শারদোৎসব সবে শেষ হয়েছে। তার রেশ কাটতে না কাটতে দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছে আলোর উৎসব দীপাবলি, কালীপুজো। এই দিনে অনেকের বাড়িতে অলক্ষ্মী বিদায় করে পুজো হয় মা লক্ষ্মীরও। আর এই সময়ের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল ধনতেরাস বা ধন ত্রয়োদশী। দীপাবলির কথা বললে অবশ্যই করে এসে যায় ধনতেরাসের কথা। পাঁচদিন ব্যাপী দীপাবলি উৎসবের প্রথম দিনটাই হল ধনতেরাস। এটি কিন্তু আগে এই বঙ্গে ছিল না। মূলত অবাঙালিদেরই উৎসব ধনতেরাস। আর কতিপয় উচ্চবিত্ত বাঙালি এই দিনে সোনা কিনতেন। এইদিন সোনা দানা, রুপো কিনলে সম্পদে, সমৃদ্ধি বাড়ে এমনটাই বলা হয় কিন্তু এটা জানতেন না অনেকেই। দিব্যি তো চলত বছর। এখন এইদিনে মানুষের মধ্যে পড়ে যায় সোনা রুপো নিদেনপক্ষে বাসনকোসন, ঝাঁটা কেনার ধুম।
আরও পড়ুন-ভুয়ো বোমার হুমকি নিয়ে কেন্দ্রের সতর্কতা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিকে
কেন এমন বিশ্বাস?
ধনতেরাস যার আর এক নাম ধন ত্রয়োদশী। আবার একে ধন্বন্তরী ত্রয়োদশীও বলা হয়। ‘ধন’ শব্দের অর্থ সম্পদ আর ‘তেরাস’ শব্দের অর্থ ত্রয়োদশী, কৃষ্ণপক্ষের তেরোতম দিন। কার্তিক মাসের ত্রয়োদশীতে এই উৎসব পালিত হয়। হিন্দুমতে ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী। তাই এই দিন মা লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। পাশাপাশি কুবের ও গণেশের পুজোও দেখা যায়। ধনতেরাসের দিন মানুষ সোনা, রুপো কিংবা মূল্যবান ধাতু কেনেন। মানুষের বিশ্বাস এদিন এসব কিনলে সংসারের শ্রীবৃদ্ধি হয়।
কোথা থেকে এই বিশ্বাসের উৎপত্তি?
কথিত আছে, প্রাচীন কালে হিমা নামে এক রাজা ছিল। তার ছেলের ওপর অভিশাপ ছিল বিয়ের চতুর্থদিন সাপের কামড়ে মারা যাবে। ষোলো বছর বয়সে ছেলের বিয়ে দেন রাজা হিমা। নববধূ স্থির করে স্বামীকে অকালমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবে। সেই মতো নির্দিষ্ট রাতে নিজের সমস্ত সোনা-রুপোর অলঙ্কার ঘরের দরজার সামনে স্তূপ করে রেখে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয় আর গানে গল্পে স্বামীকে সারারাত জাগিয়ে রাখে। মৃত্যুর দেবতা যম সাপের ছদ্মবেশে সেখানে আসেন। কিন্তু প্রদীপের আলোয় সোনা-রুপোর অলঙ্কারের যে তীব্র ঝলকানি, তাতে তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ঘরের দরজা খুঁজে পায় না। সারারাত চেষ্টা করেও নিজের কার্যসিদ্ধি করতে পারেন না তিনি। সকাল হতে যমরাজ চলে যান এবং রাজপুত্রের জীবন রক্ষা পায়। দিনটি ছিল কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীর দিন। সেই থেকে এই দিন সোনা, রুপো কেনা মঙ্গলজনক বলে মানুষ মনে করে। এদিন রাতে ঘরের দক্ষিণ দিকে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার রীতি দেখা যায়। মানুষের বিশ্বাস, এদিন বাড়ির দক্ষিণে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলে অকালমৃত্যু রোধ হয়, মানুষ দীর্ঘ জীবন লাভ করে।
