সিপিএম শাসনকালে নিয়োগ কেলেঙ্কারি :
১৯৭৭ থেকে ২০১১ সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার ১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে এবং ১৯৯৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ত্রিপুরায় ক্ষমতায় ছিল। এই দীর্ঘ শাসনকালে তারা সমাজবাদ, সাম্য ও দরিদ্রদের ক্ষমতায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিল। কিন্তু এই উচ্চ আদর্শের আড়ালে লুকিয়ে ছিল গভীর দুর্নীতি, পক্ষপাতিত্ব এবং জনগণের বিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার এক কালো অধ্যায়। বিশেষ করে শিক্ষক এবং অন্যান্য সরকারি কর্মী নিয়োগে যে কেলেঙ্কারি ঘটেছে, তা বামফ্রন্টের শাসনের সবচেয়ে কলঙ্কিত দিক। এই প্রবন্ধে আমরা ১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম-এর শাসনকালে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ঘটে যাওয়া দুর্নীতির একটি বিস্তৃত সমালোচনা তুলে ধরব। ত্রিপুরার প্রসঙ্গও উল্লেখ করা হবে যেখানে একই ধরনের কেলেঙ্কারি দেখা গেছে। শিক্ষাবিদদের গবেষণা ও তথ্যের ভিত্তিতে আমরা দেখব কীভাবে সিপিএম তার ক্ষমতা ধরে রাখতে জনগণের স্বার্থকে বলি দিয়েছে।
আরও পড়ুন-স্কুলে যাবই, আস্থা মুখ্যমন্ত্রীর উপরেই
পশ্চিমবঙ্গে নিয়োেগ কেলেঙ্কারি— একটি দুর্নীতির ইতিহাস
১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে শোষিত শ্রেণির মুক্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সিপিএম তার আদর্শ থেকে সরে এসে একটি আমলাতান্ত্রিক যন্ত্রেও পরিণত হয়, যেখানে সরকারি চাকরি বিতরণ রাজনৈতিক আনুগত্যের পুরস্কারে পরিণত হয়। শিক্ষক নিয়োগে যে দুর্নীতি ঘটেছে, তা এর সবচেয়ে জঘন্য উদাহরণ।
১৯৯৬ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) প্রতিষ্ঠার আগে শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব ছিল স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটির হাতে। এই কমিটিগুলো সিপিএম-এর স্থানীয় ক্যাডারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। ফলে, শিক্ষক পদগুলো যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়, দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে বিতরণ করা হত। রণবীর সমাদ্দার তাঁর গ্রন্থ West Bengal under the Left 1977-2011-এ এই প্রক্রিয়াকে ‘‘পৃষ্ঠপোষকতার যন্ত্র” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, বামফ্রন্ট শিক্ষক নিয়োগকে গ্রামীণ ভিত্তি মজবুত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এর ফলে শিক্ষার মান ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কারণ অযোগ্য ব্যক্তিরা শিক্ষকতার দায়িত্ব পেয়েছে। এসএসসি গঠনের পরেও দুর্নীতি থামেনি। সিপিএম কমিশনের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কলুষিত করেছে। পরীক্ষার ফলাফল পরিবর্তন, মেধা তালিকায় হেরফের এবং উত্তরপত্রের মূল্যায়নে কারচুপি ছিল নিয়মিত ঘটনা। অল বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুদীপ্ত গুপ্ত শিক্ষার প্রসারের কথা স্বীকার করলেও এই দুর্নীতির সমালোচনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৭৭ সালে সাক্ষরতার হার ৩৮% থেকে ২০১১ সালে ৭৪%-এ উন্নীত হলেও শিক্ষার গুণগত মান হ্রাস পেয়েছে। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া (সিএজি) ২০০৯-২০১০ সালে শিক্ষা বিভাগে ৪৬,০০০ অনিয়মিত নিয়োগের তথ্য প্রকাশ করে, যা বামফ্রন্টের দুর্নীতির মাত্রা স্পষ্ট করে।
