সম্প্রীতির জেলা মুর্শিদাবাদের সামসেরগঞ্জে সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক অশান্তি ফের প্রমাণ করে দিল— পশ্চিমবঙ্গকে (West Bengal) এখন সংঘ পরিবার ও বিজেপি সর্বনাশা ‘ল্যাব’-এ পরিণত করতে চাইছে। ক্ষমতার মোহে অন্ধ বিজেপি ও আরএসএস ভারতের বহুত্ববাদী সামাজিক গঠনতন্ত্রকে চুরমার করতে চায়। সংখ্যাগুরুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তারা ‘স্পার্ক-মডেল’কে কাজে লাগিয়ে এমন এক রাজনৈতিক প্রকৌশল করেছে, যা জাতিগত সহাবস্থানকে মুহূর্তে বিদীর্ণ করতে সক্ষম।
এ মডেলের মূল চালিকাশক্তি হল গুজব, বিভ্রান্তি, ও পরিকল্পিত উসকানি। কখনও মসজিদে অস্ত্র মজুদের গুজব ছড়ানো হয়, কখনও হিন্দু নারীদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ষড়যন্ত্রের গল্প সাজানো হয়। এই সামান্য ‘স্পার্ক’ থেকেই ছড়িয়ে পড়ে ভয়, ঘৃণা, উত্তেজনা— যা মিডিয়া ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সক্রিয় সহযোগিতায় রূপ নেয় সংঘর্ষে। এই পদ্ধতি স্বতঃস্ফূর্ত নয়, এটি একটি শৃঙ্খলিত, পরিচালিত ও প্রয়োগযোগ্য ‘সাম্প্রদায়িক প্রকৌশল’ যার প্রাথমিক প্রয়োগ গুজরাতে হয়েছিল ২০০২ সালে। এখন সেই মডেলই রফতানি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোতে— বিশেষ করে মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদাবাদের প্রায় ৬৬% জনসংখ্যা মুসলমান— এই বাস্তবতাকে এখন ‘সংখ্যার রাজনীতি’র হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে। সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ‘‘আতঙ্কিত” দেখানোর চেষ্টায় বলপ্রয়োগে তৈরি করা হচ্ছে একটি ভুয়া নিরাপত্তাহীনতার বোধ। অথচ যুগের পর যুগ এই জেলায় হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থান ছিল শ্রদ্ধাভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার নারকীয় ঘটনা হোক, কিংবা গুজরাত দাঙ্গা হোক কিংবা সুপ্রিম কোর্টের রামমন্দির সম্পর্কিত রায়দান হোক— কোথাও মুসলিম-অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলায় কোনও সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। এমনকী নাগরিকত্ব সংশোধন আইন ও এনআরসির বিরুদ্ধে এই জেলায় হিংসার প্রবেশ হলেও তার লক্ষ্যবস্তু ছিল সরকারি সম্পত্তি। যেমন রেলের সম্পত্তি এই হিংসায় আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে কোনও হিন্দুর উপর এই হিংসার আঁচ লাগেনি। অথচ সাম্প্রতিককালে সম্প্রীতির মুর্শিদাবাদ হয়ে উঠেছে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঝটিকাকেন্দ্র।
আমি নিজেই মুর্শিদাবাদের ভূমিপুত্র—হরিহরপাড়া বিধানসভার বিহারিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের রামকৃষ্ণপুরে আমার পরিবার আজও বসবাস করে। ১৯৭০-এর দশকে একটি বিচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ঘটনা বাদ দিলে, আমাদের এলাকায় সৌহার্দ্যের পরিবেশই প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু বিগত এক দশকে, বিশেষত নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে, এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ঘিরে এক অদৃশ্য চাপ ও অনাস্থা তৈরি হয়েছে। এই চাপ সহিংসতায় রূপ নেয়নি, এমনকী বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গুজরাত