আরও পড়ুন-ঘরের মাঠে শুরু হল পাওয়ার-প্লে, মহারাষ্ট্রের ভোটে সম্মানরক্ষার লড়াই
নানা লোককথা
ধনতেরাস উৎসবে দেবী লক্ষ্মীর সরাসরি যোগ নিয়ে একাধিক কাহিনি রয়েছে। কোনও একসময় বিষ্ণুর অভিশাপে লক্ষ্মীকে বারো বছর মর্ত্যে এক কৃষকের পরিবারে কাটাতে হয়। যতদিন তিনি কৃষকের ঘরে ছিলেন বেশ সচ্ছল ছিল তার পরিবার। বারো বছর পর বিষ্ণু লক্ষ্মীকে নিয়ে যেতে এলে কৃষক তাকে ছাড়তে চায় না। তখন লক্ষ্মী কৃষককে বলেন ধনতেরাসের দিন ঘরদোর পরিষ্কার করে একটি রুপোর ঘটে টাকা রেখে তাঁর আরাধনা করতে। তা হলে তিনি তার ঘরে অবস্থান করবেন। অনেকের বিশ্বাস, এখান থেকেই ধনতেরাসের দিন লক্ষ্মীপুজোর পাশাপাশি মূল্যবান ধাতু কেনার রীতি চালু হয়েছে।
অন্য একটি কাহিনিতে দেখা যায়, এক সময় দুর্বাসা মুনির অভিশাপে স্বর্গ লক্ষ্মীহীন হয়ে পড়ে এবং তিনি সমুদ্রে আশ্রয় নেন। স্বর্গের শ্রী ফিরিয়ে আনতে শিবের পরামর্শে দেবতারা অসুরদের সঙ্গে মিলে সমুদ্র মন্থন করেন। কোনওমতে সমুদ্রমন্থনে অমৃতের কলস নিয়ে এই ত্রয়োদশীর দিন সমুদ্র থেকে লক্ষ্মী উঠে আসেন। লক্ষ্মীলাভের দিনটিকে তাই ধন ত্রয়োদশী বা ধনতেরাস হিসেবে পালিত হয়।
ধন্বন্তরী ত্রয়োদশী
প্রকৃতপক্ষে ধনতেরাস হল ধন্বন্তরী ত্রয়োদশী। এই দিনের সঙ্গে যার নাম জড়িয়ে তিনি হলেন দেব বৈদ্য ধন্বন্তরী, হিন্দু বিশ্বাসে যাকে বিষ্ণুর এক অবতার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একসময় দেবতা ও অসুরদের যুদ্ধে দেবতারা পর্যুদস্ত হয়ে পড়েন। কিছুতেই তারা অসুরদের পরাস্ত করতে পারছিলেন না। কেননা অসুরদের গুরু শুক্রাচার্য মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্র জানতেন। ফলে দেবতারা অসুরদের বধ করলেও তিনি তাদের প্রাণ ফিরিয়ে দিতেন। বিধ্বস্ত দেবতারা পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। তিনি তাদের সমুদ্রমন্থন করে অমৃত লাভ করার পরামর্শ দেন।
ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, মৎস্যপুরাণ প্রভৃতিতে আমরা দেখি দেবতা ও দানবেরা মিলে সমুদ্রমন্থন করেছিলেন। এই সমুদ্রমন্থনে উঠে আসে অনেক কিছু। তবে যার জন্য এই সমুদ্রমন্থন সেই অমৃতের কলস নিয়ে ওঠেন দেব বৈদ্য ধন্বন্তরী। ত্রয়োদশীর দিন তিনি উঠে এসেছিলেন। তাই এই দিনটি ধন্বন্তরী ত্রয়োদশী হিসেবে পালিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হল সুস্বাস্থ্য, নীরোগ ও দীর্ঘায়ু জীবন লাভ।
