পুরনো সেই উৎস
দেবতাদের কাছে মানুষের চাওয়ার তালিকায় প্রথমেই থাকে বিপদ থেকে রক্ষা করার আকুতি ‘ত্রাহি মাম’। বিপদ তাড়িয়ে যিনি আমাদের রক্ষা করেন সেই দেবী হলেন বিপত্তারিণী। এই দেবী হলেন দেবী দুর্গা বা কালী বা চণ্ডীকার আরেক রূপ। আসাম, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থানে নানা রূপে এই দেবীর মন্দির রয়েছে। কোথাও লেখা বিপত্তারিণী চণ্ডী বাড়ি, কোনও মন্দিরে লেখা বিপত্তারিণী কালী আবার বিপত্তারিণী দুর্গা মন্দিরও দেখা যায়। নাম আলাদা হলেও ইনি সেই আদ্যাশক্তি মহামায়ার এক রূপ, যে রূপে তিনি আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করেন। বিপত্তারিণী তন্ত্র দেবী পুরাণে বর্ণিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র যা বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এটি দেবী দুর্গার একটি রূপ, যা বিপদ থেকে মুক্তি এবং নিরাপত্তা প্রদানের জন্য পুজো করা হয়। এই দেবীর সাথে দেবী সংকটা বা সংকটতারিণী দেবী অভিন্ন।
আরও পড়ুন-ট্রেন্ট ব্রিজে আজ ভারত-ইংল্যান্ড
পুরাণকথা কিংবা ব্রতকথা
অনেক কাল আগে বিদর্ভ নগরে এক ন্যায়পরায়ণ রাজা ছিলেন। রানি হৈমবতীও ছিলেন যথেষ্ট ভক্তিমতি। রানির এক সখী ছিলেন মুচির বউ। মুচিরা তো মরা গরুর চামড়া দিয়ে জুতো বানায়। তাই রানি একদিন মুচি-বউয়ের কাছে গোমাংস দেখার জন্য আবদার করল! মুচি-বউ বিব্রতা তাই সখীকে বোঝায় বারবার, এটা অনুচিত কর্মের মধ্যে পড়ে। ধরা পড়লে দু’জনেরই রাজদণ্ড নিশ্চিত। রানি নিতান্তই অবুঝ তাই মুচি-বউ বাটি করে গোপনে গোমাংস এনে রানির ঘরে রাখে চাপা দিয়ে। দেখেই ফেলে দেবে একসময়। যথারীতি চিরকালের প্রথা গোপন রয় না কভু গোপনকথা। রাজার কানে পৌঁছয় রানির ঘরে রয়েছে নিষিদ্ধ বস্তু। রাজা আসছেন সরেজমিনে তদন্ত করতে। রানি আকুল হয়ে প্রার্থনা করেন মা দুর্গার। অজ্ঞানতাবশত কৃত এই পাপ হরণ করে সন্তুষ্ট হও দেবী, এই বিপদে তুমি রক্ষা করো মোরে, এটাই আমার প্রার্থনা। ভক্তের আকুল প্রার্থনায় গলে দেবী মায়ের মন। রাজা এসে বাটির ঢাকা খুলে দেখেন সেখানে রয়েছে লাল জবার ফুল। রাজা মিথ্যা সন্দেহ করার জন্য রানির কাছে ক্ষমা চান। দৈবী আশীর্বাদ পাওয়া রানি তখন রাজাকে খুলে বলেন সমস্ত ঘটনা। করজোড়ে মাফ চান রাজার কাছে। রাজা রানিকে বলেন— ঈশ্বর যাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, বিপদ থেকে উদ্ধার করে দিয়েছেন তার আর কোনও অপরাধ নেই। রাজা-রানি গলবস্ত্র হয়ে বারবার প্রণাম জানান সেই বিপত্তারিণী দুর্গাকে। পুজো করেন সাড়ম্বরে মহাশক্তির।