শিক্ষার বাইরেও, স্বাস্থ্য, কেরানি পদ এবং পঞ্চায়েতের মতো স্থানীয় শাসন সংস্থায় নিয়োগে একই দুর্নীতি দেখা গেছে। পার্থ চট্টোপাধ্যায় তার গবেষণায় বামফ্রন্টের ‘‘পার্টি-সমাজ” মডেলের কথা বলেছেন, যেখানে দল ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনও পার্থক্য ছিল না। স্থানীয় দলীয় কমিটিগুলো নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিত, যাতে শুধুমাত্র সিপিএম-এর সমর্থকেরা চাকরি পায়। সেন্টার অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস (সিআইটিইউ), সিপিএম-এর শ্রমিক সংগঠন, এই দুর্নীতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি (খণ্ড ৪৯, ১৮ জানুয়ারি ২০১৪) সমাদ্দারের গ্রন্থের সমালোচনায় বলেছে, বামফ্রন্টের শাসন ‘‘দুর্নীতি ও সঞ্চয়ের প্রবণতা” দ্বারা চিহ্নিত হয়ে উঠেছিল।
ত্রিপুরায় নিয়োগ কেলেঙ্কারি
একই গল্পের পুনরাবৃত্তি ত্রিপুরায় ১৯৯৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট শাসন করেছে। সরকারের ব্যক্তিগত সাদাসিধে জীবনযাপনের প্রচার থাকলেও তার শাসনকালে নিয়োগে দুর্নীতি অব্যাহত পশ্চিমবঙ্গের মতোই, ত্রিপুরায় শিক্ষক নিয়োগ ছিল দুর্নীতির একটি প্রধান ক্ষেত্র।
শুরুর দিকে, শিক্ষক নিয়োগ স্থানীয় দলীয় ইউনিটগুলোর হাতে ছিল। চাকরি পেতে হলে সিপিএম-এর প্রতি আনুগত্য প্রমাণ করতে হত। টিচার্স রিক্রুটমেন্ট বোর্ড, ত্রিপুরা (টিআরবিটি) গঠনের পরেও এই প্রক্রিয়া বদলায়নি। বিরোধী দলগুলো, যেমন কংগ্রেস ও পরে বিজেপি, অভিযোগ করেছে যে পরীক্ষার ফলাফল ও মেধা তালিকায় কারচুপি করে দলীয় সমর্থকদের সুবিধা দেওয়া হত। ২০১৭ সালে শুরু করে ২০০২-২০০৬ সালের মধ্যে ১০,০০০-এর বেশি শিক্ষক নিয়োগের একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করে। আদালত রায় দেয় যে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ছিল না এবং এতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল। এই রায় বামফ্রন্টের বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস করে এবং ২০১৮ সালে তাদের পরাজয়ের পথ প্রশস্ত করে।
শিক্ষা ছাড়াও, স্বাস্থ্য, পাবলিক ওয়ার্কস এবং সমবায় সমিতিতে নিয়োগে একই দুর্নীতি দেখা গেছে। পঞ্চায়েতগুলো পৃষ্ঠপোষকতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। সিআইটিইউ এখানেও দলীয় স্বার্থ রক্ষার ভূমিকা পালন করেছে।
দুর্নীতির প্রক্রিয়া ও প্রভাব পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় নিয়োগ কেলেঙ্কারির পদ্ধতি একই রকম ছিল। প্রথমত, সিপিএম তার ক্যাডার-ভিত্তিক কাঠামোর মাধ্যমে নিয়োেগ নিয়ন্ত্রণ করত। দ্বিতীয়ত, এসএসসি বা টিআরবিটির মতো প্রতিষ্ঠান গঠনের পরেও রাজনৈতিক চাপে সেগুলো দলের হাতে থাকত। তৃতীয়ত, স্বাধীন তদারকির অভাবে দুর্নীতি অব্যাহত ছিল।
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ত্রিপুরায় ১০,০০০ শিক্ষকের চাকরি বাতিল স্কুলগুলোকে বিশৃঙ্খল করে দেয়। স্বাস্থ্য, প্রশাসন এবং স্থানীয় শাসনে একই প্রভাব পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালে এবং ত্রিপুরায় ২০১৮ সালে বামফ্রন্টের পরাজয় এই দুর্নীতির ফল। ভট্টাচার্য তাঁর বিশ্লেষণে বলেছেন, বামফ্রন্ট নৈতিক কর্তৃত্ব হারিয়েছে।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর কথায় আশ্বস্ত, আবার স্কুলে যাবেন রায়গঞ্জের কৃষ্ণমৃত্তিকা
উপসংহার
১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সিপিএম শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গে এবং ত্রিপুরায় নিয়োগ কেলেঙ্কারি তাদের দুর্নীতির প্রমাণ। শিক্ষক ও সরকারি কর্মী নিয়োগে পৃষ্ঠপোষকতা ও কারচুপি শিক্ষা ও প্রশাসনকে ধ্বংস করেছে। সমাদ্দার, চট্টোপাধ্যায় এবং ভট্টাচার্যের গবেষণা এই বিশ্বাসঘাতকতার চিত্র তুলে ধরে। বামফ্রন্টের পতন শুধু পরাজয় নয়, জনগণের ন্যায্য ক্ষোভের ফল।