সে যতই কালো হোক

কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ থাকলেও তার কদর আজও খানিক কমই। কিন্তু বাংলার মেয়ে, বাংলার মা কালী যত কালোই হন না কেন তিনি বিপুল ভোটে জয়ী। তিনি আমাদের ঘরের মেয়ে। এখানেই মা কালীর মাহাত্ম্য, তাঁর ম্যাজিক। লিখলেন চৈতালী সিনহা

Must read

বাঙালির প্রিয় দেবতা নির্বাচনে যদি ভোট নেওয়া যায় তাহলে কালী বিপুল ভোটে জয়ী হবেন একথা নিশ্চিত। বাংলার এমন কোনও পাড়া খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে কালী মন্দির নেই। কালী আপামর জনতার কাছের দেবতা। ইদানীং অবাঙালি প্রভাবে শিব, কৃষ্ণ এবং বজরংবলি নিয়ে বাঙালি বিশেষ বিশেষ দিনে খানিক মাতামাতি করলেও নিত্যদিনের লালন, পালন, রক্ষণে কালী ভরসা। দুর্গা বিশাল বাণিজ্যের, লক্ষ্মী স্বার্থে, সরস্বতী দায়ে আর মনসা ভয়ে পুজো পান। জগদ্ধাত্রী সাময়িক আর কিছুটা স্থানিক। সারা বছর একইভাবে পুজো পেয়ে কালী কিন্তু জনপ্রিয়তায় প্রথম হচ্ছেনই। ক’দিনের জন্য বাপেরবাড়ি আসা দুর্গাকে ঘিরে উন্মাদনা অবশ্যই অনেক বেশি কারণ দুর্গাকে কেন্দ্র করে একাধিক ব্যবসা শৃঙ্খলের আকারে জড়িয়ে। কালী আমাদের ঘরের মেয়ে, আছে সব কাজেই, কিন্তু তাকে নিয়ে দেখনদারি কম। কালী ঘিরে নানা রহস্য, নানা গল্পকথা। দশমহাবিদ্যার প্রথম রূপ কালী। এই দশমহাবিদ্যা আসলে কী, সেটা নিয়েও নানা আখ্যান। সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটা সতী আর শিবের। সতীর পিতা দক্ষ রাজা আয়োজন করেছেন এক যজ্ঞের, সেখানে শিবের-সতীর নিমন্ত্রণ নেই। শিবের ইচ্ছা নয় যে সতী বিনা নিমন্ত্রণে সেখানে যান। নাছোড়বান্দা সতী, বলেন কারও সাধ্য কী আমাকে সেখানে কেউ কোনওরকম অপমান করে! এই বলে তিনি তাঁর নিজ দশমহাবিদ্যা নামে বহুরূপে শিবের কাছে আত্মপ্রকাশ করলেন। দশমহাবিদ্যা হলেন দেবী কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামুখী, মাতঙ্গী ও কমলা। ভীত শিব অনুমতি দিলেন যাওয়ার।

