গত বছর দুবাইয়ে ধুমধাম করে বিয়ে হয় বিঘ্নেশ কৃষ্ণস্বামী এবং অনন্যা সওয়ান্তের। ২৭ বছরের বিঘ্নেশ দুবাইতে হসপিট্যালিটি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। ২২ বছর বয়সি অনন্যা একজন স্কুলশিক্ষিকা। কেন হঠাৎ ওঁদের কথা বলছি? তার কারণ বিঘ্নেশ এবং অনন্যা বিয়ের পাত্র-পাত্রী, দুজনেই ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত। এই নবদম্পতির বিয়ের কাহিনি তখন নজর কেড়েছিল সকলের। ডাউন সিনড্রোম-যুক্ত মানুষজন কি স্বাভাবিক
আরও পড়ুন-উত্তর-পূর্বের একমাত্র বাংলাতেই SIR, পিছনের দরজা দিয়ে NRC-র চক্রান্ত! তীব্র আক্রমণ অভিষেকের
জীবনযাপন করতে সক্ষম?
এ এক চিরাচরিত প্রশ্ন। কারণ ডাউন সিনড্রোম কী সেই নিয়ে কোনও ধারণাই নেই অনেকের কাছে। বেশিরভাগই এই অসুখটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। তাই আগে জানতে হবে ডাউন সিনড্রোম আসলে কী?
শরীরে জিনগত ত্রুটিই কিন্তু ‘ডাউন সিনড্রোম’ হওয়ার মূল কারণ। বেশিরভাগ মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে অর্থাৎ মোট ৪৬টি। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্রোমোজোমে ২১-এর একটি অতিরিক্ত কপি থাকে, যার অর্থ তাদের কোষে ৪৬টির পরিবর্তে ৪৭টি ক্রোমোজোম থাকে। অর্থাৎ ২১তম ক্রোমোজমটি দু’টির বদলে তিনটি থাকে। সেই কারণে এই অসুখ ‘ট্রাইজোমি-২১’ নামেও পরিচিত। এই রোগ হলে শিশু শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিজনিত কিছু সমস্যা নিয়েই জন্ম নেয়।
অক্টোবর হল ডাউন সিনড্রোম সচেতনতা মাস। ন্যাশনাল ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি ১৯৮০ সালে শুরু করে এই মাস পালন। এরপর থেকে প্রতিবছর অক্টোবর জুড়ে চলে ডাউন সিনড্রোম সচেতনতা কর্মসূচিও। ডাউন সিনড্রোম বা ট্রাইজোমি ২১ হল একটি গুরুতর জেনেটিক ডিজর্ডার বা ক্রোমোজোমাল ব্যাধি।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ডাউন সিনড্রোম আক্রান্তকে এই সমাজের একাংশ পাগল বলে চালাতে মরিয়া। যদিও এখন ডাউন সিনড্রোম নিয়ে প্রতি বছর সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালনের ফলে বেড়েছে সচেতনতা। ডাউন সিনড্রোম সচেতনতা মাস পালনের উদ্দেশ্য মানুষকে বোঝানো যে এই অসুখের শিকার শিশু, কিশোরও স্বাভাবিক এবং সুস্থ জীবনযাপনে সক্ষম। ওদের প্রয়োজন শুধু একটু বিশেষ যত্নের। আর সেই যত্নের প্রয়োজন রয়েছে বলেই ওদের বলা হয় স্পেশ্যাল চাইল্ড বা বিশেষভাবে চাহিদাসম্পন্ন শিশু। ডাউন সিন্ড্রোম বা যে কোনও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর ক্ষেত্রেই জরুরি হল প্রশিক্ষণ। সেই কারণেই এই শিশুর বাবা-মাকে অনেক যত্নশীল, সতর্ক এবং সচেতন হতে হয়। প্রাথমিকভাবে কঠিন মনে হলেও বিষয়টা একটা সময় সহজ হয়ে আসে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে মায়ের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুর জন্মের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। ৩৫ বছর বা তার বেশি বয়সি মহিলাদের ডাউন সিনড্রোম বা অন্য কোনও ধরনের জেনেটিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আবার ৩৫ বছরের কম বয়সি মহিলা যাঁদের প্রজনন হার বেশি, তাঁদের সন্তান জন্মেও ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়।
শারীরিক বৈশিষ্ট্য
নাক বসা বা চ্যাপ্টা।
