শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইন কানুন সর্বনেশে—‘আবোল তাবোল’ গ্রন্থের শতবর্ষের বৎসরে এসে আরও প্রাসঙ্গিকভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে সুকুমার রায়ের এই ‘ননসেন্স ভার্স’-এর আড়ালে থাকা গভীর, তীক্ষ্ণ সমাজবোধ। যে-দেশে ইডি, সিবিআইয়ের মতো গোয়েন্দা সংস্থা থেকে শুরু করে দেশের নির্বাচন কমিশন এমনকী দেশের সর্বোচ্চ বিচারব্যবস্থাও বহুলাংশে প্রভু মোদিজি ও তার দলের অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত হয়, সেখানে তো আইন কানুন সর্বনেশে হবেই। তাই ‘কাজির বিচারে’ ‘একটু টাকা দণ্ড’ তো সহ্য করতেই হবে। একুশ টাকা নয়, বলা ভাল একুশ দফা! দেশের বিভিন্ন হাইকোর্ট থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় সর্বত্রই লক্ষ্য করে দেখবেন একাধিক বিচারপতি অবসরের পরেই হয় রাজ্যপাল নয় রাজ্যসভার সাংসদ-জাতীয় পদ আলো করে বসে আছেন দেশের শাসক দলের বদান্যতায়। স্বাভাবিকভাবেই ঠিক তখনই মানুষের মনে প্রশ্ন বা সংশয় জাগে যে, সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচারের অন্তিম আশা ভরসার স্থান যে বিচারালয়, তা আদৌ স্বাধীন, নিরপেক্ষ আছে তো? দেশের প্রত্যেক নাগরিকের ন্যায়বিচারের অধিকার সুরক্ষিত তো?
তবে এইসব গৈরিক বিচারপতিদের আলাদা করে দেখলে তাহলে বলতেই হয় রঙে, রূপে, সজ্জায় আমাদের বাংলার অভিজিৎ গাঙ্গুলি মশাই সবাইকে পিছনে ফেলে দুরন্তগতিতে এগিয়ে চলেছেন। প্রথমে চেয়ারে বসে ‘মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে’ মার্কা উত্তেজক সংলাপ, তারপরেই ‘ব্যাঙ্গালোর প্রোটোকল’-এর দফারফা করে বিচারপতির আসনে বসেই বিচারাধীন বিষয় নিয়েই রাজ্যের প্রথম সারির গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়া, পর্যবেক্ষণের নামে হাততালি পাওয়ার জন্য একের পর এক গ্যালারি প্লে করে গোদি মিডিয়া প্রমোটেড ‘ভগবান’ সেজে ওঠা, আর বইমেলা থেকে দুর্গাপুজো, খাদ্যমেলা থেকে বুটিক ডিজাইনারের ফ্যাশন মডেল— কোথায় নেই তিনি! মিডিয়ার প্রচার—এই দেখুন একজন বিচারপতি হয়েও চায়ের দোকানে চা খাচ্ছেন! বইমেলায় কী কী বই সংগ্রহ করলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়? ইত্যাদি। এমনকী অরাজনৈতিক ভেকধারী বামপন্থী রাজনৈতিক মঞ্চেও তাঁর গুরু বাম নেতা ও বিজেপির ত্রাতা আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, কান্তি গাঙ্গুলিদের সাথে তাঁকে গোদি আলো করে বসতে, উগ্র তৃণমূল-বিরোধী বক্তৃতা দিতেও দেখা যেত। এইভাবেই গাঙ্গুলি মশাইয়ের চলছিল বেশ। দলীয় মুখপাত্র হওয়ার কারণে এই বিষয়ে যখন ওঁর পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাবকে যুক্তি দিয়ে আমরা তুলে ধরতাম, তখন মিডিয়া থেকে শুরু করে বাম-বিজেপি নেতা সবার রোষের মুখে পড়তে হত এই অভিযোগে যে, দলীয় পদে থেকে বিচারপতির মতো একজন পদমর্যাদার লোককে এইভাবে আক্রমণ করা যায় না। আসলে আমরা কখনও কোনও বিচারপতিকে অশ্রদ্ধা করিনি, আমাদের সরকার বিভিন্ন সময়ে তাঁদের নির্দেশ অনুসারে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে, আমরা আক্রমণ করেছি বিচারপতির আসনকে কালিমালিপ্ত করে বসা এক তৎকালীন বিজেপি নেতাকে। আর আমাদের সেদিনের সেই বক্তব্য অচিরেই সত্যে প্রমাণিত হল। অবশেষে ঝুলি থেকে বেড়ালটা বেড়িয়েই পড়ল। ‘হজবরল’তে সুকুমার রায় লিখেছিলেন, ‘‘কে একটা বেড়াল গোঁফ ফুলিয়ে প্যাট প্যাট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম,‘কি মুশকিল! ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল।’’ এখানে অবিশ্যি, বেড়াল বা রুমাল না। এ একেবারে আস্ত বিচারপতি। মানে সুকুমার রায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে লিখতে ইচ্ছা করে, ‘‘ছিল বিচারপতি হল বিজেপি।’’ এতদিন যেটা আদালতের কক্ষে বসে, বিচারপতির আসনে বসে করতেন, এখন সেটাই করবেন, আরও খুল্লামখুল্লা করবেন, কেবল বিচারপতি ট্যাগটা আর থাকবে না। এখন থেকে তিনিই কেবলই বিজেপি। আর এখন অভিজিৎবাবুর নিজের সাক্ষাৎকারেই স্পষ্ট যে বিচারপতির আসনে থাকাকালীনই তাঁর বিজেপির সঙ্গে যোগদানের বিষয়ে বিস্তর কথা এগোয়, তাই তো অবসরের বয়সের অনেক আগেই অবসর নিয়ে দুদিনেই বিজেপিতে যোগদান আর যোগ দিয়েই একেবারে তমলুক লোকসভার প্রার্থী!
আরও পড়ুন- আজ উত্তরে জোড়া সভা নেত্রীর, ধূপগুড়িতে জনসভায় অভিষেক
যদিও বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের পায়ের কাছে বসে আইন শেখা মানুষটি বোধহয় একটু দ্বিধাতেই ছিলেন। কোন দলে যাবেন। ইতিপূর্বেই তিনি নিজের বেশ বাম-বাম ইমেজ তৈরি করেছেন। বইমেলায় ‘গণশক্তি’, ‘গণবাণী’র স্টলে ঘোরেন, বাড়ির বুক সেলফে লেনিন, মার্ক্স সাজিয়ে রাখেন। কিন্তু উনি আবার একটু পুজোআচ্ছাও করেন, সিপিএমে গেলে সেসবে একটি সমস্যা তাই বিজেপিই সই! ০ হওয়া সর্বহারা দলের এলিটিস্ট সমর্থকদের বুকে দাগা দিয়ে এইভাবেই অরণ্যদেবের গোয়ালযাত্রা সম্পূর্ণ হল। তবে একটা কথা, গঙ্গোপাধ্যায় মশাই পরিষ্কার করে দিয়েছেন, এ-রাজ্যে সিপিএম আর বিজেপির মধ্যে তেমন একটা ফারাক নেই, ওই এক পুজোআচ্ছার ব্যাপারটা ছাড়া। মানে যেমনটা আমরা এতদিন ধরে বলে আসছিলাম। যাহাই বাম। তাহাই রাম। যাহাই বাহান্ন তাহাই তিপান্ন আরকি!
হালকা চাল ছেড়ে এবার একটু সিরিয়াস হওয়া যাক। আসলে, যে সাংবিধানিক সংস্থাগুলিকে এদেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ সম্ভ্রমের চোখে দেখত, যাদের কাছে দেশের সংবিধান, নাগরিক অধিকার ও ন্যায়বিচারকে সুরক্ষিত বলে বিশ্বাস করত মানুষ সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করতে করতে কার্যত ধ্বংস করে দিয়েছে বিজেপি। এই যেমন ভারতবর্ষের বিভিন্ন গর্বের প্রতিষ্ঠান ইডি, সিবিআই, এনআইএ, আয়কর দফতর। এগুলো সম্পর্কে মানুষের আলাদা একটা শ্রদ্ধা ছিল। আজ সদ্য নাকের নিচে গোঁফ-ওঠা কিশোরও বলে দেবে, ওই সংস্থাগুলো বিজেপির শাখা সংগঠনে পরিণত হয়েছে। গত দশ বছরে এমন কোনও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নেই, যাকে বিজেপি নিজেদের কাজে লাগায়নি। কিন্তু তারপরেও, এ-দেশের মানুষের শেষ আশ্রয় এ-দেশের ন্যায়ালয়গুলো। (এরপর আগামিকাল)