বাবা তারকনাথের সেবা লাগেএএএএএ— চৈত্র মাসের গাজন সন্ন্যাসীর এই সুর কম-বেশি বঙ্গের মানুষজনেদের সবারই খুব চেনা।
নীলপুজো বা নীলষষ্ঠী এক সনাতন লৌকিক উৎসব যা নীলাবতী বা নীল নামে পরিচিত। এটি মূলত শিব-দুর্গার বিবাহ উৎসব। সাধারণত চৈত্র সংক্রান্তির চড়ক উৎসবের আগের দিন পালিত হয়ে থাকে নীলপুজো।
বাঙালি মায়েরা সন্তানের মঙ্গলকামনায় সন্তানের সুস্থ ও নীরোগ জীবনের প্রার্থনায় এই নীলষষ্ঠীর ব্রত বা পুজো করে থাকেন। নীল সন্ন্যাসীরা ও শিব-দুর্গার সঙরা গান বাজনা সহযোগে নীলকে সুসজ্জিত করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়।
নীলের গানকে বলে অষ্টক গান।
নীল পুজোর দিন সন্ধেবেলায় সন্তানবতী মহিলারা শিবের পুজো করে নিজেদের উপবাস ভঙ্গ করে। বাসন্তী পুজোর দশমীর পরে এই অনুষ্ঠিত হয়।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
নীলপুজোর ইতিহাস
ও রীতিনীতি
নীল বা নীলকণ্ঠ মহাদেব শিবের আরেক নাম। সেই নীলকণ্ঠের সঙ্গে লীলাবতী পরমেশ্বরীর বা নীল চণ্ডিকার বিয়ে উপলক্ষে লৌকিক আচার অনুষ্ঠিত হয়।
পুরাণ কাহিনি অনুসারে, পিতা দক্ষের যজ্ঞের অনুষ্ঠানে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সতী দেহত্যাগ করেন। তখন শোকে দুঃখে ক্রোধে উন্মাদ হয়ে ভোলানাথ তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেছিলেন। এরপর সতীর আবার জন্ম হয় নীলধ্বজ রাজার ঘরে। নাম হয় নীলাবতী। দেবী পার্বতীর আরেক নাম নীলাবতী। সেখানে রাজকন্যা হিসেবে লালন-পালনের পর নীলধ্বজ রাজা তাঁর বিয়ে দেন। বাসর ঘরে নিজের রূপে শিবকে মোহিত করেন তিনি। কিন্তু অনতিপরেই মক্ষিকার রূপ ধরে ফুলের সঙ্গে জলে পরে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। রাজা-রানি শোকে প্রাণ বিসর্জন দেন।
লীলাবতীর ও শিবের বিবাহের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান হল নীলপুজো। নিম বা বেল কাঠ থেকে নীলের মূর্তি তৈরি করা হয়। চৈত্রসংক্রান্তির বেশ আগেই নীলকে মণ্ডপ থেকে নিচে নামানো হয়।
নীল পুজোর আগের দিন হয় অধিবাস। বেশি রাতে হয় হাজরা পুজো। অর্থাৎ সমস্ত দেবতাদের লীলাবতী ও শিবের বিয়ে উপলক্ষে আমন্ত্রণ জানানো হয়। হাজরা পুজোয় শিবের চ্যালাদের বা ভূতপ্রেতের দেবতাদের পোড়া শোলমাছের ভোগ দেওয়া হয়। পরদিন নীলকে গঙ্গা জলে স্নান করিয়ে নতুন লাল শালু কাপড় পরিয়ে অন্ততপক্ষে সাতটি বাড়িতে ঘোরানোর রীতি।
অঞ্চলে ভেদে এক মাস ধরে ঘোরানোর নিয়মও রয়েছে। নীল সন্ন্যাসীরা সাধারণত লাল বা গেরুয়া ধুতি, মাথায় পাগড়ি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরে, সেজে হাতে ত্রিশূল নিয়ে বেরোন। এদের দলপতিকে বলা হয় বালা।
ঢাক, ঢোল, কাঁসি করতাল সহযোগে নাচ-গান করে গৃহস্থ বাড়িতে তাঁরা ঘোরেন। উঠোনে আলপনা এঁকে গৃহস্থ মহিলারা নীলকে বরাসনে বসিয়ে আহ্বান করেন। ভক্তি ভরে মাথায় তেল সিঁদুর মাখিয়ে অর্চনা করেন। এরপরই শুরু হয় নীলের অষ্টক গান।
“শুন সবে মন দিয়া হইবে শিবের বিয়ে
কৈলাসেতে হইবে অধিবাস’—
