গ্লুকোমা

দৃষ্টিহীনতা এক অভিশাপ। সারা পৃথিবীতে অন্ধত্বের অন্যতম কারণ হল গ্লুকোমা (Glaucoma)। চিকিৎসকেরা এর নামকরণ করেছেন 'সাইলেন্ট থিফ’ (Silent thief)। কারণ গ্লুকোমা সহজে ধরা পড়ে না। ফলে হয়ে ওঠে বিপজ্জনক। প্রতিবছর জানুয়ারিতে পালিত হয় গ্লুকোমা সচেতনতা মাস। কেন হয় গ্লুকোমা? এর প্রতিরোধই বা কী? লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

দৃষ্টিহীনদের চেয়ে হতভাগ্য বোধহয় আর কেউ নেই। এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। দৃষ্টিশক্তি হ্রাস এবং অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ হল গ্লুকোমা। আট থেকে আশি, যে কোনও বয়সেই থাবা বসাতে পারে গ্লুকোমা। চিকিৎসকেরা গ্লুকোমাকে ‘সাইলেন্ট থিফ’ বা নীরব দৃষ্টিচোর বলে আখ্যা দিয়েছেন। সারা বিশ্বে দৃষ্টিহীনতার দ্বিতীয় প্রধান কারণ হল গ্লুকোমা। প্রায় ৮০ কোটি মানুষ অন্ধত্বের শিকার যার মধ্যে গ্লুকোমার কারণে স্থায়ীভাবে অন্ধত্বের শিকার হয়েছেন ১২ কোটির ওপর মানুষ। যাঁর এক বিরাট অংশ রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। এই রোগে মূলত চোখের অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তা নষ্ট হয়ে যায়। চোখের মধ্যে যে অংশ দিয়ে তরল চলাচল করে, সেই রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে তা জমতে শুরু করে। এই তরল চোখে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে— বিশেষ করে অপটিক নার্ভে চাপটা বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণতর হতে থাকে, পরবর্তী কালে যা অন্ধত্ব ডেকে আনে। প্রাথমিক ভাবে ক্ষতিটা শুরু হয় পরিধির চারপাশ থেকে, তাই গ্লুকোমায় আক্রান্ত রোগীদের ‘সাইড ভিশন’ নষ্ট হতে থাকে। চোখের ভিতর জল তৈরি হতে থাকে, অথচ বেরোনোর জায়গা পায় না— এর ফলেই দুর্বল জায়গাগুলিতে চাপ সৃষ্টি হয়। যদি কেউ বলেন তিনি পাশের দিকে দেখতে পাচ্ছেন না, তা হলে বুঝতে হবে অনেকটাই ক্ষতি হয়েছে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। চোখের অপটিক নার্ভ বা স্নায়ু চোখের সঙ্গে মস্তিষ্কের যোগাযোগের মাধ্যম। আমরা যা দেখতে পাই, তার রেসপন্স মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয় এই অপটিক নার্ভ। যেমন হাইপ্রেশারের সমস্যা যাঁদের রয়েছে, তাঁদের এই স্নায়ুগুলি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। তাঁদের গ্লুকোমা হয়। তবে প্রেশার স্বাভাবিক থাকলেও গ্লুকোমা হতে পারে।
পরিবারে কেউ গ্লুকোমায় আক্রান্ত হলে অন্যদেরও জিনের স্ক্রিনিং জরুরি। যে কোনও জিনগত রোগ বোঝা সম্ভব একমাত্র জেনেটিক স্ক্রিনিংয়ে।

আরও পড়ুন-অক্রিকেটীয় আচরণ, কোহলিকে খোঁচা সানির

গ্লুকোমার লক্ষণ
দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে যাওয়া।
চোখ থেকে অত্যধিক জল-পড়া। চোখ লাল হয়ে যাওয়া।
আলোর দিকে তাকালে চোখে ভীষণ ব্যথা হওয়া। উজ্জ্বল কিংবা কম আলোয় দেখতে অসুবিধে হওয়া।
চোখের পাতা এঁটে যাওয়া, চোখ খুলতে না পারা।
আলোর চারপাশে বিভিন্ন রং দেখতে পাওয়া। চোখ, মাথা ও কপালব্যথা। চোখ ফোলা। বমি বমি ভাব।
দীর্ঘদিন কোনও স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলে, চোখে কোনও আঘাত পেয়ে থাকলে গ্লুকোমা হতে পারে।
ডায়াবিটিস থাকলে গ্লুকোমায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে।
চোখের পাওয়ার সেট করে দেওয়ার পরে সাধারণত আর এক-দেড় বছরের মধ্যে তা বাড়ার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু যদি কয়েক মাস পর দেখা যায় অসুবিধে হচ্ছে, কিংবা ঘন ঘন পাওয়ার বেড়ে যাচ্ছে, তা হলে তা গ্লুকোমা থেকেও হতে পারে।
তবে সব রোগীরই যে একই ধরনের লক্ষণ দেখা যাবে, তা কিন্তু নয়। এই উপসর্গ মানেই গ্লুকোমা— এমনটা নাও হতে পারে। তাই আতঙ্কিত হবেন না। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রাথমিক অবস্থায় গ্লুকোমার চিকিৎসা শুরু করলে অন্ধত্বের ঝুঁকি কমে যায়। অনেক ক্ষেত্রে কেবল ওষুধের মাধ্যমেই চিকিৎসা সম্ভব হয়।

