গহনার সাতকাহন

পলাকাটি, মাদুলি, বাউটি, তাবিজ, কণ্ঠমালা, চন্দ্রহার— এই গয়নাগুলো বহুদিন আগে থেকে বাঙালি সমাজে বহুল প্রচলিত। সেই যুগ থেকে এই যুগ— অর্থাৎ যুগ-যুগ ধরে গহনা অর্থ সামাজিক ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। গহনা ভালবাসে না এমন নারী খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। গহনার বিবর্তন আর ইতিহাস নিয়েই লিখলেন কাকলি পাল বিশ্বাস

Must read

বাঙালি বিয়ে আর গহনা একে অপরের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে বহু যুগ আগে থেকেই। বছরের পর বছর এই গয়না ঐতিহ্য এবং আবেগ বহন করে চলেছে। একটা সময় বাঙালি কনের হাতে মকরমুখী বালা, অমৃতপাকের বালা বা কঙ্কণ-সহ অনেক সাবেকি গয়না দেখতে পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে মেয়েরা একটু হালকা গহনা পরতেই ভালবাসে।

আরও পড়ুন-হাওড়ায় লাইনচ্যুত ডাউন সেকেন্দ্রাবাদ সাপ্তাহিক এক্সপ্রেস

আগেকার দিনের মেয়েরা বিয়ের পরে সারাক্ষণই বিভিন্ন ধরনের ভারী ভারী গয়না পরে থাকতেন। আর তাঁরা সেই সময় যে-ধরনের গহনা পরতেন সেগুলোর নাম আমরা এ-যুগের মেয়েরা অনেকেই জানি না।
কৈলাসবাসিনী দেবী ছিলেন কিশোরীচাঁদ মিত্রের স্ত্রী। এই কৈলাসবাসিনী দেবী বিয়ের পরে যখন মিত্তির বাড়িতে বউ হয়ে ঢোকেন তখন তাঁর শাশুড়ি-মা তাঁকে অনেক ভারী ভারী গহনা উপহারস্বরূপ দিয়েছিলেন। তার মধ্যে ছিল আশি ভরির পাঁয়জোর, বালা, পানহার, হাতহার, ২৮ ভরির চন্দ্রহার, পাঁচ ভরির বিল্বপত্র বাজু, ১৪ ভরির গোলমালা, ঝুমুর দেওয়া মল ইত্যাদি ইত্যাদি। এই গয়নাগুলোর কথা তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন। তবে আগেকার দিনে শুধুমাত্র বিয়েতে নয় পুজো বা অন্য কোনও উৎসবের সময়ও সে-যুগের বাবুরা তাঁদের গিন্নিদের জন্য ভারী ভারী সোনার গহনা বানিয়ে দিতেন। আসলে সে-সময় অবস্থাপন্ন গৃহস্থদের সোনার গহনা করার শখ ছিল প্রচুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির মেয়ে-বউরাও প্রচুর গহনা পরতেন। ১২-১৩ বছরের সুন্দরী মেয়ে প্রফুল্লময়ী যখন কনের বেশে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন তখন তিনি চিক, ঝিলদানা, চুড়ি, বালা, বাজুবন্ধ, বীরবৌলি, কানবালা, মাথায় জড়োয়ার সিঁথি, পাঁয়জোর, মল, দশভরির গোট এবং আরও অনেক গহনা পরিহিত ছিলেন। একটা সময় এই সমস্ত গহনাই স্ত্রী-ধনে পরিণত হয়েছিল। যেটা থেকে বাঙালি আজও বেরোতে পারেনি।
আগেকার দিনের মহিলারা নাকে বিভিন্ন ধরনের গহনা পরতেন। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নাকঠাসা। দুটো বোতামের মতো অংশ দিয়ে নাকের মাঝের অংশে ঠেসে এই গয়নাটা পরা হত। এছাড়াও নবাবি আমলে স্বামীর সম্মান অনুযায়ী স্ত্রীরা নাকে নথ পরতেন। সেই সময় সাধারণ ঘরের কেউ নথ পরবে এটা ভাবাই যেত না। শ্রীহট্টের গৌররাম নামক একজন নবাবের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তিনি অনেকদিন ধরে তাঁর পরিবারের মহিলারা যাতে নথ ব্যবহার করতে পারে তার জন্য নবাবের কাছে দরবার করেছিলেন। আর নবাব গৌররামের কথা শুনে তাঁর বাড়ির মহিলাদের পুরুষানুক্রমে নথ পরার অনুমতি দিয়েছিলেন। এটা ১১৫৬ সালের কথা। সেই সময় থেকে বাঙালি হিন্দু মহিলারা নথের ব্যবহার শুরু করেছিলেন। সে-সময় নাকের গয়নার মধ্যেও বহু ধরনের ডিজাইন দেখতে পাওয়া যেত। আর সেগুলোর নামও ছিল অদ্ভুত ধরনের। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল মাক্কি, কেশর, ডালবোলাক, হীরাকাট ইত্যাদি। নাকছাবিরও নকশা অনুযায়ী বহু ধরনের নাম ছিল যেমন চালতাফুল, দামালকোট, ডালিম ফুল, লবঙ্গ ইত্যাদি।
সেই সময় পায়ের নূপুর নিয়েও অনেক বাধ্যবাধকতা ছিল। শুধুমাত্র রাজ পরিবারের মেয়েরাই সে-সময় সোনার নূপুর ব্যবহার করতেন।
ঊনবিংশ শতকের মেয়েরা গলায় হাঁসুলি, ইতরাবদন, গুলবন্ধ, চম্পাকলি, হাউলদিল ইত্যাদি নানারকমের নামের গলার হার পরলেও মুক্তোর মালার চল ছিল সবথেকে প্রাচীন। এই মুক্তোর মালা বৈদিক যুগ থেকে ব্যবহার করা হত।

