‘‘ধনীর দোষেই দরিদ্র চোর হয়। পাঁচ শত দরিদ্রকে বঞ্চিত করিয়া একজনে পাঁচ শত লোকের আহার্য সংগ্রহ করিবে কেন? যদি করিল, তবে সে তাহার খাইয়া যাহা বাহিয়া পড়ে, তাহা দরিদ্রকে দিবে না কেন?’’
লাইনগুলো বঙ্কিমচন্দ্রের। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ ‘বিড়াল’ শীর্ষক রচনার।
সেই কবেকার লেখা। ১৮৭৫ সাল নাগাদ। আর এটা ২০২১। ১৪৬ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। অথচ, এখনও কী ভয়ানক রকমের প্রাসঙ্গিক!
এ-সব লাইনের, এ-সব জিজ্ঞাসার প্রাসঙ্গিকতা যে হারায়নি, হারায় না, তা ফের একবার মনে করিয়া দিল বিশ্ব বৈষম্য প্রতিবেদন বা ওয়ার্ল্ড ইনইক্যোয়ালিটি রিপোর্ট। এই প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে একটাই কথা। ভারত একটা ভীষণ গরিব দেশ, কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্যে ভরপুর। কারণ এই দেশে প্রবল বিত্তবান অভিজাতরাও আছেন।
ওয়ার্ল্ড ইনইক্যোয়ালিটি রিপোর্ট, ২০২০ স্পষ্ট দেখাচ্ছে জাতীয় আয়ের ওপরের দিকের ৫৭ শতাংশ দেশের উঁচুতলার ১০ শতাংশের মালিকানায় রয়েছে বা তাঁরা কবজা করে রেখেছেন। একেবারে চরম ধনী যাঁরা তাঁদের ১ শতাংশ আবার ২২ শতাংশ জাতীয় আয়ের মালিক। আর একেবারে নিচু তলার ১৩ শতাংশ জাতীয় আয়ের নিচের দিকে ৫০ শতাংশের অধিকারী।
লুকাস চ্যানসেল, টমাস পিকেটি, ইম্যানুয়েল সেইজ এবং গ্যাব্রিয়েল জুকম্যানের মতো অর্থনীতিবিদেরা এই রিপোর্ট তৈরির পিছনে আছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন, ২০২০-তে ধনী দেশগুলোর মধ্যে অর্ধেক দেশ এবং গরিব দেশগুলোর ভেতরেও অর্ধেক দেশে আয় কমেছে। আর সেই আয়ের পতনের ছাপ সবচেয়ে বেশি পড়েছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে, বিশেষত ভারতে।
আরও পড়ুন-জগতের নাথ জয় জগন্নাথ
এই রিপোর্ট অনুসারে ভারতের তথাকথিত মধ্যবিত্তরা বেশ গরিব। মোট জাতীয় আয়ের ২৯.৫ শতাংশের মালিক তাঁরা। তাঁদের মালিকানাধীন সম্পদের পরিমাণ মেরেকেটে গড়ে ৭ লক্ষ ২৩ হাজার ৯৩০ টাকা। অন্যদিকে, দেশের শীর্ষস্থানীয় ধনীদের ১০ শতাংশ যাঁরা তাঁদের মালিকানাধীন সম্পদের পরিমাণ গড়ে ৬৩ লক্ষ ৫৮ হাজার ৭০ টাকা। আর ওপরতলার কেবল ১ শতাংশ যাঁরা তাঁদের হাতে আছে জাতীয় আয়ের ৩৩ শতাংশ, এঁদের মালিকানাধীন সম্পত্তির পরিমাণ গড়ে ৩ কোটি ২৬ লক্ষ ৪৯ হাজার ৩৬০ টাকা।
এখানেই শেষ নয়। আরও আছে।
প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয়দের বার্ষিক গড় আয় ২০২১-এ দেখা যাচ্ছে ২ লক্ষ ৪ হাজার ২০০ টাকা। নিচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষ বছরে গড়ে ৫৩ হাজার ৬১০ টাকা আয় করেন। অর্থাৎ তাঁদের মাসিক আয় সাড়ে চার হাজার টাকারও কম। উঁচুতলার ১০ শতাংশের বার্ষিক আয় তার তুলনায় কুড়ি গুণ বেশি। বছরে গড়ে ১১ লক্ষ ৬৬ হাজার ৫২০ টাকা। গার্হস্থ্য সম্পদের পরিমাণ গড়ে মোটে ৬৬ হাজার ২৮০ টাকা।
নীতি আয়োগের বহুমুখী দারিদ্র্যসূচক সংক্রান্ত তথ্যাদি বলছে এ-দেশে প্রতি চার জনের একজন গরিব। সবচেয়ে বেশি গরিবের ঠিকানা বিহার। সেখানকার ৫১.৯১ শতাংশ লোক দরিদ্র। তৃতীয় স্থানে আছে উত্তরপ্রদেশ। সেখানকার ৩৭.৭৯ শতাংশ লোক গরিব।
লক্ষণীয়, বিহারে সরকারের জোটসঙ্গী বিজেপি। আর উত্তরপ্রদেশের শাসনপাট বিজেপির হাতেই ন্যস্ত। অর্থাৎ, দুটি রাজ্যই ডাবল ইঞ্জিন সরকারের সুবিধা পায়। আর এই দুটি রাজ্যেই গরিবি মারাত্মক। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
উল্লিখিত রিপোর্টে আরও দেখা যাচ্ছে, ভারতে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পত্তির পরিমাণ হুড়মুড়িয়ে বাড়ছে। ১৯৮০-তে এদেশে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পত্তি ছিল ২৯০ শতাংশ। ২০২০-তে তা বাড়তে বাড়তে ৫৬০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
রিপোর্ট বলছে, মেয়েদের আয়ও কমছে। এখন দেশের মোট আয়ের ৩৫ শতাংশেরও কম আসে মেয়েদের উপার্জিত অর্থ থেকে।
এককথায় মোদি-শাহদের জামানায়, ‘পার্টি উইথ আ ডিফারেন্স’-এর শাসনকালে ভারতের অর্থনৈতিক চিত্রে আয়-বৈষম্যের ছবিটা তীব্রতর হচ্ছে। হাজার হোক, অন্যরকম রাজনৈতিক দলের শাসন তো! এমন জমানা দেশে আগে কখনও আসেনি।
আবদুল জব্বার ‘বদলিওয়ালা’তে ঠিকই লিখেছিলেন, একেবারে অব্যর্থ কথা :
‘‘ভারতের হেঁদু-মোছলমান লড়ালড়ি শিখবে, শিবের গাজন…গরিবরাই ধ্বংস হবে। গরিব হল…ভগমানের চোখের জল।’’