আরও পড়ুন-সুপ্রিম কোর্টে পিছিয়ে গেল তিন গুরুত্বপূর্ণ মামলা

রিস্ক ফ্যাক্টর
গ্লুকোমার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হল বংশগত। অর্থাৎ পরিবারে কারও এই রোগ থাকলে অন্যদেরও হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
পরিবারে কারও ডায়াবিটিস কিংবা উচ্চরক্তচাপ বা নিজের থাকলেও থাকলে গ্লুকোমার আশঙ্কা বাড়তে পারে।
যাঁরা নিয়মিত স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ নেন, তাঁদেরও গ্লুকোমায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে।
যাঁরা ইনহেলার নেন তাঁদের ক্ষেত্রেও গ্লুকোমায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা প্রবল।
কোনও সময়ে চোখে গুরুতর চোট-আঘাত লাগলে, পরবর্তী কালে সেখান থেকেও গ্লুকোমা হওয়ার আশঙ্কা।
খুব বেশি মাইনাস পাওয়ার থাকলে গ্লুকোমা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
থাইরয়েড এবং মাইগ্রেন খুব বেশি থাকলে এই রোগের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
ধরন
গ্লুকোমার দুটো ধরন রয়েছে। একটি হল ওপেন-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা, যা ধীরে ধীরে ছড়ায়। অন্যটি হল অ্যাঙ্গেল-ক্লোজার গ্লুকোমা, যা দ্রুত ছড়ায়। ওপেন অ্যাঙ্গেল হলে বুঝতে হবে চোখের ভিতরে অ্যাকুয়াস হিউমরের চাপ বেড়েছে, কিন্তু তরল বেরোনোর পথ খোলা আছে ওটা জমে যায়নি। ক্লোজ়ড অ্যাঙ্গেলের ক্ষেত্রে এই পথটি বন্ধ হয়ে যায়। চোখে অনেক সময়ে ব্যথা হয়, লাল হয় ও ঘন ঘন চশমার পাওয়ার বদলাতে হয়। ভারতীয় ও দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে অ্যাঙ্গেল-ক্লোজার গ্লুকোমা হওয়ার ঝুঁকি বেশি, যা অন্ধত্বের কারণ।
তবে এর একটা ভাল দিক রয়েছে, তা হল— গ্লুকোমার চিকিৎসা আছে। লেজার-চিকিৎসা গ্লুকোমার অগ্রগতি প্রতিরোধ করতে পারে। অন্যদিকে, ওপেন-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমার রোগীদের আজীবন চিকিৎসাধীন থাকতে হয়। শেষ অবস্থায় গ্লুকোমার সার্জারি করাতেই হয়।

আরও পড়ুন-ফের দুয়ারে বাঘ, নজরে মৈপীঠ থেকে বরাবাজার

চক্ষু পরীক্ষা
নিয়মিত চোখ পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই শনাক্ত করা যায় গ্লুকোমা। তবে অনেকেই তা করেন না। বিশেষ করে ৪০ বছরের বেশি বয়সিদের জন্য বছরে অন্তত একবার চোখ পরীক্ষা করানো জরুরি বলে পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। পরিবারে গ্লুকোমার ইতিহাস থাকলে সেক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতে হবে।
গ্লুকোমা প্রতিরোধে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। স্টেরয়েড আই ড্রপ ব্যবহারের বিষয়ে সচেতন থাকুন। কারণ এই ধরনের আই ড্রপ চোখের জন্য একেবারেই ভাল নয়।
রোগটি যত আগে ধরা পড়ে, তত দ্রুত ক্ষতি আটকানো সম্ভব। যতটুকু দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়েছে, তা আর ফেরত আসে না, কিন্তু অবশিষ্ট দৃষ্টিশক্তি সুরক্ষিত রাখা যেতে পারে।

Latest article