গীতা মা

ছয় দশকের বেশি সময় ধরে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন পর্দায়, থিয়েটারের মঞ্চে। অভিনয় করেছেন কয়েকশো বাংলা ছবিতে। উপহার দিয়েছেন বহু জনপ্রিয় নাটক। খল চরিত্রগুলো তাঁর সহজাত অভিনয় গুণে হয়ে উঠত জীবন্ত। তিনি বাংলা চলচ্চিত্র, থিয়েটার, লোকনাট্যের জনপ্রিয় কিংবদন্তি অভিনেত্রী গীতা দে। গতকাল ছিল তাঁর প্রয়াণদিবস। এই উপলক্ষে তাঁকে স্মরণ করলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাবা তারকনাথ’ ছবিতে সুধার সেই দজ্জাল মামিমাকে মনে পড়ে? যে সংসারের সব কাজ ভাগনিকে দিয়ে করাত, স্বামী খেদানো বলে চুলির মুঠি ধরত, এমনকী ভাগনির মাছের পিসটাও নিজে খেয়ে নিত! কখনও চক্রান্ত্রকারী মা, কখনও কুচুটে পিসিমা, আবার কখনও বদমাশ শাশুড়ি, যাকে দেখলেই গা-পিত্তি জ্বালা করে উঠত। একবার নাকি লোকজন তাঁকে দেখে তেড়ে মারতেও এসছিল। সে-যাত্রায় কোনওমতে বেঁচেছিলেন তিনি। মানুষের রাগ, ক্ষোভ, বিরক্তি উসকে দেওয়া সেই নারীর বাস্তব জীবনটি ছিল বড়ই করুণ। যা শুনলে যে কোনও মানুষের চোখ জলে ভরে উঠবেই। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের, থিয়েটারের, লোকনাট্যের জনপ্রিয় কিংবদন্তি অভিনেত্রী গীতা দে। তিনি একবার একটি সিনেমা হলে দর্শকের আসনে বসে সিনেমা দেখছিলেন। আচমকাই সিনেমা হলের লাইট জ্বলে যাওয়ায় নজরে পড়ে যান দর্শকদের। তখন চিনতে পারা মাত্রই হল ভর্তি লোকজন তাঁকে তেড়ে মারতে আসেন। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে কোনও মানুষের জীবনে এমন অভিজ্ঞতা খারাপ মনে হলেও অভিনেত্রী হিসেবে ওটাই ছিল গীতা দে-র জীবনের সেরা প্রাপ্তি। অভিনয় গুণে প্রতিটা খলচরিত্রকে এমন বাস্তবসম্মত করে তুলতেন যে চরিত্ররা জীবন্ত হয়ে উঠত। ইন্ডাস্ট্রির সবাই তাঁকে গীতা মা বলতেন। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে ছিলেন সহজ-সরল। আর সেই সরলতার সুযোগ নিয়েছিল অনেকেই। জীবন জুড়ে পেয়েছিলেন চরম বঞ্চনা ও অবহেলা।

