ছ’বছরের ছবি বোদ্ধা
হায়দরাবাদের শ্রীধর বেনেগালের বাড়ির কাছেই ছিল আর্মিদের সিনেমা হল। যেখানে সপ্তাহে তখন অন্তত তিনটে করে নতুন ছবি মুক্তি পেত। প্রত্যেকটাই হয় ব্রিটিশ না হয় আমেরিকান ছবি। পুরো পরিবার যেতেন ছবি দেখতে। ওয়ার্নর ব্রাদার্স, উইলিয়াম ডিয়েটরলে, উইলিয়াম ওয়েলার, জন হিউস্টনের মতো বিখ্যাত নির্মাতা এবং নির্দেশকদের পরিচালিত ছবিগুলোর সঙ্গে তখন থেকেই সখ্য গড়ে উঠেছিল বাড়ির ছোট ছেলেটিরও। সপ্তাহে শুধু রবিবারে সেখানে দেখা যেত এক আধটা হিন্দি ছবি। সেই ছ’বছর বয়স থেকে ছবি দেখার অভ্যেসটা ভালমতো রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ওই সিনেমা হল-এর গায়েই ছিল টেনিস কোর্ট যেখানে সে এবং তার বড় দাদা টেনিস খেলতে যেত এবং ফাঁক পেলেই প্রেক্ষাগৃহের প্রোজেকশন রুমে প্রায়শই ঢুকে পড়ত। সেখানকার মুভি অপারেটর, প্রোজেকশনিস্টদের সঙ্গে বেশ একটা সুন্দর বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল দুই ভাইয়ের। ফলে তখন বিনামূল্যে প্রচুর ছবি দেখতেন তাঁরা। এমনই ছবিময় ছিল কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগালের শৈশব এবং কৈশোর। ১৯৩৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর হায়দরাবাদে জন্ম শ্যাম বেনেগালের। বাবা শ্রীধর বি বেনেগাল ছিলেন আলোকচিত্রী। শ্যামের যখন মাত্র ১২ বছর তখন তিনি বাবার দেওয়া ক্যামেরা দিয়েই প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। অর্থনীতির স্নাতক শ্যাম বেনেগাল পেশাদার জগতে প্রবেশ করেছিলেন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজের সুবাদে। এরপর ১৯৬২ সালে তৈরি করেন গুজরাতি তথ্যচিত্র।
আরও পড়ুন-ব্যক্তিগত স্বার্থেই ধরনা, হাইকোর্টে দাবি রাজ্যের
চলচ্চিত্র আন্দোলনের প্রাণপুরুষ
১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি ঘটে যাওয়া তেলেঙ্গানার কৃষক বিদ্রোহ হায়দরাবাদে বেড়ে ওঠা অল্পবয়সি ছেলেটির মনে ভীষণ প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর সেই প্রভাবের ফলস্বরূপ আমরা পরবর্তীকালে পেয়েছিলাম চলচ্চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগালের শ্রেষ্ঠ ট্রিলজি ‘অঙ্কুর’ (১৯৭৪), ‘নিশান্ত’ (১৯৭৫) এবং ‘মন্থন’ (১৯৭৬) এই তিনটি ছবি। ‘অঙ্কুর’ ছবির মাধ্যমে তিনি যে আন্দোলনের বীজ পুঁতেছিলেন, সেই বীজ মহীরুহ হয়ে ওঠে ১৯৭৬-এ। প্রায় পাঁচ লক্ষ কৃষকের দেওয়া অর্থে ওই বছরেই তৈরি হয়েছিল তাঁর কালজয়ী ছবি ‘মন্থন’। মিল্ক ম্যান অফ ইন্ডিয়া ভার্গিস কুরিয়েনের ওপর নির্মিত হয়ছিল ‘মন্থন’ ছবিটি। কুরিয়েনকে নিয়ে আগে তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন শ্যাম। কিন্তু আরও বেশি মানুষের কাছে তাঁর কথা পৌঁছে দিতে ফিচার ফিল্ম বানাতে চেয়েছিলেন শ্যামবাবু। ফিল্মি দুনিয়ায় ওই নামেই জনপ্রিয় হন। কিন্তু ফিল্ম করতে দরকার প্রচুর অর্থ। বুদ্ধি খাটালেন কুরিয়েন। গ্রামের কৃষকরা যখন তাঁদের উৎপাদিত দুধ সমবায়ের কালেকশন সেন্টারে দিতে যাবেন তখন তাঁদের প্রত্যেকের থেকে দু’টাকা করে কেটে নেওয়া হবে, বলেন কুরিয়েন। একবাক্যে রাজি হয়ে গেলেন কৃষকরা। এর পরেরটা ইতিহাস। তৈরি হল ভারতের প্রথম ক্রাউড ফান্ডেড ফিল্ম ‘মন্থন’। এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন গিরিশ করনাড, নাসিরুদ্দিন শাহ, স্মিতা পাতিলের মতো বাঘা-বাঘা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে ভারতীয় সমান্তরাল চলচ্চিত্র আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ঘটিয়েছিলেন নিঃশব্দ বিপ্লব।