পুজোর খুঁটিনাটি
আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে রথ আর দশমীতে উল্টোরথ। এর মাঝে তৃতীয়া থেকে নবমীর মধ্যে মঙ্গলবার আর শনিবার হল বার্ষিক বিপত্তারিণী ব্রতের দুটি দিন। আরও সব ব্রতের মতো আগের দিন সংযম পালন। অর্থাৎ ব্রতী শুদ্ধাচারে নিরামিষ খাবেন, একবেলা ভাত, চোঁয়াপোড়া খাওয়া চলবে না। মানে মুড়ি, রুটি এসব মেনু লিস্টে থাকবে না। অর্থাৎ কষ্ট করো, কেসটা সলভ হবে।
পরের দিন স্নান সেরে আলপনা দেওয়া জায়গায় ঘট পাতা হবে। ঘটে মাঙ্গলিক আঁকার সাথে তেরোটা সিঁদুরের ফোঁটা আর সাথে থাকবে বিজোড় পাতা সোহ সহকার শাখা, উপরে সশীষ ডাব। বিপদতারিণীর সাথে তেরোর বড় বনিবনা। পশ্চিমে তেরোয় গেরো থাকলেও পুবের হাওয়ায় তেরোর জন্য নেই কোনও অপবাদ। তেরোটি পান-সুপারি, তেরো রকমের ফুল, তেরো রকমের ফল লাগবে পুজোয়। পুজোর সময় অবশ্যই থাকবে লালকারের তৈরি তেরোটি তাগা। গর্ভহীন তেরোটি দূর্বা একটি লাল কারে বাঁধা হবে। সেই গিঁটটি-সহ মোট তেরোটি গিঁট দিতে হবে লাল কারটিতে। এরকম আরও বারোটি তাগা বা বর্তমান হিন্দি-ঘেঁষা ভাষায় ‘ধাগা’ তৈরি হবে, সেগুলিতে অবশ্য দূর্বা থাকবে না। দূর্বা দেওয়া তাগা পুজো শেষে ব্রতী পরবে বাম হাতের কনুইয়ের উপরে। বাকি বারোটি তাগা পরিবারের ও প্রিয়জনদের হাতে বাঁধা হবে বিপদ কাটানোর উদ্দেশ্যে। পারলে একবছর, না পারলে অন্তত তিনদিন হাতে রাখতেই হবে এটি।
পুজো শেষে ব্রতী খাবে ঘিয়ে ভাজা তেরোটি লুচি, সুজি ইত্যাদি। সাধারণ লবণের বদলে ব্যবহৃত হবে সন্ধক লবণ। এর পরের দিন ব্রাহ্মণকে মিষ্টি-জল খাইয়ে, সিধে দিয়ে ব্রত সমাপন।
আরও পড়ুন-অফ মাদার্স অ্যান্ড সন্স
কী রূপে পূজিব তোমায়
দেবী বিপত্তারিণী যেহেতু মহাশক্তির এক বিশেষ রূপ তাই এঁর আলাদা কোনও রূপ-কল্পনা নেই। কোথাও কালী রূপে, কোথাও দুর্গা রূপে পুজো হয়।
‘ওঁ কালাভ্রাভাং কটাক্ষৈররিকুলভয়দাং মৌলীবন্ধেন্দুরেখাম্। শঙ্খং চক্রং কৃপাণং ত্রিশিখমপি করৈরুদ্বহন্তীং ত্রিনেত্রাম্। সিংহাস্কন্ধাধিরুঢ়াং ত্রিভুবনমখিলং তেজসা পুরয়ন্তীম্। ধ্যায়েদ্দুর্গাং জয়াখ্যাং ত্রিদশপরিবৃতাং সেবিতাং সিদ্ধসঙ্ঘৈঃ।’ এর অর্থ হল মেঘের ন্যায় বর্ণা, কটাক্ষ নিপাতে শত্রুকূলত্রাসিনী, কপালে চন্দ্রকলা শোভিতা, চার হস্তে শঙ্খ, চক্র, খড়্গ ও ত্রিশূলধারিণী, ত্রিনয়না, সিংহোপরি সংস্থিতা, সমগ্র ত্রিভুবন স্বীয় তেজে পূর্ণকারিণী, দেবগণ-পরিবৃতা। সিদ্ধসঙ্ঘসেবিতা জয়দুর্গার ধ্যান করি।