এছাড়াও অষ্টক গানে থাকে বিয়ের পর শিব পার্বতীর সংসারের কথা, শিবের কৃষি কাজ, গৌরীর শাঁখা পরা, ভিখারি শিবের সঙ্গে অন্নপূর্ণা শিবানীর দ্বান্দ্বিক-সহ অবস্থানের কথা।
প্রথম অংশে এই গান দলপতি বালারা গেয়ে থাকেন। পরবর্তী অংশ নীল সন্ন্যাসীরা। এরপর গৃহস্থ মহিলারা এঁদেরকে চাল ডাল নুন তেল দিয়ে থাকেন।
আরও পড়ুন-অস্পষ্ট অভিযোগে সিবিআই তদন্ত সংবিধানসম্মত নয় জানাল সুপ্রিম কোর্ট
অষ্টক গান
বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ভেতরে প্রচলিত লোকসঙ্গীতের একটি প্রকরণ। অপর নাম অষ্ট গান। এক প্রকার লোকসঙ্গীত। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চৈত্র মাসের শিবের ভক্তরা, চৈত্র সংক্রান্তিতে নীলের গাজন উপলক্ষে এই গান গেয়ে থাকেন। গাজন গানের বিষয় শিব। অষ্টক গানের বিষয় ও মূলত শিব। তবে রাধা-কৃষ্ণের লীলা ও নিমাই সন্ন্যাস প্রসঙ্গ এতে থাকে। গানের ভাষা আটপৌরে কিন্তু ছন্দময় ও আবেগ বহুল। খেয়ালের মতো এ গান স্থায়ী ও অন্তরা দুটি তুক থাকে। ভগ্ন ত্রিপদীর আঙ্গিকে অন্তরা রচিত হয়। শিব পার্বতীর দাম্পত্য জীবনের রূপকে লৌকিক জীবনের ছায়াপাত ঘটে।
অষ্টক গানের দল গঠিত হয় মূলত দশ বারো বা ততোধিক সংখ্যক শিল্পী নিয়ে। শিল্পীরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে গান পরিবেশন করেন। সূত্রধরের নির্দেশে গায়ক-গায়িকারা তাঁদের নিজস্ব রীতিনীতি বৈশিষ্ট্য এবং ভাব গাম্ভীর্য অনুযায়ী গান পরিবেশন করেন। এই গানের কোনও লেখক ছিল না বেশিরভাগ সময়ই দলের সর্দার বা অধিকারীর মুখে মুখে এই গান পরিবেশন হত। শিল্পীরা মুখস্থ গাইতেন। তাই গানের কাহিনি এক হলেও কথার হেরফের দেখা যেত। অষ্টক গানের সঙ্গে নাচের ও সংযোগ রয়েছে। পার্বতী, কালী, অসুর ইত্যাদি চরিত্রে অভিনেতারা মুখোশ ও সাজসজ্জা গ্রহণ করে নৃত্যাভিনয় করে।
এই গান পরিবেশনের ক্ষেত্রে হারমোনিয়াম, মন্দিরা এ ধরনের দেশীয় বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়।
এই গানে অষ্ট চরিত্রের সমন্বয় ঘটে, তাই অষ্ট গান। অষ্ট শব্দের অর্থ শিব। তাই শিবের গানকে অষ্টক গান বলে। এই রকম ও কেউ কেউ বলে থাকেন।
কিন্তু এ-গানের শিবের প্রসঙ্গ এলেও কৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা, নিমাই সন্ন্যাস এইসব ও পরিবেশিত হয়। শুধু মহাভারত, রামায়ণ বা পুরাণ নয়, অষ্টক গানে উত্থাপিত হয় সমসাময়িক প্রসঙ্গও। তবে শেষদিকে বৈষ্ণব প্রসঙ্গ যুক্ত হলেও প্রথমদিকে অষ্টক গানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শিব ঠাকুরই। অষ্টক গান উপভোগ করে মূলত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা। বিশেষ করে ঘরামি, জেলে এরাই এই গানের বিশেষ ভক্ত। অষ্টক গানের কথা আড়ম্বরহীন ও সাধারণ মানের হলেও তা অত্যন্ত মনোগ্রাহী।
“ও নারদ কৈলাসে ভবানী কে কয় হেসে
পাগলা মামা ধুতরো খেয়ে
কোচের বাড়ি যায় ঘুরে
ও মামা! হাসে রসে পান চিবায়,
চিচ চালে কোঁচানির গায়।
কেউবা মামার মাথা খায়, কেউ বা মামার জট ঘুরায়,
ওরে চুপ— গাজন তায় আলোয়ে নাগর দিল তুলায়ে।’
তুই বড় রূপসী,
আমি একটু হয়েছি বুড়া
তাতে তোর ক্ষতি কি?