আরও পড়ুন-আরজি কর-কাণ্ডে রায় আজ শিয়ালদহ কোর্টে

দর্জিপাড়ার মেয়ে
উত্তর কলকাতার দর্জিপাড়ার মেয়ে গীতা। জন্ম ১৯৩১-এর ৫ অগাস্ট। বাবা ছিলেন বিলেত-ফেরত চিকিৎসক। বাবা অনাদিমোহন মিত্র মেয়ের গান ও অভিনয়ে প্রবল ঝোঁক দেখে তাঁকে প্রতিবেশী গায়িকা রাধারানি দেবীর কাছে তালিম নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তাঁর কাছেই গীতার প্রথম জীবনের নাচ, গান, অভিনয় শিক্ষা। তিনিই প্রবোধ গুহর কাছে কাজের সুযোগ করে দেন গীতা দে-কে। তখন গীতা পারিশ্রমিক পেতেন মাত্র পাঁচ টাকা। সে টাকাতেই চলত সংসার। মাত্র ৬ বছর বয়সে একজন মঞ্চশিল্পী হয়ে উঠেছিলেন গীতা দে। অভিনয় জীবন শুরু শ্রীরঙ্গমে। ১৯৩৭ ছ’বছর বয়সেই তিনি ‘আহুতি’ নামে একটি বাংলা ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। ছবিটির পরিচালক ছিলেন ধীরেন গাঙ্গুলি। গীতা দে-র গুরু ছিলেন শিশির ভাদুড়ী। যাঁর কাছে ওঁর নাট্যশিক্ষা এবং একই সঙ্গে নাটকে অভিনয়ও। গীতার যখন পাঁচবছর তখন তাঁর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মা সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েন। বড় দুঃখ-বিদারক সেই অধ্যায়। আদালত যখন ছোট্ট মেয়ে গীতাকে জিজ্ঞেস করে সে কার কাছে থাকতে চায়। তখন গীতা দে তাঁর মার সঙ্গেই থাকতে চেয়েছিলেন। সেই সময়ে মা রেণুবালা দেবী তাঁকে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিলেন,‍‘‘কী বোকা রে তুই! ডাক্তার বাবার কাছে থাকলে কত ধনীর দুলালী হতিস। আমি তো তোকে সুখই দিতে পারব না।’’ ভুল বলেননি তাঁর মা। স্বামী পরিত্যক্তা রেণুবালা দেবী তখন অথৈ সাগরে। আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভাল না। তাই বেশিদূর লেখাপড়া চালাতে পারেননি তিনি। গীতা দে-র মা আবার বিয়ে করলেন। পরবর্তী তাঁর আরও দুটি ভাই-বোন হয়। কিন্তু তাঁর সৎ বাবা তাঁদের দায়ভার নিতে অস্বীকার করেন। এরপর হঠাৎই মায়ের মৃত্যু হয়। পনেরো বছর বয়সেই ভাই-বোনেদের ভার এসে পড়েছিল বাড়ির বড় মেয়েটির উপরেই। সেই সময় কালিন্দী নাটকের গান গেয়ে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন-ভূমিহীন উপভোক্তাদের জমি-সহ বাংলার বাড়ি মিলবে মার্চের মধ্যেই