আরও পড়ুন-বিয়ে কোনও সাজা নয়

তবে হাতের গয়নার ক্ষেত্রে অনেকগুলো আজও মেয়েরা ব্যবহার করে থাকে। সেই হাতের গয়নাগুলো হচ্ছে মানতাসা, বাজুবন্ধ, বাউটি, তাবিজ, রতনচুর ইত্যাদি। মানতাসা ভারী ও চওড়া এবং চৌকো মতো। এটা কবজিতে পরা হয়। রতনপুর পরা হয় হাতের উপরিভাগে।
আংটি পরতে আমরা সকলেই ভালবাসি। হাতের আঙুলে বিভিন্ন ধরনের আংটি হাতের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তোলে। মনে করা হয় এই আংটি পরার চল শুরু হয়েছিল শকুন্তলার আমল থেকে। সেসময় ছল্লা আর আরশি নামে দুই রকমের আংটি ছিল। এই আংটিগুলো অনেক বড় আকারের ছিল এবং এটি তর্জনীতে পরতে হত। তবে আগেকার দিনে সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারা সবাই কোমরে পাহজেব, বঞ্জর, জিঞ্জির ইত্যাদি গহনা পরতেন। তবে মধ্যবিত্ত ঘরের পুরুষরা তাঁদের স্ত্রীকে কোমরবন্ধনী হিসেবে কিনে দিতেন গোটাহার আর নিমফল।
মধ্যযুগের মহিলাদের ব্যবহৃত গহনাগাঁটির মধ্যে সোনা ও রুপোর গহনার কথা জানতে পারা যায় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে থেকে। এ সময় সাধারণ নিম্নবর্গের মহিলাদের মণিমুক্তোখচিত গয়না পরার ইচ্ছা থাকলেও সেটা সাধ্যের মধ্যে ছিল না। আর এই গহনার মাধ্যমে অর্থাৎ মেয়েদের সাজ অলংকার সজ্জার ধরন আর্থসামাজিক পরিস্থিতির কারণে পাল্টে যেত। তবে সেই যুগে বণিক পরিবারেই অন্দরমহলেই সোনা, রুপো, মণিমাণিক্যখচিত গহনার চল বেশি ছিল। মধ্যযুগের সাধারণত হিন্দু জাতির মধ্যেই সোনা-রুপোর গহনা পরার প্রচলন ছিল। ত্রয়োদশ শতকে যখন বাংলার ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠা হয় তখন মুসলিমদের মধ্যে প্রধানত জড়োয়ার গহনার প্রচলন বাড়তে থাকে। তবে উচ্চবিত্ত মুসলমান পরিবারের মেয়েরাই এই জড়োয়ার গহনা ব্যবহার করত। উনিশ শতকের শেষের দিকে কলকাতাকেন্দ্রিক নবসংস্কৃতির ছোঁয়ায় অনেক কিছুর বদল হলেও অন্দরমহলে গহনার ব্যবহার কিন্তু আগের মতোই ছিল। আর সেই গয়নার কথা সেই সময়কার বিভিন্ন নারীদের লেখা আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধগুলো থেকে পাওয়া যায়। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কৈলাসবাসিনী দেবীর লেখায় গয়নার ফর্দ।

