঞ্চলের মানুষ বিজেপির গুন্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশীর্বাদধন্য প্রার্থীরা জিতেছেন রমরম করে।

আরও পড়ুন- অবৈধ নির্মাণ রুখতে আট সদস্যের কমিটি গড়ল রাজ্য

অর্জুন সিং প্রাক্তন হয়েছেন। কিন্তু, হেরে যাওয়ার পরেও নিজের স্বভাব পরিবর্তন করতে পারেননি। আসলে ঐতিহাসিকভাবে এই ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে প্রেমের সুরটা সুপ্রাচীন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর দীক্ষাগুরু ঈশ্বর পুরীর জন্মস্থান হালিসহরে৷ কালীনামের মধ্যেই জগতের সামগ্রিক সুখ খুঁজে নেওয়া সাধক রামপ্রসাদও এই মাটির সন্তান৷ লোকমাতা রানি রাসমণি, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কেশব সেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মঙ্গল পান্ডে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়— তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। কত কত নামী জনের পাদস্পর্শে ধন্য এই ব্যারাকপুর লোকসভার অঞ্চল। টিটাগড় থেকে কাঁচরাপাড়া এই অঞ্চল বাংলার সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় লৌকিক ইতিহাসের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। অথচ, এমন একটি ঐতিহাসিক এলাকায় যখন অর্জুন সিং-এর মতো ‘বাহুবলী’ সাংসদ নির্বাচিত হন, তখন থেকেই ব্যারাকপুরের সাধারণ মানুষ প্রমাদ গোনা শুরু করেছিল। কার্যক্ষেত্রে দেখাও গেল, সেই আশঙ্কাও অমূলক নয়! সাংসদ থাকাকালীন তো বটেই, এমনকি মানুষের রায়ে নির্বাচনে পর্যদস্তু হওয়ার পরেও এই বাহুবলী শিল্পাঞ্চলকে অশান্ত করার নানা রকম অসামাজিক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি নৈহাটির গৌরীপুরে একটি খুনের ঘটনাতেও এই প্রাক্তন সাংসদের নাম জড়িয়েছে। সিসিটিভি ক্যামেরায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, অর্জুন সিংয়ের ঘনিষ্ঠ জনৈক রাজেশ সাউ দলবল নিয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় খুন করছেন এক তৃণমূল কর্মীকে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এই রাজেশ সাউকে বাংলার পুলিশ গ্রেফতার করেছে উত্তরপ্রদেশের বালিয়া থেকে। গত কয়েকমাসে একটি অদ্ভুত প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বাংলায় যত অপরাধ খুন বা খুনের চেষ্টা অথবা ডাকাতির ঘটনা ঘটছে তার বেশিরভাগ অপরাধীরাই গ্রেফতার হচ্ছেন নয় প্রতিবেশী রাজ্য বিহার থেকে বা উত্তরপ্রদেশ থেকে! অর্থাৎ, এর থেকে অনুমেয় যে, বিজেপি-শাসিত দুই ডবল ইঞ্জিন সরকারের আইন শৃঙ্খলার কী অবস্থা! বস্তুত অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে এই দুই রাজ্য! অর্জুন সিংয়ের ঘনিষ্ঠ মহলে কান পাতলেই শোনা যায় উত্তরপ্রদেশের বালিয়া-র সঙ্গে বাহুবলী নেতার গভীর সংযোগের কথা! উত্তরপ্রদেশ থেকে কুখ্যাত শার্প শ্যুটার, সুপারি কিলার, মুঙ্গের থেকে ‘দেশি কাট্টা’ (দেশি বন্দুক) যে ভাইয়াজি এই শিল্পাঞ্চলে ঢোকান তা কাঁকিনাড়া, জগদ্দল, ভাটপাড়ার বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও জানে!