সংসার–সুখ সইল না
সেই ছ’বছর থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত টানা তিনি সিনেমা ও থিয়েটারে অভিনয় করে গেছেন। এরপর ছেদ পড়ে কারণ ১৫ বছরে বিয়ে হয়ে যায় গীতার। ধনী ব্যবসায়ী অসীমকুমার দে’র সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। বিরাট বিত্তশালী শ্বশুরবাড়ি। বাড়ি, গাড়ি, চাকরবাকর কত কিছু। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন কপালে সইল না। নাবালক ভাই-বোনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন বলে স্বামীর তা পছন্দ ছিল না। তিনি মেনে নেননি। অন্যদিকে ছিলেন শাশুড়িমার চক্ষুশূল। শাশুড়ি গোপনে ছেলের অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিলেন। ছোট ভাই বোনগুলোকে নিয়ে অথৈ জলে পড়লেন গীতা। শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। শ্রীরঙ্গমে ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘তখত-এ-তউস’ একের পর এক নাটকে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করে মুগ্ধ করলেন গীতা দে। সেই সময় থেকে অভিনয়কেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। এত কিছুর পরেও তিনি স্বামীর পদবিই ব্যবহার করে গেছেন।
ফিরলেন অভিনয়ে
বিয়ের পাঁচবছর বাদে তিনি ফিরছিলেন অভিনয় জীবনে। সেই সময়েই প্রখ্যাত নট ও পরিচালক শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সংস্পর্শে আসেন। গ্রুপ থিয়েটারে তখন তিনি অভিনয় করেছেন তুলসী লাহিড়ী, শম্ভু মিত্র, তুলসী চক্রবর্তী, জ্ঞানেশ মুখার্জি, কালী সরকার, কানু ব্যানার্জি, দিলীপ রায় প্রমুখের সঙ্গে। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন পর্দায়, থিয়েটারের, মঞ্চে। কয়েকশো বাংলা ছবি রয়েছে তাঁর ঝুলিতে, বহু জনপ্রিয় নাটক উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। তৎকালীন তাবড় পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’। সত্যজিৎ রায়ের তিনকন্যার সমাপ্তিতে অভিনয় করেন গীতা দে। অভিনয় করেছেন তপন সিংহের ‘হাটেবাজারে’, ‘জতুগৃহ’, ‘এখনই’ ছবিতে। অজয় করের সঙ্গে ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘নৌকাডুবি’, ‘মাল্যদান’। অরবিন্দ মুখার্জির ‘নিশিপদ্ম’, ‘দুই ভাই’, ‘বর্ণচোরা’ ‘মৌচাক’ ও আরও অনেক ছবিতে কাজ করেন। ১৯৫৬ সালটি ছিল তাঁর কাছে একটি যুগান্তকারী বছর। সেই বছর প্রখ্যাত পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দেন অভিনেতা কালী ব্যানার্জি। ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে তিনি বলেছেন— ‘‘ক্যামেরার ব্যবহার এবং শট গ্রহণের ব্যাপারে এত বড় মাপের পরিচালক তিনি আর দেখেননি। তিনি আমার জন্য বেশ কিছু ফিল্মের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেগুলি আর বাস্তবায়িত হয়নি।’’
প্রথাগতভাবে কোনওদিনই তারকা ছিলেন না তিনি কিন্তু জয় করে নিয়েছিলেন আপামর দর্শকদের মন। সেই সময় ছবিতে খলনায়িকা মানেই ছিলেন গীতা দে। হলিউডের কিংবদন্তি অভিনেতা স্যার লরেন্স অলিভিয়া গীতা দে-র অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি ১৯৫৪ সাল থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং রেডিওর বেশ কয়েকটি নাটকে দুর্দান্ত অভিনয় করেন। তাঁর শেষ নাটক ছিল বাদশাহি চাল। ১৯৯৬ সালে উত্তর কলকাতার রঙ্গনা থিয়েটারে এই নাটকটির পরিচালনা করেছিলেন গণেশ মুখোপাধ্যায়। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন; যার মধ্যে ২০০৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বিদ্যা বালন এবং সঞ্জয় দত্ত অভিনীত‍‘পরিণীতা’ উল্লেখযোগ্য।

আরও পড়ুন-রাত দখলের নাটুকেরাই অশ্লীল-কাণ্ডে অভিযুক্ত

তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রের তালিকায় উল্লেখযোগ্যের মধ্যে রয়েছে ইন্দ্রাণী, ডাইনী, কঠিন মায়া, কাঞ্চন মূল্য, সাথী হারা, দুই ভাই, কাঁচের স্বর্গ, শুভ দৃষ্টি, বন্ধন, বর্ণচোরা, সাত পাকে বাঁধা, দুই বাড়ী, ছায়া সূর্য, অভয়া ও শ্রীকান্ত, শেষ পর্যন্ত, পিতা পুত্র, নিশিপদ্মা, ময়দান, মৌচাক, বাঘবন্দী খেলা, দম্পতি, দত্তা, সূর্য সখি, হিরের শিকল, মহাপৃথিবী, সন্তান, পরিণীতা, টলি লাইটস, চিরদিনই তুমি যে আমার, নৌকাডুবি, আহ্বান ইত্যাদি।
জীবনভোর টালমাটাল পরিস্থিতির শিকার গীতা দে।। জীবনের উপান্তে এসে নিঃস্বই ছিলেন। ভাঙাচোরা তেতলা বাড়ি, চুনখসানো, পলেস্তারা বেরনো দেওয়াল। জীবনের উপান্তে এসে এই বাড়িতেই থাকতেন অভিনেত্রী। শেষ জীবনটা এখানেই কেটেছিল তাঁর। আশি ছুঁই-ছুঁই বয়সে ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতেন। ষাট বছরের অভিনয় জীবনে পাননি কোনও পুরস্কার, পাননি কোনও খেতাব। কিন্তু মানুষের মনে রয়ে গিয়েছেন চিরভাস্বর হয়ে।

Latest article