আরও পড়ুন-রাজ্যে দুই সংস্থার দুই প্রকল্প, চাকরি ১২ হাজারের বেশি

ভারতবর্ষে গহনার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্য এসেছিল কিন্তু মুঘলদের হাত ধরেই। ১৬ শতাব্দীতে মুঘলদের সঙ্গেই এসেছিল সুদক্ষ শিল্পীরা যারা সোনার গহনাকে অন্য এক মাত্রা দিয়েছিল। সেই সময় গহনা ছিল ক্ষমতা আর সমৃদ্ধির প্রতীক। নবাবদের পাগড়িগুলো ছিল রত্নখচিত। রাজ পরিবারের সদস্যরা ভারী ভারী গহনা পরে তাঁদের সামাজিক অবস্থান প্রদর্শন করতেন। এই মুঘলদের অনেকেই রাজপুত রাজকন্যাদের বিবাহ করেছিলেন। আর তার ফলে গহনার ক্ষেত্রে মুঘলদের সূক্ষ্ম ডিজাইনের সাথে রাজপুতদের নিখুঁত কারুকাজের একটি অভিনব একত্রীকরণ হয়েছিল।
আমরা যে কুন্দনের গহনা পরি সেই কুন্দনের গহনা জনপ্রিয় করে তুলেছিল মুঘলরাই। কুন্দন শব্দটির অর্থ হচ্ছে বিশুদ্ধ সোনা আর এই বিশুদ্ধ এবং সম্পূর্ণ গলিত সোনা এই কুন্দন গহনার তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সোনার ওপর পাথরের সেটিং করাও মুঘল আমলেরই এসেছিল। এছাড়াও গয়নার ওপর মিনেকারির কাজ মুঘল যুগেই সমৃদ্ধি পায়। এই মুঘল আমলেই জনপ্রিয় ছিল অর্ধচন্দ্রকলা এবং বৃন্তা নামক ডিজাইনের কানের দুলগুলি। এই দুলগুলি পুরো কান জুড়ে অর্ধচন্দ্রাকারে তৈরি করা হত এবং এর ওপরে একটি ছোট বৃন্ত থাকত। মুঘল সম্রাট যা যে-সমস্ত যে-পাগড়িগুলো পরতেন সেগুলো ছিল সিল্কের আর এই সিল্কের পাগড়ির উপর থাকত সোনার মিনাকারি কাজ। এ ছাড়াও তাঁরা কবজিতে যে অলংকারগুলি পরতেন অর্থাৎ ব্রেসলেট, বালা ইত্যাদি সেগুলোতে নিখুঁতভাবে ফুলের ডিজাইন করা থাকত। এবং তাঁরা যে বড় বড় আংটি পরতেন সেগুলো কলাই করা সোনার তৈরি হত। প্রতিটি মুঘলসম্রাজ্ঞী গোল্ড প্লেটেড নূপুর এবং নাকে নথ পরতেন। আর এই নথটির মধ্যে চুনি এবং মুক্তোর মতো পাথর থাকত। রাজ পরিবারের মহিলারা খাঁটি সোনার খিল কিংবা দড়ি দেওয়া অনন্ত পরত। এই আমলেই কানফুল ঝুমকোর প্রচলন হয়েছিল। এই কানফুল ঝুমকোর বৈশিষ্ট্য হল এতে একটি চেইন লাগানো থাকত এবং সুন্দর একটি ফুলের নকশা করা থাকত। মুঘলরা যে ধরনের জুতো পরত সেগুলো মোজড়ি নামে অভিহিত ছিল। এই সমস্ত জুতোগুলোতে সোনার সুতো দিয়ে এমব্রয়ডারি করা হত।

Latest article