মাংসখেকো গাছেরা

গাছ আবার শিকার করে! মাংস খায়! শুনতে অদ্ভুত শোনালেও বিশ্বে এমন বহু বিস্ময়কর বস্তু রয়েছে। এমন ভয়ঙ্কর অথচ বিরল উদ্ভিদেরা রয়েছে যারা নিজেরা শিকার করে খায়। লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

গাছ আবার মানুষখেকো! এমন হয় নাকি। আসলে মানুষখেকো গাছ সত্যি আছে কি না তার প্রমাণ মেলেনি কিন্তু মাংসখেকো গাছ আসলেই রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন জঙ্গল ঘেঁটে এমন প্রায় ৪৫০ প্রজাতির গাছের সন্ধান মিলেছে, যারা সালোকসংশ্লেষের পাশাপাশি নানা ফাঁদের সাহায্যে কীটপতঙ্গ, ছোট ছোট প্রাণীর মাংস খায়। বেঁচে থাকার তাগিদে গাছেরা মাটি থেকে জল এবং বিভিন্নরকম খনিজ পদার্থ সংগ্রহ করে। সূর্যের উপস্থিতিতে গাছেরা এই সব উপাদানের সঙ্গে কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিলিত হয়ে গাছের বাড়-বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় খাবার তৈরি করে। গাছের জীবনধারণের জন্য জল, আলো, বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়াও একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল নাইট্রোজেন। সেই জন্য নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ মাটিতে গাছ খুব ভাল হয়। কিন্তু সব গাছ মাটি থেকে অন্য উপাদান পেলেও নাইট্রোজেন পায় না। যেমন এই মাংসাশী উদ্ভিদেরা। তারা যেহেতু ভেজা, স্যাঁতসেঁতে নিচু জলাভূমিতে হয় সেই মাটিতে নাইট্রোজেন খুব কম থাকে। তাই বেঁচে থাকার জন্য এই সব উদ্ভিদ অন্য একটি পদ্ধতিতে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে। বিভিন্ন প্রাণীকে ফাঁদে ফেলে আটকায় এবং এইসব প্রাণী মারা যাওয়ার পর তাদের মৃতদেহ থেকে খনিজ উপাদান সংগ্রহ করে। মাংসাশী গাছেদের পাতারা তাদের এই বিষয়ে সাহায্য করে।

আরও পড়ুন-তৃণমূল মহিলাদের পদযাত্রা

এই সব উদ্ভিদেরা যেহেতু চলাচল করতে পারে না সেহেতু তারা গায়ের সুমিষ্ঠ গন্ধ দিয়ে, নিজেদের গায়ের উজ্জ্বল রং দিয়ে পোকামাকড়দের আকর্ষণ করে। কোনও কোনও উদ্ভিদের পাতার চারপাশে ছোট মুক্তদানার মতো চকচকে আবরণে ঢাকা থাকে। এগুলো পোকামাকড়, প্রাণীদের আকৃষ্ট করে। দেখতে ভারি সুন্দর— কেমন যেন মায়াময়, অপূর্ব সুবাস, তাকিয়ে চোখ ফেরানো যায় না। কিন্তু সাবধান, ওখানেই লুকিয়ে রয়েছে যত বিপদ!
সূর্য শিশির বা সানডিউ
সাধারণত এই উদ্ভিদ আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে স্যাঁতস্যাতে পরিবেশে জন্মায়।যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘ডোসেরা রোটানডিফোলিয়া’। এর পাতাগুলো ছোট আর গোলাকার লাল ও বেগুনি রঙের হয়, এতে চুলের মতো কর্ষিকা বা তন্তু থাকে। সেই তন্তুর মাথা থেকে চকচকে শিশিরবিন্দুর মতো আঠা বেরয়। ছোটখাটো কীটপতঙ্গ, পাখিরা অনায়াসে আটকে যায় সেই আঠায়। ব্যস আর রক্ষা নেই! কর্ষিকা গুটিয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু ভয়ের বিষয় হল, সম্প্রতি বাঁকুড়ার জয়পুরের জঙ্গলে দেখা মিলেছে এই উদ্ভিদটির। আফ্রিকার কঙ্গোর জঙ্গল থেকে বাঁকুড়ার জয়পুর জঙ্গলের দূরত্ব কয়েক হাজার কিলোমিটার। কী করে পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর, আরব সাগর, নীলনদ, সিন্ধু নদ, গঙ্গা, যমুনা পেরিয়ে সেখানে পৌঁছল এই উদ্ভিদ? উদ্ভিদবিদদের মতে, কোনও ভাবে, কোনও ব্যক্তির লাগেজের সঙ্গে এখানে ডোসেরা রোটানডিফোলিয়া বা সূর্য শিশিরের কোনও বীজ চলে এসেছিল। আর তারপর অনুকূল পরিবেশ পেয়ে তা গজিয়ে উঠেছে। যেভাবেই হোক, তিনটি সাগর আর সপ্ত নদী ডিঙিয়ে আফ্রিকা থেকে এসে জনপ্রিয়তাও আদায় করে নিয়েছে। বাঁকুড়ার জয়পুর জঙ্গল মানেই এখন এই গাছটি দেখার ভিড়।
কলস উদ্ভিদ
জানেন কি পিচার প্ল্যান্ট বা কলস গাছের আশপাশে কোনও ব্যাঙ এলে গাছটি হতভাগা ব্যাঙটিকে ধরে গপ করে খেয়ে ফেলে? এটি ব্যাঙের সব হজম করে ফেলে, শুধু পা’দুটো হজম করতে পারে না। এই গাছটা দেখতে উজ্জল লাল রঙের। ভিতরে ভর্তি সুমিষ্ট রস। ওই রস বা মধুর জন্যই পোকামাকড় পাগলের মতো ছুটে আসে। এই গাছে রয়েছে কলসির মতো লম্বা নল তাই এর অন্য নাম দণ্ড কলস। যখন পোকা বা কোনও প্রাণী ওই নলের মধ্যে দিয়ে মধু খাওয়ার চেষ্টা করে তখন কলসির মুখে থাকা ঢাকনা আপনিই বন্ধ হয়ে যায় আর পোকা আটকে যায়। আর গাছ ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলে ওই মাংস। পাপুয়া নিউগিনি, অস্ট্রেলিয়া, মাদাগাস্কার, সিসিলিস, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জঙ্গলে এই গাছের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে।