একটু উপরের দিকে কোণাকুণি ওঠা চোখ। চোখের দৃষ্টিতে একটা অস্বাভাবিকতা থাকে।
গলা ছোট বা বসা।
কান, হাত, পা ছোট ছোট মাপের।
মাংসপেশির দুর্বলতা।
ছোট ছোট আঙুল বিশেষ করে বুড়ো আঙুল ভিতরের দিকে ঢোকানো ছোট ধরনের।
এমন শিশুদের গড় উচ্চতা কম হয়।
কানে সংক্রমণ হতে পারে। শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়।
দৃষ্টির সমস্যা, চোখের রোগ।
দাঁতের সমস্যা।
ঘন ঘন সংক্রমণজনিত অসুস্থতা।
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া।
জন্মগত হৃদরোগ।
একটি নির্দিষ্ট বয়সে অন্যান্য সাধারণ শিশুর থেকে এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর আচরণগত তফাত বিকাশগত কিছু প্রতিবন্ধকতা দেখা যায়। যেমন গ্রস অ্যান্ড ফাইন মোটর স্কিল অর্থাৎ হাঁটাচলা বা নড়াচড়ায় পার্থক্য থাকে। কথা বলা বা ল্যাঙ্গোয়েজ ডেভেলপমেন্ট স্কিল, কগনিটিভ স্কিল বা শেখার ক্ষমতা, খেলাধুলো বা সোশ্যাল অ্যান্ড ইমোশনাল স্কিল এগুলোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থাকে এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এগুলোকে বাড়াতে বলা হয়। এই ধরনের শিশুদের টয়লেট প্রশিক্ষণ, প্রথম শব্দ উচ্চারণ করা, নিজে হাতে খাওয়া, প্রথম হাঁটা— এগুলো শিখতে সময় লাগে। অর্থাৎ সাধারণ আচরণবিধিগুলো শিখতে হয়। যেটা অনেক বাবা- মায়ের কাছে কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু যত্নসহকারে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিতে থাকলে ডাউন সিনড্রোমের আক্রান্তরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে সক্ষম হয়।
ডাউন সিনড্রোম যুক্ত শিশুর ব্যবহারিক বিকাশও কম হয়। এই ধরনের শিশুরা একটু জেদি, একগুঁয়ে হয়। মনোযোগে সমস্যা হয়। অবসেসিভ, কমপালসিভ বিহেভিয়ার দেখা দেয় অর্থাৎ এক কাজ বারবার করতে থাকা, অতিরিক্ত ভয়, কোনও শব্দ বারবার বলা ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-মন-থা’র প্রভাব পড়বে বাংলায়! প্রস্তুতি রাজ্যের
ডাউন সিনড্রোমের চিকিৎসা
ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর চিকিৎসা একটা গোটা টিম ওয়র্ক অর্থাৎ একদল দক্ষ প্রশিক্ষকের প্রয়োজন। কোনও একজন বা দুজনের কাজ নয় এটা। ফিজিশিয়ান, স্পেশাল এডুকেটর, স্পিচ থিরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট-সহ আরও অনেকে মিলে চিকিৎসা করেন। প্রত্যেকেই শিশুর, রোগীর সঙ্গে কথা বলেন কারণ এই জেনেটিক ব্যাধির অন্যতম দাওয়াই হল কথোপকথন এবং রোগীর মধ্যে শক্তি ও সাহস বাড়িয়ে তোলা। ডাউন সিনড্রোমযুক্ত শিশুদের হজমের সমস্যা থাকেই ফলে নিয়মিত স্পেশ্যাল ডায়েটে থাকতে হয় সেক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ডায়েটেশিয়ান তালিকা তৈরি করে দেন। সেই সঙ্গে ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি খুব জরুরি। কাউন্সিলিং করা এবং কার্ডিওভাস্কুলার দিকটাও নিয়মিত দেখা হয়। ডাউন সিনড্রোম-যুক্ত অনেক শিশুর জন্মগত হৃদরোগ থাকে, যার জন্য বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়া রয়েছে মেডিকেশন। সর্বোপরি জরুরি পরিবারের সচেতনতা, সহযোগিতা, যত্ন, নজরদারি যাতে ডাউন সিনড্রোম-যুক্ত বিশেষ চাহিদাসম্পন্নরা স্বাধীন, সুস্থ এবং সক্রিয় জীবনযাপন করতে পারে। শিশু, কিশোর বা প্রাপ্তবয়স্ক— ডাউন সিনড্রোম যারই থাকুক তাঁদের চিকিৎসা পদ্ধতি মোটামুটি একই।