আমি দিব সোনার মুকুট তোর মাথায়
সোনার মল গড়ে দিব তোর পায়
দুই হাতে দুই কঙ্কন দিব যাতে তোর শোভা হয়
চিরুণে চুরিয়া চুল
খোঁপায় দিয়া, হা রে চম্পা ফুল।
ফুলের গন্ধে কেড়ে নেয় প্রাণের যুবতীর কুল।
দেবী নীল চণ্ডিকা বা নীলাবতীর কথা
দেবী নীল চণ্ডিকা বা লীলাবতীর কথা বিস্মৃতপ্রায়। তবে এই দেবীর প্রভাব কিন্তু রয়ে গিয়েছে নীল সরস্বতী, নীলবর্ণা কালী বা বৌদ্ধদের নীল তারার মধ্যে দিয়ে।
নিলাইচণ্ডী চণ্ডীর আরেক রূপ। আসলে পার্বতী বা চণ্ডীর সঙ্গে দেবী মিলেমিশে গেছে। দুর্গার অপর নাম লীলাবতী। নীলষষ্ঠীর ইতিহাসে তাই দেবী লীলাবতীর রেশ রয়ে গিয়েছে।
পার্বতীর বিয়ের অনুষ্ঠান বলে কথা। তাই এই দু’জনকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয় তাঁদের বিয়ে উপলক্ষে।
শিবকে টোপর পরিয়ে, গলায় মালা দিয়ে, ধুতি পরিয়ে, পার্বতীকে মুকুট পরিয়ে, সিঁদুর দিয়ে, আলতা পরিয়ে বরণ করে এই পুজো করা হয়। এবার নীল সন্ন্যাসীরা একমাস উপোসের পরে লীলাবতী ও নীলকণ্ঠের বিয়ের আসরে গান পরিবেশন করেন। আসলে নীল নীলাবতীর বিয়ে বা শিবদুর্গার বিবাহ উৎসব। চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন প্রদোষ কালে নীল ষষ্ঠী ব্রত উপলক্ষে ঘরের মহিলারা শিবের মাথায় জল ঢেলে, মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে মঙ্গল কামনা করে সন্তানের। সাদা ফুল, ধুতরা ফুল এবং ফল আকন্দ ফুল শিবের খুব প্রিয়। লাল ফুল বা সুগন্ধি ফুল বর্জনীয়।
আরও পড়ুন-নীলকণ্ঠ ও নীলপরমেশ্বরী কথা
নীলষষ্ঠীর মাহাত্ম্য
গ্রামবাংলায় ষষ্ঠীতে ঊর্বরা শক্তির দেবী ষষ্ঠী আরাধনার প্রথা আছে। অশোকষষ্ঠী এবং শীতলষষ্ঠী হল এমনই ষষ্ঠীপার্বণ। কিন্তু নীলষষ্ঠীতে ষষ্ঠীদেবীর নয়, সন্তানের মঙ্গল কামনা করে মহাদেবের আরাধনা করা হয়ে থাকে।
নীলষষ্ঠীতে শিবের পূজা কেন হয় তা নিয়ে এক প্রচলিত কাহিনি রয়েছে।
এক দেশে এক ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণী বাস করতেন। তাঁরা অতি ভক্তিভরে সমস্ত ব্রত পালন করতেন। তবুও তাঁদের সন্তান একটাও বেঁচে থাকত না। বারে বারে অকাল মৃত্যু হত তাদের। মনের কষ্টে ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী ঠিক করলেন তাঁরা আর বারব্রত বা ঠাকুর দেবতার আরাধনা করবেন না। কোনও কিছুরই ফল নেই যখন ভগবানের পুজো করে আর কী হবে?