আরও পড়ুন-পূর্ব লাদাখ থেকে সেনা সরানো শুরু করে দিল ভারত ও চিন
সেকাল-একালে ধনতেরাস
যেভাবেই হোক না কেন, ধনতেরাসের সঙ্গে কেনাকাটার ব্যাপারটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। পূর্বে অবাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এই উৎসব। মূলত মাড়োয়াড়ি ও গুজরাটিরা এই দিন সোনা, রুপো কিনতেন। সোনা-রুপো কেবল শ্রী বৃদ্ধিই করে না, বিপদ-আপদেও এটি রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। পাশাপাশি মূল্যবান ধাতু ও বাসনপত্র কেনার রীতি ছিল।
বর্তমানে বাঙালিরাও এই উৎসবকে নিজেদের করে নিয়েছে। এই দিনটির ক্রেজ মারাত্মক। যে গৃহিণী সারাবছর কিচ্ছুটি কেনেন না তিনিই বাড়ির কত্তাকে নিয়ে গয়নার দোকানে হাজির হয়ে যান। বেশ বড়সড় গয়নায় ইনভেস্ট করেন আগামীর শান্তি, সুখ, সমৃদ্ধির কামনায়। বিয়ের কনেরা এই দিনটায় নিজের বিয়ের গয়নাও কেনেন। সামর্থ্য অনুযায়ী সোনা, রুপোর অলঙ্কার থেকে লক্ষ্মী, গণেশের মূর্তি, পিতল, কাঁসা, স্টিলের বাসনকোসন প্রত্যেকেই। যাঁদের তাও কেনার সামর্থ্য নেই, তাঁদের জন্যও রয়েছে শ্রীবৃদ্ধির হরেক সামগ্রী, যেমন কড়ি, গোমতী চক্র, ধান, লবণ প্রভৃতি। এগুলো কেনাও নাকি সৌভাগ্যজনক বলে মনে করা হয়। ধনতেরাসে ইদানীং বাড়ি বাড়ি ঝাঁটা কেনার হিড়িক। বিষয়টা দেখতে একটু হাস্যকর লাগলেও কারণটা সুগভীর। মৎস্যপুরাণ মতে, ঝাঁটায় লক্ষ্মীর বাস। ঝাঁটা কিনলে নাকি ঘরে লক্ষ্মীর আগমন হয়। এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাবনাচিন্তার বদলের পাশাপাশি কেনাকাটার ক্ষেত্রটাও বেড়েছে। ধনতেরাসকে কেন্দ্র করে বাযবসায় রমরমা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী কেনায় থাকছে আকর্ষণীয় অফার। টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, মোবাইল, ল্যাপটপ প্রভৃতি কেনার হিড়িক দেখা যায়। কেনাকাটার ক্ষেত্রে আজকাল ঘর সাজানোর জিনিস থেকে পোশাক-আশাকও সংযোজিত হয়েছে। অনেকে এই এদিন জায়গা-জমি কেনেন। বিমা কিংবা শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে অনেকে এই দিনটিকে বেছে নেন। এককথায় ধনতেরাস দিনটি এখন যেন কেনাকাটার একটি বিশেষ দিন হয়ে গেছে। এইদিন কেনাকাটা করার জন্য মানুষ আগে থেকে নানান পরিকল্পনা করে রাখে। সুখ, সমৃদ্ধির পাশাপাশি লক্ষ্মীলাভের দিন হয়ে গেছে ধনতেরাস। তাই যত দিন গড়াচ্ছে বাড়ছে এই দিনটির আকর্ষণ।
আরও পড়ুন-যুব দলের পরীক্ষা, সাফে মেয়েদেরও
ধনতেরাসের সঙ্গে সত্যি সত্যি কি কেনাকাটার কোনও সম্পর্ক আছে?