আরও পড়ুন-সংখ্যালঘুদের নিশ্চয়তা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব : ব্রাত্য বসু
চলচ্চিত্রে নতুন দর্শনের স্রষ্টা
এরপর একের পর এক দুর্দান্ত ছবি তৈরি করেছেন শ্যাম বেনেগাল। ‘ভূমিকা’, ‘মান্ডি’, ‘কলিযুগ’, ‘জুনুন’, ‘আরোহণ’, ‘ত্রিকাল’, ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস দ্য ফরগটেন হিরো’, ‘ওয়েল ডান আব্বা’, ‘মাম্মো’র ইত্যাদি। খুব কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করেছিলেন অন্য ভারতবর্ষকে। সমাজের দলিত, অবহেলিত মানুষের কাহিনির মাধ্যমে একটি নতুন দর্শন চালু করেছিলেন তিনি ভারতীয় সিনেমায়। চলতি বছরের শুরুতেই কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে তাঁর সেই বিখ্যাত ‘মন্থন’ ছবিটা। ১৯৭৭ সালে দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে বহুদিনের সম্পর্ক ছিল তাঁর। কলকাতায় এলেই তিনি যেতেন রায় বাড়িতে।
তৈরি করেছেন শ্রেষ্ঠদের
শ্যাম বেনেগাল শুধু সিনেমা তৈরি করেননি। এই দেশের বহু শ্রেষ্ঠ অভিনেতা-অভিনেত্রীকে বড়পর্দায় নিয়ে এসেছিলেন। যাঁদের মধ্যে অন্যতম শাবানা আজমি, নাসিরুদ্দিন শাহ, মোহন আগাসে, ওম পুরী। ‘অঙ্কুর’ ছিল শাবানা আজমির প্রথম ছবি। এই ছবির জন্য তিনি সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় পুরস্কারও জিতেছিলেন। স্মিতা পাতিলকে মানুষ প্রথমবার চিনেছেন শ্যামের ছবির মধ্য দিয়েই। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে বহুদিনের সম্পর্ক ছিল তাঁর। কলকাতায় এলেই তিনি যেতেন রায় বাড়িতে। আরও এক কিংবদন্তি অভিনেতা এবং চলচ্চিত্র পরিচালক গুরু দত্ত ছিলেন শ্যামের তুতো ভাই। গুরু দত্তের পরিচালনার আঙ্গিক শ্যামকে অনুপ্রাণিত করেছিল। নিজের মতো করে পরিচালকদের ভাবতে শিখিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-এই বিরল ভদ্র-সৎ রাজনীতিককে প্রকাশ্যে হেনস্থা করেছিলেন রাহুল
পেয়েছেন অগুনতি সম্মান
দীর্ঘজীবন জীবনে পেয়েছেন অগুনতি সম্মান। সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ‘পদ্মশ্রী’, ‘পদ্মভূষণ’, ‘দাদাসাহেব ফালকে’, ‘ভি সান্তারাম লাইফ টাইম আচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ ইত্যাদি।
দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ছবির জগৎ থেকে বিরতি নিয়েছিলেন তিনি। তবে চলচ্চিত্র ভাবনা কোনওদিন তাঁর পিছু ছাড়েনি। সেই কারণেই ৯০-এর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের বায়োপিক তৈরি করেন শ্যাম বেনেগাল। ২০২৩-এ মুক্তি পেয়েছে তাঁর শেষ ছবি ‘মুজিব : দ্য মেকিং অফ এ নেশন’। অসুস্থায় জর্জরিত থাকলেও কর্মজগৎ থেকে কিন্তু মোটেই সরে আসেননি। ডায়ালিসিসের জন্য তাঁকে হাসপাতালেও যেতে হত। ২৩ ডিসেম্বর ৯০ বছর বয়সে মারা গেলেন চলচ্চিত্রকার শ্যাম বেনেগাল।