এই ভেবে তাঁরা তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন। ভ্রমণ করতে করতে তাঁরা একটা সময়ে কাশী পৌঁছালেন। একদিন কাশীতে গঙ্গায় দু’জনে স্নান করে উঠে ঘাটের ওপর বসে মনের দুঃখে চোখের জল ফেলছেন, এমন সময়ে মা ষষ্ঠী এক বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর বেশ ধরে এসে তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন তোরা কাঁদছিস কেন?
ব্রাহ্মণী বললেন অনেকগুলো সন্তানের অকালে চলে যাওয়ার কথা। সবশুনে বৃদ্ধা বললেন, “দেখো তোমরা সব বারবোতো করো বলে মনে বড় অহংকার ছিল, সেই জন্য এমন ঘটনা ঘটেছে। শুধু কি আর বারব্রত করলেই হয়? ভগবানের উপর বিশ্বাস থাকা চাই, মন পবিত্র থাকা চাই, সবার কাছে নিচু হওয়া চাই, এক মনে মা ষষ্ঠীকে ডাকা চাই, তবে হয়।
তখন ব্রাহ্মণী বললেন, উপায় বলে দাও মা। তখন নীলষষ্ঠী করার কথা তাঁদের জানান। সমস্ত চৈত্রমাস সন্ন্যাস করে শিবপুজো করবে তারপর সংক্রান্তির আগের দিন সমস্ত দিন উপোস করে সন্ধ্যার সময় লীলাবতীর পুজো করে নীলকণ্ঠ শিবের ঘরে বাতি জেলে দিয়ে মা ষষ্ঠীকে প্রণাম করে তবে জল খাওয়া যাবে। ওই দিনকে ষষ্ঠীর দিন বলে।
নীলষষ্ঠীর কৃপায় সন্তানেরা সুস্থ নীরোগ জীবন পায়।
এরপর ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী দেশে ফিরে গিয়ে খুব ভাল করে নীল ষষ্ঠীর পুজো করেন। এরপর তাদের যতগুলো সন্তান হল সবাই দিব্যি বেঁচে বর্তে রইল।
‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’ অন্নদামঙ্গল কাব্যে দেবী অন্নপূর্ণার কাছে এই প্রার্থনা জানিয়েছিলেন ঈশ্বরী পাটনী। বাংলার মায়েদের মনের এই চিরন্তন প্রার্থনাই যেন ধরা পড়ে নীলষষ্ঠীর ব্রতে।
ভগবান ভোলানাথের অপর নাম নীলকণ্ঠ।
কেন বলা হয় নীলষষ্ঠী
নীলষষ্ঠীর বিশেষ দিনে এই মহাদেবের সঙ্গে নীলচণ্ডিকা বা নীলাবতীর বিয়ে হয়েছিল। মহাদেব নিজে নীলকণ্ঠ। আর পুজোকে নীলপুজো বলা হয় আর এই দিনেই বিয়ে উপলক্ষে লৌকিক আচার অনুষ্ঠান পালিত হয়েছিল এই দিন। এই রকম নানা কাহিনিকে ঘিরেই শুরু হয় নীলষষ্ঠীর পুজো। এই দিনটি নীলষষ্ঠী নামে পরিচিত। এই দিনে বাংলায় প্রায় সমস্ত মন্দিরগুলোতে ভিড় করতে থাকেন ভক্তরা।
কথায় আছে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। এই পার্বণকে ঘিরে সারা বছর চলে নানা উৎসব, অনুষ্ঠান। বাংলার বিভিন্ন ব্রতের মধ্যে অন্যতম নীলষষ্ঠী। এই নীলষষ্ঠীকে ঘিরেও চলে মেলা, যাত্রা ও উৎসব অনুষ্ঠান।