আরও পড়ুন-বিজেপি রাজ্যে বেআইনি খনির প্রতিবাদ দলিত যুবককে মারধর, মুখে প্রস্রাব

তারপর তো চেনা ইতিহাস! এই গল্পে দুর্গার এক রূপ কালী। এরপর শ্রীশ্রী চণ্ডীকথায় কালীর আবির্ভাবের অন্য গল্প। দেবী চণ্ডী শুম্ভ-নিশুম্ভ নামক দুই দুর্দান্ত অসুর বধ করতে রণে নেমেছেন। মহিষাসুরের সেনাগুলিও কম যায় না। এল ধূম্রলোচন, চণ্ডী, মুণ্ড দেবী তাদের বধ করলেন নানা কৌশলে। এবার এল মারাত্মক এক অসুর— রক্তবীজ। তার শরীরের একফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়ল জন্ম নেয় হাজার হাজার রক্তবীজ। সকল দেবতা রূপের স্ত্রী শক্তিরা এলেন যুদ্ধে— ব্রহ্মার রূপে ব্রহ্মাণী, ইন্দ্রের রূপে ঐন্দ্রী ইত্যাদি। কিন্তু ওই রক্তবীজকে মারে কে! তখন শ্রীচণ্ডিকার ললাট থেকে বেরোলেন দেবী কালী। করালবদনা, হাতে অসি, পাশ। গলায় নরমালা, বাঘের চামড়া পরে, শুষ্ক কঙ্কালসার দেহ। যত রক্তবীজ বধ হয় কালী বিরাট হাঁ করে সেই রক্ত খেয়ে ফেলেন। সঙ্গে শিবাকুল অর্থাৎ শৃগালের দল। এবার না পড়ল মাটিতে রক্ত না বাড়ল রক্তবীজের ঝাড়। বিজ্ঞানীরা বলেন এক একক বিন্দু থেকে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি। সেই অনন্তঘন এক একক বিন্দু পয়েন্ট অফ সিংগুলারিটি। বেদান্তের মতে জগৎ সৃষ্টি করেছেন ব্রহ্ম নামক কোনও এক অস্তিত্ব যিনি না নারী, না পুরুষ; না কালো না ধলো ; না সজীব না নির্জীব; না দৃশ্য না অদৃশ্য— এই রকম কিছু যা সাধারণের বোধের অতীত। শাক্তের মতে সেই একক বিন্দু কালকে কলন করেন তাই তিনি কালী— বিশ্ব প্রসবিনী। মাতৃজ্ঞানে সাধকের সাধনা সম্পূর্ণ হয় দ্রুত, মাতৃকল্পনায় চিন্তায় আসে পূর্ণতা। সেই অসীম শক্তি মাতৃকল্পনায় ধরা দিয়ে হলেন কালী। তমসা বা ব্ল্যাক হোল থেকে সৃষ্টি হল প্রাণ তাই সেই সৃষ্টি বিন্দু কালো তাই কালী কালো। নিশাবসানে সূর্যোদয়ের মুহূর্ত যেন কালীর পায়ে রক্তজবাটি। সৃষ্টি মুহূর্তে সব কিছু অকৃত্রিম, আবরণমুক্ত— তাই কালীও বিবসনা। জন্মের চেয়ে বড় কর্ম— তাই মা কালীর কোমর ঘিরে হাতের মালা… জন্মস্থানের লজ্জা ঢাকবে হাতের কর্ম। নবরাত্রি শুরু হয় প্রতিপদে দেবী শৈলপুত্রী আরাধনায়, শেষ হয় নবমীতে সিদ্ধিদাত্রী আরাধনায়। সপ্তমীর দেবী কালরাত্রি। রাতে মানুষ আশ্রয় নেয় শান্তির ঘুমে। জীবন শেষে মানুষের শান্তির আশ্রয় দেবী কালরাত্রি। লয়ের শেষ সৃষ্টির শুরু, তাই দেবী কালরাত্রি হলেন দেবী কালী। রাত্রির শেষে আসে উষার উদয় তাই কালরাত্রি দেবীর পর অষ্টমীতে পূজিত হয় দেবী মহাগৌরী। কালের হাতে সময়ের সৃষ্টি সময়ের সাথে এসেছে প্রাণ। দেবতা-সৃষ্ট মানুষ নিজেকে ধরে রেখেছে ধর্মে আর ধর্মে এসেছে দেবতা। তাই মানুষের সৃষ্ট প্রতিটি দেবতা প্রকৃতির ছন্দে বাঁধা কারণ মানুষ প্রকৃতি থেকেই শিক্ষা নেয়। রাতের পর দিন, বৃষ্টিতে সৃষ্টি, ফসলের পর উৎসব, শীতের রুক্ষতার পর বসন্তে নতুন প্রাণ— তাই আবার উৎসব। তাই শারদোৎসব কোনও রামের অকাল বোধন নয়, কালের নিয়ম।দেবী কালী হলেন তন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তন্ত্র কথাটি এসেছে তন্তু থেকে। তন্ত্র একটা সিস্টেম বা পদ্ধতি যেমন দেহতন্ত্র, রাজতন্ত্র। মনকে ত্রাণ করলে মন্ত্র আর তনুকে ত্রাণ করলে হল তন্ত্র। বৌদ্ধ আমলে তন্ত্রের চর্চা প্রাধান্য পায়। সনাতন দেবী কালী বৌদ্ধ প্রভাবে রূপ নেন উগ্রতারা ইত্যাদি আর রূপ হয় ভয়াল, আরও ভীষণ। অনেক দিন পর কৃষ্ণচন্দ্র আগমবাগীশ মাকে দিলেন এক মিষ্টি-মধুর রূপ। কালী করালবদনা আর শুষ্কমাংসাতি ভৈরবা মহামাতৃকা রূপ ছেড়ে এলেন মা হয়ে। এখন তিনি আমাদের বড় কাছের সবচেয়ে প্রিয় এক দেবী, এক বিশ্বাস, এক ভরসা। ভয়াল মা হয়েছেন অভয়া। কালীর জনপ্রিয়তা বেড়েছে দিন দিন। এখন মাকে কাছে পেয়েছে সকলে। দুর্গার চমক, আভিজাত্য গ্ল্যামার কালীর নেই। তবে কালীর যেটা আছে তা হল বারোমাস পাশে থেকে কোলে টেনে নেওয়ার ভরসা। দুর্গা যেন বাপের বাড়ি-আসা বিবাহিতা মেয়েটি। সব মলিনতা ঢেকে সবাই তাকে খুশি রাখছে, আনন্দ করছে, যে যতটা পারছে ‘ভাল আছি’ দেখানোর চেষ্টা করছে। আহা মেয়েটা ক’দিনের জন্য জিরোতে এসেছে, দেখে যাক সবাই ভাল আছে। আর কালী? নিত্যদিনের সুখে-দুঃখে পাশে থেকে বাপকে ভাতের থালা এগিয়ে দেওয়া মেয়েটি। এর সাথে সংসারের সুখ-দুঃখের কথা বলা যায়, টাকা-পয়সার হিসেব করা যায়, ঘরের ফাটা চাল কিংবা ছেঁড়া চাদর নিয়ে কথা বলা যায়।