দাঙ্গা বা রামমন্দির মামলার রায়—এসবেও মুর্শিদাবাদে কোনও বড়সড় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেনি। কিন্তু এখন সেই শান্ত মাটিতে পরিকল্পিত উসকানির বীজ বোনা হচ্ছে। বেলডাঙায় কার্তিক পুজোর প্যান্ডেলে ‘আল্লাহ’র নামে কুরুচিকর লেখার প্রদর্শনী নিছকই ভুল ছিল না— ছিল ঠান্ডামাথায় সংঘের অপারেশন রুম থেকে নির্দেশিত প্ররোচনার ফল। তারপর থেকে মালদা ও মুর্শিদাবাদের মুসলিম ঘনত্বের এলাকাগুলোতে বারবার ছড়ানো হচ্ছে এমন বিভেদ সৃষ্টিকারী কনটেন্ট।
মুর্শিদাবাদ জেলার ৫টি মহাকুমার আনুমানিক ২১৬৬টি গ্রাম ও ৭টি পৌরসভার ৭০টি ওয়ার্ডের মধ্যে হিংসার কবলে এসেছিল জঙ্গিপুর মহকুমার সামসেরগঞ্জ ব্লকের ধুলিয়ান পৌরসভার ১৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে কয়েকটি ওয়ার্ড এবং পৌরসভা সংলগ্ন কয়েকটি গ্রাম ও পাড়ার মধ্যে হিংসা সীমাবদ্ধ থেকেছে। অথচ মিডিয়া ও বিজেপির মঞ্চ থেকে বলা হচ্ছে গোটা জেলায় হিন্দুরা আক্রান্ত। যেন জেলাটি এখন ‘ধর্মযুদ্ধ’-এর রণাঙ্গন। এমনকী এই হিংসায় বিএসএফের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে। হিজলতলার পলি খাতুন সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন— যারা হামলা চালিয়েছিল, তাদের গায়ে বিএসএফের পোশাক থাকলেও পায়ে ছিল চপ্পল। যদি সত্যি হয়, তবে তা রাষ্ট্রীয় ছদ্মবেশে উসকানি দেওয়ার ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত।
‘ওয়াকফ সংশোধনী আইনের’ প্রতিবাদে যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তা অবশ্যই দুঃখজনক। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘ পরিবার ও বিজেপি তাদের সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রকে অক্সিজেন জুগিয়েছে। সৌভাগ্যবশত, জেলার প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং সম্প্রীতি-পন্থী হিন্দু-মুসলমানরা সেই আগুনকে ছড়িয়ে দিতে দেয়নি। তা না হলে এই অশান্তি হয়ে উঠত নির্বাচনী রাজনীতির চরম অস্ত্র।
আজ ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ নামক অজুহাতে বিজেপি নেতারা যেভাবে হুমকি দিচ্ছেন— ‘গাড়ি ধরে মারা হবে’, ‘উত্তরপ্রদেশ থেকে লোক এনে ঘরছাড়া করা হবে’— তা স্পষ্ট করে দেয় তারা কতটা জনবিচ্ছিন্ন এবং দেউলিয়া রাজনীতির আশ্রয়ে নিরীহ মানুষকে ঢাল বানাতে চাইছে। ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে এই বিভাজনমূলক রাজনীতি আরও হিংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে। কারণ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য হল—মুসলমানদের শত্রু হিসেবে নির্মাণ এবং হিন্দুদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করা। বহু আগে থেকেই আরএসএস সীমান্তবর্তী মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলোকে ‘সন্ত্রাসের করিডর’ আখ্যা দিয়ে বিভাজনের মনস্তত্ত্ব গড়ে তুলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া নামক তথাকথিত ‘গোদি মিডিয়া’। এরা পরিকল্পিতভাবে হিন্দুদের কান্না ও রক্তাক্ত ছবি ছড়িয়ে দেয়, যাতে সংখ্যাগুরুর মধ্যে ভিকটিমহুড তৈরি হয়, এবং মুসলমানরা হয়ে ওঠে সহজ টার্গেট। প্রশ্ন হল— এই ভিডিওগুলো ছড়ায় কারা? মুসলমানরা আক্রান্ত হলে সেই ফুটেজগুলো কেন সামনে আসে না?