আরও পড়ুন-সাসপেন্ড তিন সরকারি আধিকারিক

ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ
সবচেয়ে নামজাদা মাংসখেকো গাছ হল ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ। আমেরিকার উত্তর-দক্ষিণে দেখা মেলে এদের। এই উদ্ভিদের প্রতিটি পাতাই এক-একটি ফাঁদ। পাতার মাপ তিন থেকে ছয় ইঞ্চি যা দুটো ভাগে ভাগ করা থাকে। যখন সেই একটা ভাগে কোনও পোকা বসে তখন পাতার অন্য ভাগে সেই অনুভূতি যাওয়ামাত্র পোকাটি আটকে যায়। সেই সময় ওই তন্তুগুলো নিজেদের একে অপরের সঙ্গে বেঁধে ফেলে চারপাশ দিয়ে আর পোকাটি বেরতে পারে না। পাতার লালাগ্রন্থি থেকে লালা বেরিয়ে পোকামাকড় যাই থাক, গ্রাস করে নেয়। এরপর পোকাটাকে খেতে ওই পাতার সময় লাগে দশদিন। তারপর পাতা আবার খুলে যায় নতুন শিকারের আশায়।
কোবরা লিলি
কোবরা লিলি বা ডার্লিংটোনিয়া ক্যালিফর্নিকা। ভয়ঙ্কর সুন্দর এই গাছটিকে দেখতে ঠিক ফণা তোলা গোখরো সাপের মতো। এই উদ্ভিদ মূলত উত্তর ক্যালিফোর্নিয়া ও ওরিগন রাজ্যের ঠান্ডা ও স্যাঁতসেঁতে জলাভূমিতে জন্মায়। এদের স্বভাব সাপের মতোই আগ্রাসী। এক বিশেষ পদ্ধতিতে গাছের পাতার ভেতরের বিশেষ আলো দেখে পোকারা বুঝতে ভুল করে। পোকাগুলো আলোর দিকে যেতে থাকে। পোকারা ভাবে গাছের ভেতর থেকে তারা বাইরে বের হতে যাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আরও বেশি আটকে যায়।
ব্লাডারওয়র্ট
ব্লাডারওয়র্ট উদ্ভিদটি জলেই জন্মায়। এর আর একটি নাম ইউট্রিকুলারিয়া। এদের পাতা দেখতে ঠিক পেয়ালা আকৃতির। সেই পাতা থেকে তৈরি ছোট ছোট থলির মতো একটা বস্তু যা ঠিক ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মতো কাজ করে। এটাই ফাঁদ। সেই ফাঁদের মুখে গ্রন্থি ও লোমযুক্ত প্যাঁচানো অ্যান্টেনার মতো গঠন থাকে। এই অ্যান্টেনা শিকারকে ফাঁদের দরজায় নিয়ে আসতে সাহায্য করে। শিকার কাছে এলেই ওই থলি দ্রুত খুলে যায় এবং শিকার ভেতরে ঢুকে পড়ে। দিয়ে সরু জলজ প্রাণীকে ফাঁদে ফেলে শিকার করে। খুব আগ্রাসী প্রকৃতির এই গাছ। বিশ্বজুড়ে এই উদ্ভিদের প্রায় ২২০টি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি রয়েছে।

Latest article