এই জয়দুর্গা বা কৌশিকীদেবী, বিপদতারিণী দুর্গা। পঞ্চদেবতার একজন। দেবীর অনেক রূপ দেখা যায়। কোথাও অষ্টাদশ রূপের ধ্যান ও পূজা হয়, কোথাও দশভুজা রূপে পূজা হয়, কোথাও আবার চতুর্ভুজা স্বর্ণবর্ণা আবার কোথাও কৃষ্ণবর্ণা রূপে পূজিতা হয়। জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে মঙ্গল ও শনিবারে মায়ের পূজা হয়। জয়দুর্গার বীজমন্ত্রে মাকে জাগানো হয়। ব্রতের সময় মূলত ঘটে পুজো হয়। শক্তি আরাধনা, তাই লালের আধিক্য বেশি। তেরোটি ফুল লাগলেও রক্তলাল জবা লাগে বেশি করে। পুজো করবেন ব্রাহ্মণ, বিপত্তারিণী পুজো যিনি মানত করে করছেন তিনি মূল ব্রতী, এরকম কয়েকজন ব্রতী একত্রভাবে পুজো উপকরণ করলে জোগাড়ের ভার লাঘব হয় অনেকটাই। পশ্চিমবঙ্গে, ওড়িশায় বেশ কিছু জায়গায় বিপত্তারিণী কালী বা দুর্গামূর্তিতে নিত্য পূজিত হন। মূল ভাব এক হলেও ব্রত আর পুজোয় ফারাক তার উৎসে।
ব্রত বনাম পুজো
এককালের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ যখন পুরুষতন্ত্রের কাছে মাথা হেঁট করেছে তখন থেকে ঘোমটার আড়ালে মেয়েরা বন্দি ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে। বেদপাঠে, শিক্ষায় হারিয়েছে অধিকার। ঋষিদের মতো এ-জাত যদি ধ্যানে বসে পরমাত্মার তত্ত্ব কপচায় আর শিক্ষার আলোতে মনের অন্ধকার দূর করার হদিশ পায় তাহলে ঘরের কাজগুলো করবে কে আর পেটের জোগান দেবেই বা কে! আবার ঈশ্বর সাধনার অধিকারও পুরোপুরি কেড়ে নেওয়া যায় না। ধর্ম সমাজেও এসেছে বদল। অনন্ত নিরাকার পরমব্রহ্ম মূর্তিতে হয়েছেন শান্ত। এসময় গৃহবন্দিদের জন্য রইল ঘরের মধ্যেই হঠাৎ পুজো, তার নাম ব্রত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্জনে ধ্যান, জপ, তন্মনস্কৌ সমাধিতৌ হতে লাগে না। একদিন একবেলা ছুটি দিলেই এদের হয়। পরের দিন যাকে তাই জীবন। আর অনেকাংশেই বেঁচে যাওয়া, এঁটোকাটা খাওয়া পরগাছা হয়ে যাওয়া জীবনগুলো ব্রতর নামে একটু অন্যরকম আনন্দ, মুখপালটানো খাবার পাবে এটাই তাদের খুশি। ভক্তিমার্গে সিদ্ধিলাভটা ঈশ্বর দয়া করেই এদের জন্য রেখে দিয়েছিল বোধহয়। তাই বেশিরভাগ ব্রত মহিলাদের জন্য বরাদ্দ। সময়ের বদলে মনে আবার এসেছে চেতনার আলো। সমাজেও এসেছে খানিক বদল। ব্রত কর্মের আসল উদ্দেশ্য ঢাকা পড়ে গিয়ে তারা আবার পুজোর সাথে মিশেছেন অনেকাংশেই। সেজন্যই অকারণ হয়ে যাওয়ায় হারিয়ে গেছে অনেক মেয়েব্রত। বিপদের থেকে বাঁচার এবং পরিবারকে রক্ষা করার আকুলতা থেকে টিকে গেছে বিপত্তারিণী ব্রত, মিশে গেছে বিপত্তারিণী পুজোয়।
আরও পড়ুন-অফ মাদার্স অ্যান্ড সন্স
একালের বিপত্তারিণী পুজো