আরও পড়ুন-কর্ণের বিদায়

তাই কালী আমার আপনার প্রাণের ঠাকুর। বাহনের তোয়াক্কা নেই, রাত-বিরেতে ভয় নেই, পোশাকের দায় নেই, এলো চুল, বনে বাদাড়ে, শ্মশানে মশানে ঘুরে বেড়ানো মেয়েটিকে ভাল না বেসে পারা যায়? সমাজের ভয়কে তোয়াক্কা না করে সমাজকে দাবিয়ে পায়ের তলায় রাখা দাপুটে মেয়ে তো সবার প্রাণের হবেই। কালীর জনপ্রিয়তার আর একটি কারণ তাঁর পুজোর উপাচার। গাছের চারটি জবা আর বেলপাতা দাও— কালী খুশি। প্রসাদে ফল আছে, মাছ, মাংস, কারণ— সবই আছে। কালের কাছে সত্ত্ব রজ তম— সব একাকার। মদ-মাংস খেতে ভালবাসে তাই বলে নিরামিষ কালী হয় না নাকি! চারটি মাষকলাই নিয়ে হলুদ আর তেল দিলেই হল বৈষ্ণবের আমিষ। কালী তাতেও খুশি। কালীর সবচেয়ে বড় গুণ বর্ণভেদ নেই। নিজে কালো বলে কথায় কথায় বাগদি মেয়ের রূপ ধরে সাধককে দেখা দেন। বামনাই নেই, লিঙ্গ-বৈষম্য নেই। সমাজ-নির্ধারিত অনেক নিম্নবর্ণের মহিলা রীতিমতো কালীপুজো করেন, ভর ইত্যাদিও হয়। শিল্পের সমঝদার, গান শুনতে ভালবাসেন। কোনও সাধকের গান শুনছিলেন ঘাড় বেঁকিয়ে, গিয়েছে ঘাড়টা বেঁকে, এখনও সেই মন্দিরে আজও মায়ের ঘাড় বাঁকা! কালীর পায়ের তলায় আশ্রয় পেয়েছে শব, এটাই জীবনের পরম সত্য। যা সত্য তাই শিব, তাই শব হয়েছে শিব। শক্তিময় জগৎ, শক্তি অনাদি অনন্ত। সৃষ্টির উৎস সাধকের কল্পনায় মাতৃরূপা। কালী কালকে কলন করেন— সমাকলনে সৃষ্টি অন্তরকলনে সংহার আর এক লিমিটলেস পালন নিয়ে সমগ্র জগৎ ফাংশন। জীবনের না-মেলা সব অঙ্ক মিলে যায় মায়ের শরণে। তাই সব দেবতাকে হারিয়ে কালী বাঙালির প্রাণের দেবতা— সভ্যতার উষা লগ্ন থেকে আজও।

Latest article