ধনতেরাসের সঙ্গে মূলত স্বাস্থ্যের যোগ। সমুদ্রমন্থনে ধন্বন্তরী দেব অমৃতের কলস নিয়ে উঠেছিলেন। এই অমৃত ঔষধির প্রতীক। শুক্রাচার্যের মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্র সম্ভবত এমন কোনও ভেষজ ঔষধ যা দিয়ে তিনি মৃতপ্রায় অসুরদেরও সারিয়ে ফেলতে পারতেন। অসুরদের টক্কর দিতে দেবতাদের প্রয়োজন ছিল শুক্রাচার্যের মতো আয়ুর্বেদ শাস্ত্র জানা কোনও ব্যক্তি। ধন্বন্তরীর ‘অমৃত’ সেই হিসেবে আরও উন্নত কোনও ভেষজ ঔষধ যা মরণাপন্ন দেবতাদের প্রাণরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। সেকারণেই একে অমৃতের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সোজা কথায়, একজন ভাল ভেষজ চিকিৎসক। সে কারণেই বিষ্ণু তাঁকে দেবতাদের বৈদ্য হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। প্রাচীন ভারতের অন্যতম আয়ুর্বেদ শাস্ত্র হল সুশ্রুত সংহিতা। কথিত আছে, ধন্বন্তরি সুশ্রুতকে আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত যে শিক্ষা দিয়েছিলেন তা লিপিবদ্ধ আছে এই গ্রন্থে। দক্ষিণ ভারতে ধনতেরাসের দিন ধন্বন্তরী দেবের যে মূর্তির আরাধনা করা হয় দেখা যায় তার এক হাতে থাকে লতাগুল্ম যা ভেষজ বা আয়ুর্বেদ চিকিৎসা নির্দেশ করে। সবকিছু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ধন্বন্তরীর নাম আয়ুর্বেদ চিকিৎসা শাস্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। তাঁকে ‘আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের জনক’ বলা হয়। ভারতবর্ষের আয়ুষ মন্ত্রক ধনতেরাসের এই দিনটিকে জাতীয় আয়ুর্বেদ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ধনতেরাস তাই ধন-সম্পদের প্রাপ্তির উৎসব নয়; সুস্বাস্থ্য, নীরোগ শরীর ও দীর্ঘায়ু লাভের জন্য আরাধনা।
কথায় আছে স্বাস্থ্যই সম্পদ। আমাদের যত ধন-সম্পদ থাক না কেন, শরীর যদি না ভাল থাকে তাহলে সম্পদ সুখ বৃথা। একমাত্র সুস্থ শরীর মানুষকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী জীবন দিতে পারে। তাই সুস্বাস্থ্যের থেকে বড়ো কোনও সম্পদ হতে পারে না। সময়ের অগ্রগতিতে মানুষের মনে কোনোভাবে সম্পদ শব্দটাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। হারিয়ে গেছে তার মধ্যে নিহিত স্বাস্থ্য শব্দটি। আর ধনতেরাসের সঙ্গে যেহেতু ‘ধন’ শব্দটি জড়িয়ে আছে মানুষের মাথায় সম্পদ বলতে সোনা, রূপা প্রভৃতি মূল্যবান ধাতুর ব্যাপারটা বেশি স্থান পেয়েছে। হয়তো সেকারণেই এই দিন ধন-সম্পদ কেনার রীতি ধীরে ধীরে চালু হয়।
পরিশেষে বলার, আয়ুর্বেদ চিকিৎসার জন্ম এই ভারতবর্ষে। এই চিকিৎসা ব্যবস্থার জনক হিসেবে জড়িয়ে যার নাম তিনি হলেন ধন্বন্তরী। ধনতেরাস কিংবা ধন্বন্তরী ত্রয়োদশী হল তাঁর আবির্ভাব তিথিকে স্মরণ করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো। এই দিনটির প্রকৃত তাৎপর্য মাথায় রেখে মানুষকে পার্থিব সম্পদের পরিবর্তে বেশি করে নজর দিতে হবে স্বাস্থ্যের ব্যাপারে। সেটাই তাদের সত্যিকারের সম্পদশালী করে তুলবে। কথায় আছে লক্ষ্মী চঞ্চলা। ধনসম্পদ আজ আছে কাল নাও থাকতে পারে কিন্তু সুস্বাস্থ্য লাভ করলে ধনসম্পদে বিত্তশালী না হয়েও মানুষ সুখী ও সমৃদ্ধশালী জীবন কাটাতে পারবে।