কৃষি বিপ্লবী অনিতা

সফল হতে গেলে দরকার নেই পুঁথিগত বিদ্যার বা বিস্তর বইয়ের জ্ঞান। উদ্যমী মানসিকতা, অধ্যবসায়, কাজের প্রতি শ্রদ্ধাই এনে দিতে পারে সাফল্য। এমনই এক উদ্যমী মহিলা-কৃষক হলেন অনিতা নেগি। হিমাচলের ছোট্ট গ্রামের অনিতা আজ বহু নারীর অনুপ্রেরণা। লিখছেন সোহিনী মাশ্চারক

Must read

জীবনের যেকোনও ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে গেলে বা বলা ভাল সফল পরিবর্তন আনতে হলে প্রয়োজন দৃঢ় সঙ্কল্প ও উদ্ভাবনী শক্তি ও অদম্য মানসিক শক্তি। সুদূর হিমাচল প্রদেশের প্রত্যন্ত এক গ্রাম যার নাম তালাগালি— সেই গ্রামের বাসিন্দা ৫২ বছর বয়সি কৃষক অনিতা নেগি এমনই এক সফল পরিবর্তনের কাহিনি লিখছেন যা সকলকে বিশেষ করে মহিলা-কৃষকদের যাঁরা নিজেরা কিছু করে দেখাতে আগ্রহী, তাঁদের খুবই অনুপ্রাণিত করেছে। একটা বটগাছ যেমন সব্বাইকে তার ছত্রছায়ায় রাখে ৫২ বছর বয়সি অনিতাও নিজের ও তাঁর পরিবারের পাশাপাশি প্রায় ২০০ জন মহিলা-কৃষক এবং গৃহবধূকে শিক্ষিত এবং অনুপ্রাণিত করেছেন বা বলা ভাল এইসব মহিলাদের অনুর্বর জমিগুলিকে লাভজনক জমিতে পরিবর্তিত করতে সক্ষম হয়েছেন। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে চলেছেন। কে এই অনিতা নেগি?
হিমাচল প্রদেশের স্বল্পোন্নত অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি হল এই কুল্লুর বানজার সাবডিভিশনের প্রত্যন্ত তালাগালি গ্রাম। সেখানকার বাসিন্দা অনিতা বিয়ের পর থেকে গত ২৫ বছর ধরেই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা নিজেরাই রসুন, বাঁধাকপি, মটরশুঁটি এবং টমাটোর চাষ করতেন, লাভও এতে মন্দ হত না। অনিতারা পাঁচজন সাধারণ কৃষকের মতো রাসায়নিক সার ব্যবহার করতেন কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেরাই বুঝতে পারছিলেন যে রাসায়নিক সারের ব্যবহার জমির উর্বরতা নষ্ট করছে এবং জমির গুণগত মান হ্রাস পাচ্ছে। এর পাশাপাশি অনেকটা উৎপাদন খরচ এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাওয়ার বিষয়টিও তাঁদের কাছে উদ্বেগের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আরও পড়ুন-ভারতে বন্ধ হল পাক প্রধানমন্ত্রীর ইউটিউব চ্যানেল

এমতাবস্থায় ২০১৮ সাল একটা বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে অনিতার জীবনে। তাঁর গ্রামেই আয়োজিত একটি ইন্টারেক্টিভ সেশনে তিনি যোগদান করেন। তৎকালীন প্রাকৃতিক খেতি কিষাণ খুশাল যোজনার নির্বাহী পরিচালক রাজেশ্বর সিং চান্দেল ও তাঁর কৃষি বিজ্ঞানীদের একটি দলের তরফে আয়োজিত এই সেশনে PK3Y কৌশল অর্থাৎ রাসায়নিকমুক্ত কৃষিকাজের ধারণাকে প্রচার করা করে। অনিতা সেই পদ্ধতির কথা জানতে পেরে উৎসাহিত হন। শুধু তাই নয়, হাতে কলমে তা পরীক্ষা করে দেখতে উদ্যোগীও হন তবে প্রাথমিক ভাবে চিরাচরিত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে নতুন কিছু করার ক্ষেত্রে খুব একটা আত্মবিশ্বাসী তিনি ছিলেন না। তাই অনিতা রান্নাঘরের বাগানে রাসায়নিকমুক্ত চাষাবাদ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। আন্তঃ-ফসল পদ্ধতিতে পরিবর্তন করার পাশাপাশি রাসায়নিক সার ব্যবহার ত্যাগ করেন। এতে উৎপাদন খরচ শূন্য হয়ে যায় কিন্তু পরীক্ষাটি সফল হয়। ব্যস এরপরই অনিতা রান্নাঘরের ওই ছোট চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে তাঁর তিন বিঘা জমিতে PK3Y কৌশল গ্রহণ করে কিছু ফলের গাছ এবং টমাটো, রসুন, পালং শাক, ধনেপাতা এবং মটরশুঁটির মতো ছ’টি অর্থকরী ফসল রোপণ করে ফেলেন। এই পরীক্ষাও সফল হয়। আসলে PK3Y কৌশল বা প্রাকৃতিক খেতি খুসাল কিষাণ যোজনা স্কিমে খামারে গোবর, মূত্র এবং অন্যান্য গৃহস্থালির বর্জ্য ব্যবহার শুরু করার সাথে সাথে খরচ এক ধাক্কায় অর্ধেকে নেমে আসে। এরপর ক্রমে ক্রমে অনিতা ফলের নার্সারি খোলেন এবং চার বিঘা জমিতে আপেল, নাশপাতি, কিউই এবং ডালিম প্রভৃতি রোপণ করেন। তিনি ২০২০ সালে ১,৫০০টি, ২০২২ সালে ২০,০০০টি এবং ২০২৩ সালের মধ্যে ২৫,০০০টি ফলের চারা উৎপাদন করতে সক্ষম হন। এর সবটাই তিনি প্রাকৃতিক কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার করে উৎপাদন করেন। তিনি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাঁর চাষবাসকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করেছেন সবসময়।