পারিবারিক সূত্রে উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ এবং উত্তরপ্রদেশের মসনদে থাকা ভারতীয় জনতা পার্টির প্রত্যক্ষ সহযোগিতাতেই কি জগদ্দলের ভাইয়াজি এখনও শিল্পাঞ্চলকে ‘রক্তাঞ্চল’ বানানোর এই প্রক্রিয়ায় টিকে রয়েছেন? এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই পরবর্তীকালে তদন্তে উঠে আসবে। কিন্তু, ভালবাসার মরশুমে পলাশের বদলে রক্তে রাঙা হচ্ছে শিল্পাঞ্চলের পথঘাট, এই দৃশ্য খানিক অস্বস্তিতেই ফেলে দেয়। সম্প্রতি নৈহাটির গৌরীপুরে খুন হওয়া তৃণমূলকর্মী সন্তোষ যাদবের ভয়াবহ রক্তাক্ত দেহ, শিল্পাঞ্চলের বাঙালির শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বইয়ে দেয়! এতটাই ভয়ংকর ছিল সেই মুখের অবস্থা! আর আবারও সেই চেনা প্রশ্নের ঘূর্ণিপাকে চক্কর খেতে হয়! টিটাগড় থেকে কাঁচরাপাড়া একের পর এক গঙ্গার ঘাটে ওরা কারা? সন্ধে হলেই যারা বাইকের সাইলেন্সার কাটিয়ে বিকট শব্দে দখল নেয় গঙ্গার ঘাটগুলোর! মুখগুলো অচেনা ঠেকে জুট মিল মহল্লায় প্রায় ৫০-৬০ বছর কাটিয়ে দেওয়া মালতী মাল্লাহ, রাম নাথ সাউদেরও। মুখে গুটখা, কখনও কখনও তীব্র মদের গন্ধ, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বচসা, বাঙালি হোক বা অবাঙালি মেয়েদের প্রতি তীব্র লোলুপ দৃষ্টি, এবং প্রতিবাদ করলেই মা-বোন তুলে হিন্দিতে গালাগাল! এই বহিরাগতরা জানে জগদ্দলের একটি নির্দিষ্ট বাড়ি এবং সেই বাড়ির মালিক যতক্ষণ আছেন ততক্ষণ তাদের এই দৌরাত্ম্য চলবে! এই লুম্পেনদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ গণপ্রতিরোধ গড়ে তুললে এদের বাঁচাতে স্বয়ং রাজ্যের বিরোধী দলনেতা পর্যন্ত এসে হাজির হয়ে যায়! রাজ্যের পুলিশ এদের গ্রেফতার করলে প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সংস্থা আসবে, এনআইএ আসবে, অমিত শাহ, জে পি নাড্ডারাও ঝাঁপিয়ে পড়বে এইসব সমাজবিরোধীকে বাঁচাতে। আর বারাকপুরের বাঙালি দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। চোখের জল মুছবে মজদুর লাইনের অশীতিপর বীরেন্দ্র যাদব। একসময় নৈহাটি জুট মিলে কাজ-করা বৃদ্ধ দেখছেন, চোখের সামনে বিহার-উত্তরপ্রদেশ থেকে নতুন নতুন ছেলে এসে ওদের মহল্লাটার দখল নিচ্ছে। এইসব বহিরাগতই আবার পাড়ার মোড়ে ‘ভাইয়াজি’র জন্মদিন পালন করে! বাজি ফাটে! ১০ পাউন্ডের কেক কাটা হয়! ভাইয়াজি নিজে এসে কাঁধে হাত রাখে এসব বহিরাগতর। যেমন রেখেছিল, নৈহাটির ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত রাজেশ সাউয়ের কাঁধে! এভাবেই বারাকপুর লোকসভায় বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ঘৃণার চাষ করে চলেছেন একটা লোক! ব্যারাকপুরের এক প্রবীণ শিক্ষকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই মাস্টারমশাই বলছিলেন, ‘বারাকপুরের মানুষের কাছে একটা অভিশাপের নাম অর্জুন সিং!’ মাস্টারমশাই নিজের নাম প্রকাশ্যে বলতে ভয় পাচ্ছেন। কারণটা বুঝি। এটা তো আর আট বা ন’য়ের দশক না, যে তপন সিনহার ছবির মতো পাড়ার গুন্ডা স্রেফ ঠান্ডা গলায়, ‘‘মাস্টারমশাই আপনি কিচ্ছু দেখেননি,” বলে শাসানি দিয়ে চলে যাবে! এখন কখন ভাইয়াজি বালিয়া থেকে শার্প শ্যুটার এনে খুন করিয়ে দেবেন কেউ জানে না! ভাটপাড়া অমরকৃষ্ণ পাঠশালার প্রাক্তন শিক্ষক জানেন সময়টা বদলে গেছে। জনতার রায়ে হেরে গিয়ে গদিচ্যুত এক বাহুবলী কোনওক্রমে চাইছেন নিজের হারানো জমি পুনরুদ্ধার করতে! তাই প্রাক্তন শিক্ষকের গলাটা আরও সাবধানী শোনায়।
ভাটপাড়া কালীমন্দির ঘাটে এখনও নিভৃতে সময় কাটাতে যায় কয়েকজন। ভালবাসার মানুষের সঙ্গে একটু ভাল সময় কাটাতে চায়। কাঁধে মাথা রাখে। ঘন হয়। বুড়ো রাধাচূড়া গাছটায় ক’দিন বাদে ফুল হবে। বসন্ত আসছে। ভালবাসার ঋতু। ভালবাসার মাস। বারাকপুর শিল্পাঞ্চলও দিন গোনে, অভিশাপ শেষ হবে একদিন। আর বোম-গুলি-রক্ত দিয়ে ঘুম ভাঙবে না এই জনপদের। ভালবাসা ছড়িয়ে পড়বে হুগলি নদীর ধারের শান্ত ঘাটগুলোয়…।

Latest article