এখন মহিলারা অনেকাংশেই স্বয়ং নিয়ন্ত্রিত। তারা যেকোনও জায়গায়, যেকোনও কাজে পুরুষের সাথে কাঁধ মিলিয়ে চলে। তাই তাঁদের উপাসনা কোন মার্গে চলবে তারাই ঠিক করে নেন। আসর পেতে ব্রতের দিন গেছে। স্থানীয় যেকোনও দুর্গা বা কালী মন্দিরে ঠাকুরমশাইরা করেন সব জোগাড়, সাজান ডালা। বাড়ির মেয়েরা নির্দিষ্ট মুল্যের বিনিময়ে ডালা নিয়ে যান পাশের কোনও দেবী মন্দিরে। তারপর সেখানে চলতে থাকে দিনভর পর পর পুজো। কোনও ঠাকুরমশাই পড়েন ব্রতকথা, সবাই শোনে জোড়হাত করে। ব্রত তার কারণ হারিয়ে মিশে যায় পুজোয়, পুজো হয় উৎসবে রঙিন। জ্যোমাটো, সুইগি— এইসব খাবারের প্যাকেজ এখনও চালু করেনি, তাই ঘরেই বানানো হয় খাবার। ছোট পরিবারের ছোট রান্নাঘরে। অনেকে পুরনো বিধানকে খানিকটা নিজের মতো করে নেন। বানভাসি আধুনিকতার জোয়ারে এটুকু বজায় আছে এই ঢের। আর পরিবর্তনই তো সজীবের বৈশিষ্ট্য।
এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
সমুদ্রমন্থনকালে বিষের দায়িত্ব নিয়ে বিশ্ব রক্ষা করেছিলেন বিশ্বেশ্বর। বিষের জ্বালায় শিব হয়েছিল নীলকণ্ঠ। জায়াকে জননী করে থামিয়েছিল বিষজ্বালা। শিবের বিপদ কাটিয়ে দেবী হলেন বিপদতারিণী। রামের রাবণবধের আগে অকালবোধন, কালীয় নাগের বিষহরণের জন্য মা যশোদার দুর্গাস্তব কিংবা সিংহলের ঘাটে শ্রীমন্ত সওদাগরের চণ্ডী আরাধনার পর কমলেকামিনী দর্শন— সবেতেই রয়েছে বিপদ-মুক্তির গল্প। তাই বিপদ তাড়িয়ে কালক্রমে মহামায়া আদ্যাশক্তি হলেন বিপদতারিণী। রথ তো দেহের রূপক, উল্টোরথ ফেরার ইঙ্গিত। জন্ম আর মৃত্যুর মাঝের সময় মানবলীলা। বিপদ কাটানোর প্রার্থনা তো চলবে জীবন জুড়েই। তাই রথ আর উল্টোরথের মাঝেই বিপত্তারিণী পুজো।
মানুষের প্রার্থনা, ঠাকুরের প্রার্থনা
মানুষ বিপদে পড়ে ঠাকুরকে ডাকে। বিপদ না হওয়ার জন্য ঠাকুরকে ডাকে। সংস্কৃতে বলে ‘ত্রাহি মাম’, মন্ত্রে বলে ‘শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি’, মনের গভীরে বলে বিপদে মোরে রক্ষা করো। কখনও কোনও বিশেষ মানুষ বিপদে পড়ার আগেই বলে রাখেন, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়/ দুঃখে তাপে ব্যথিত চিতে নাইবা দিলে সান্ত্বনা, দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।’ বিপদতারিণীকে সবাই ডাকেন। যাঁরা পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য ডাকেন তাঁরা মানুষ আর যাঁরা ‘আপনা মাঝে শক্তি’ ধরার জন্য ডাকেন তাঁরা মানুষ থেকেই ঠাকুর হয়ে ওঠেন।
জয় বিপদতারিণী মা, সকলকে বিপদ থেকে মুক্ত করে দাও। কিন্তু বিপদকে মুক্তি দিও না। কারণ বিপদ আছে বলেই তোমার প্রয়োজন আছে।