বাংলা ভাষা নিয়ে কৌতূহল এবং তার উদ্ভব— দুটো নিয়েই নানান চর্চা বর্তমান। ছোটবেলায় সহজপাঠের অ, আ, ক, খ হোক বা ধীরে ধীরে মনের ভাব প্রকাশ করা, সেই অনুভূতি কিন্তু শিহরন জাগানো। আসলে আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। তাই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং সময়ের ব্যবধানে কেমন যেন আমরা বাংলা ভাষাতেই কথা বলা শুরু করি। তাই ভাষা নিয়ে বিশেষ চর্চা কোনওদিনও সেভাবে করা হয়ে ওঠেনি। বাংলা ভাষা যে স্বীকৃতি পেতে পারে এবং ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে তার বিস্তার যে আসমুদ্র হিমাচল সেটা আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী হস্তক্ষেপ না করলে আমরা কোনওদিন জানতেই পারতাম না।
এবার আসা যাক এই ভাষার উৎপত্তি সম্বন্ধে। যাই হোক বাঙালি আপনা-আপনি ভাষা শিখে যাচ্ছে, তাহলে কৌতূহল তো জাগবেই যে এই ভাষা এল কোথা থেকে! স্বল্প জ্ঞানে যেটুকু তথ্য-প্রযুক্তি মাধ্যম ঘেঁটে দেখেছি তাতে কারও মতে ১০০০ অব্দে (অথবা ১০ম থেকে ১১শ শতাব্দীতে) ব্রাহ্মী লিপির পরিবর্তিত রূপ থেকে বাংলা বর্ণমালার উদ্ভব হয়েছে, আবার চর্যাপদ অনুসারে সপ্তম খ্রিস্টাব্দে, আবার বাঙালি ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং সুকুমার সেনের মতে দশম শতাব্দীতে মাগাহি অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি।
আরও পড়ুন-ভাইফোঁটা নিলেন মন্ত্রী চন্দ্রনাথ
যাই হোক, হাজার হাজার বছরের পুরোনো এই ভাষার মিষ্টতা কিন্তু যত দিন গেছে তত বৃদ্ধি পেয়েছে। উইকিপিডিয়া অনুসারে বাংলা হল পঞ্চম সর্বাধিক কথ্য স্থানীয় ভাষা এবং বিশ্বের মোট ভাষাভাষীদের সংখ্যার দিক থেকে সপ্তম সর্বাধিক কথ্য ভাষা। ৯৮% বাংলাদেশি তাঁদের প্রথম ভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহার করে। ভারতে বাংলা দ্বিতীয় বহুল প্রচলিত ভাষা। পশ্চিমবঙ্গ, অসম (বরাক উপত্যকা), এিপুরা রাজ্যের সরকারি ভাষা এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্যেরও অন্যতম ভাষা হল বাংলা।
২০২৪ সালে ৩ অক্টোবর, ভারত সরকার বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা প্রদান করে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ লড়াইয়ের পর। ধ্রুপদী ভাষা হিসাবে মনোনীত হওয়ার জন্য কিছু মাপকাঠি থাকে, যেমন সেই ভাষার প্রাচীনত্ব থাকতে হবে, ১৫০০-২০০০ বছরের সময়কালের ইতিহাস নথিভুক্ত হতে হবে, সাহিত্যে তার অবদান থাকতে হবে এবং ভাষাটি অবশ্যই মৌলিক হতে হবে। বাঙালিরা হয়তো গবেষণা না করেই বলে দিতে পারবে বাংলা ভাষার সম্প্রসারণ ও ঐতিহ্য কতটা, কিন্তু ঐ যে প্রমাণ করার একটা রীতি আছে। সেই মোক্ষম কাজটি করেছেন আমাদের রাজ্যের অভিভাবিকা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। সুতরাং অন্যান্য ভাষার প্রতি সম্মান রেখেই এবং মানুষের আবেগকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলা ভাষা যে সম্মান পেয়েছে তার জন্য বাঙালি জাতির গর্ব হবে এটাই স্বাভাবিক। যেই ভাষা ভারতের দ্বিতীয় সর্বাধিক কথ্য এবং চতুর্থ দ্রুত বর্ধনশীল ভাষা তার ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেতে একটু দেরি হয়ে গেল বইকি? যাক দেরি হলেও বোধোদয় যে হয়েছে সেটাই বড় প্রাপ্তি।
আরও পড়ুন-আজ থেকেই শীতের আমেজ
শুধু ভারতে নয়, ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০ কোটি বাঙালির এই ভাষা সত্যি-সত্যিই গর্বের। বিভিন্ন বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সে আনুমানিক ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে চর্যাপদ থেকে হোক বা চতুর্দশ শতকে মুসলমানদের সালতানাত বা ষোড়শ শতকে মুঘলদের শাসন অথবা ১৯৪৭-এর পর ভাষা আন্দোলন যা ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি স্বরূপ একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। যদিও উনিশ শতকে এসে রাজা রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা ভাষা চূড়ান্ত রূপ পায়। আজ মানবসভ্যতার ইতিহাসে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি স্বতন্ত্র ভাষা হল বাংলা। বাংলা ভাষা শুধু প্রাচীনতম নয়, ঐশ্বর্যমণ্ডিতও বটে। বহু বাধা-বিঘ্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ক্রমশ এই ভাষা বিকশিত হয়েছে। সময়ের অন্তরালে বহুবিধ অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হলেও বাঙালিরা কিন্তু তাদের ভালবাসায় ও আন্তরিকতায় সকলকে আপন করে নিয়েছে বারংবার। বাঙালিদের এই প্রেমপ্রীতি বিশ্ব জুড়ে সমাদৃত হয়েছে যেমন, তেমনই অত্যন্ত সম্মানিতও হয়েছে। বাংলা ভাষা শুধু সুন্দরই নয়, এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও প্রমাণিত।
আরও পড়ুন-ঝাড়খণ্ডে নির্বাচনী প্রচারে মিথ্যার ঝড় তুললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শাহর মুখোশ খুলে দিল তৃণমূল
কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিম কামিন্স আবিষ্কার করেছিলেন যে, শক্তিশালী ভাষার মাধ্যমে শিশুরা তাদের দক্ষতার বিকাশ করতে সক্ষম। বাংলা ভাষার প্রভাব এতটাই যে বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিবর্গ এই ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন বারংবার। আগামীদিনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বাংলা ভাষা যে আলাদা মাত্রা পাবে তার অনুমান হয়তো বিশিষ্টজনেরা অচিরেই করতে পারছেন। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ও ব্যবহারের স্বপ্ন নিয়ে যাঁরা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলেন তাতে সার্থক রূপ দিয়েছেন আমাদের স্নেহের মুখ্যমন্ত্রী। প্রাথমিক শিক্ষার সর্বজনীনীকরণ এবং বিশেষজ্ঞ কমিটি দ্বারা প্রতিনিয়ত বাংলা শিক্ষার বিস্তার এক অনন্য মাত্রা পেয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর প্রচেষ্টা ও পরামর্শে পশ্চিমবঙ্গের সকল বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ভাষায় পঠন-পাঠন আবশ্যিক করা হয়েছে। এত প্রাচীন ভাষাকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় সরকারকে তদ্বির করে গেছেন শুধু নয়, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে গবেষণা করে নানান বৈজ্ঞানিক তথ্যও সংগ্রহ করেছেন। এই পরিশ্রমের ফল-তো পাওনাই ছিল। সবটাই যেন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারত তথা বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষা ও বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করার জন্য কোটি কোটি বাঙালি আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে আজীবন মনে রাখবেন।