আরও পড়ুন-প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক ওষুধের নাম লিখতে ফের নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের

এই PK3Y কৌশল শুধু যে উচ্চ উৎপাদন খরচ কমাতে পেরেছে তাই নয়, এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর ফসল রোপণ করা গেছে। দিনের শেষে, কৃষক এবং ভোক্তাদের স্বাস্থ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়— একথা বলাই বাহুল্য। তিনি বিশ্বাস করেন যে প্রাকৃতিক কৃষিকাজ কেবল অর্থনৈতিকভাবেই নয়, স্বাস্থ্যের দিক থেকেও আশীর্বাদস্বরূপ। রাসায়নিক ছাড়া চাষ করা ফসল শরীরের ক্ষতি করে না। অনিতার এই উদ্যোগ তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যেও এক বিশাল সচেতনতা তৈরি করেছে। উদ্ভাবনী এই প্রাকৃতিক কৃষি পদ্ধতিকে আপন করে তথা সাফল্য অর্জন করে তিনি নিজের উপকার তো করেইছেন তার পাশাপাশি অনিতা প্রায় ২০০ জন মহিলা কৃষক এবং গৃহবধূকে শিক্ষিত এবং অনুপ্রাণিত করেছেন। এইসব মহিলাদের অনুর্বর জমিগুলিকে উর্বর ও লাভজনক জমিতে রূপান্তরিত করতে অনুপ্রাণিত করেছেন ও এই মহিলারা যাতে স্বনির্ভর হয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের পরিচয় গড়ে তুলতে পারেন সেই চেষ্টাও করে চলেছেন। তিনি কীটনাশক এবং রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষ করেন যা মাটির স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য ভাল, তিনি স্কুলছাত্রীদেরও এই কৌশলগুলি গ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি জাতীয় ও রাজ্য পর্যায়ে বেশ কয়েকটি পুরস্কার এবং সম্মান পেয়েছেন, পাশাপাশি কৃষিকাজের মতো পেশাটির প্রতি যাতে এই অঞ্চলের পাহাড়ি পরিবারগুলি আরও উৎসাহ অনুভব করে সেই জন্য তিনি একজন চালিকা শক্তি হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন নিরলস ভাবে। এছাড়া ৫২ বছরের এই উদ্যমী মানুষটির কাছে ফলের চারা সংগ্রহের কৌশল এবং উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে তৈরি করার দক্ষতা ও কৌশল আয়ত্ত করার জন্য এই এলাকার মানুষের ভিড় লেগেই থাকে।
অনিতা নেগির এই সাফল্যের কাহিনি সম্পর্কে তথ্য ও জনসংযোগ সচিব রাকেশ কানওয়ার জানিয়েছেন, হিমাচল প্রদেশের মহিলারা ঐতিহ্যগতভাবে কৃষিকাজে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। কিন্তু এখন প্রশিক্ষণ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আয়োজিত বিভিন্ন কর্মশালায় যোগদান করার ফলে তাঁরা আরও বেশি চাষবাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছেন এবং তাঁদের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। নেগির মতো উদ্যোক্তারা স্থিতিশীল ও স্থায়ী কৃষির প্রচারে সহায়তা করছেন যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এবং জীববৈচিত্র বজায় রাখতে একইসঙ্গে আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।

আরও পড়ুন-উন্নয়নের প্রশ্নে দ্বিচারিতা কংগ্রেস ও সিপিএমের

এখনও পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী অনেক মহিলা কৃষক ছোট ছোট দল গঠন করেছেন এবং সার্টিফিকেশন পাওয়ার পর কৃষক-উৎপাদক সংগঠনের মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে তাঁদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করছেন। ছোট খামারে চাষবাস বেশি লাভজনক বলে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, তাই তাঁরা একক ফসল চাষ থেকে আন্তঃফসলের দিকে ঝুঁকছেন।
যখন হিমাচল, উত্তরাখণ্ড এবং অন্যান্য রাজ্যের কৃষকেরা কৃষিকাজকে একটি অকার্যকর পেশা হিসেবে দেখছেন এবং উন্নত বিকল্পের জন্য তাঁদের খামার ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন, অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছেন। তখন অনিতার মতো মহিলারা কৃষিকাজের মতো পেশাকে আঁকড়ে ধরে নিরলস ভাবে এগিয়ে চলেছেন ও বাকিদের অনুপ্রাণিত করছেন। উদ্ভাবনী কৃষি কৌশল অবলম্বন করে অনিতা এখন বছরে ৪০ লক্ষ টাকা আয় করতে সক্ষম হন— তাঁর নেই কোনও ঋণ, নেই কোনও ব্যাঙ্কিং দায়।
আসলে অনিতার গল্পটি প্রমাণ করে যে একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আপনাকে সেরা স্কুলে পড়তে হবে না বা গভীর বইয়ের জ্ঞান অর্জন করতে হবে না। উদ্যমী মানসিকতা, অধ্যবসায় ও কাজের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও বিশ্বাস আপনাকে সাফল্য এনে দেবে আর ঠিক এই জন্যই অনিতা আজকের অবস্থানে পৌঁছতে পেরেছেন এবং গ্রামের মহিলাদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন, প্রাকৃতিক চাষের মাধ্যমে পরিবেশের সুরক্ষাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

Latest article