দিল্লি দাঙ্গা, খারগোন, সাহারানপুর— সব জায়গায় প্রশাসনের দমননীতি একতরফা ভাবে মুসলমানদের টার্গেট করেছে। আজ মুর্শিদাবাদেও সেই নীলনকশা কার্যকর করার প্রস্তুতি চলছে— যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন ক্লিন আপ’। যেখানে এক সম্প্রদায়কে বারবার প্ররোচিত করা হয়, এবং প্রতিক্রিয়ার মুহূর্তে তাদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দিয়ে দমন করা হয়। যারা বলেন মুর্শিদাবাদের এই অস্থিরতা কেবল স্থানীয় অসন্তোষ, তারা চক্রান্তের গভীরতা ধরতে ব্যর্থ। বিজেপি বাংলার রাজনীতিতে প্রবেশ করার পর থেকেই নির্দিষ্ট জেলাগুলোকে ‘মিনি পাকিস্তান’ বলে আখ্যা দিতে শুরু করে। মুসলিম এলাকার ভোট ‘তুফানি’ বলে অবজ্ঞা করা হয়, আর হিন্দু ভোটকে গণতন্ত্রের উৎসব বলা হয়— এই দ্বিচারিতা আজ ধর্মীয় মেরুকরণের সামাজিক ভিত্তি তৈরি করেছে।
সংঘ পরিবারের সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ কেবল একটি মতাদর্শ নয়, বরং এটি একটি সুপরিকল্পিত এবং সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রকল্প, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হল ভারতের রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে হিন্দু সংখ্যাগোষ্ঠীর আধিপত্যে রূপান্তরিত করা। এই প্রকল্পে ব্যবহৃত হয় সহিংসতা, ঘৃণা, আইনগত বৈষম্য, এবং সাংস্কৃতিক নির্মূলীকরণের মত উপাদান, যেগুলো নিছক হাতিয়ার নয়, বরং এগুলোকে কৌশলগত ভাবে এমনভাবে পরিবেশন করা হয় যেন একটি নিখুঁত ‘রাজনৈতিক রন্ধনশিল্পের’ অংশ— যেখানে প্রতিটি পদই সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিত্ববাদের স্বাদের বাহক। এই ‘রন্ধনপর্বের’ সূচনা হয় তথাকথিত ‘লাভ জিহাদ’-এর আশঙ্কার মাধ্যমে। এখানে মুসলিম পুরুষদের হিন্দু নারীদের প্রেম বা বিয়ে করার ঘটনাকে বিপজ্জনক ষড়যন্ত্র হিসেবে তুলে ধরা হয়, যার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের ‘সতীত্ব’ ও ‘পরিচয়’ রক্ষার নামে একটি ভয়-ভীতি ও ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করা হয়। এই পুরো প্রচেষ্টার পিছনে যেটা কাজ করে তা হিন্দুধর্ম নয়—হিন্দুত্ববাদ। হিন্দুত্ব এক ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ, যা ভিন্নমত, সংখ্যালঘু ও অনগ্রসর শ্রেণির কণ্ঠস্বর চেপে ধরে। যারা আজ ‘আল্লাহ’কে গালি দেয়, তারা কাল ‘রাম’ নামেও গালি দেবে— এদের লক্ষ্য একটাই : ক্ষমতা। আজ টার্গেট মুসলমান, কাল টার্গেট হবে দলিত, খ্রিস্টান, আদিবাসী কিংবা মুক্তচিন্তার মানুষ।
আরও পড়ুন-মোলিনার দর্শনেই মহড়া মোহনবাগানের