ছেলের আজ রেজাল্ট। সকাল থেকে পেটে মোচড় দিচ্ছে। এই নিয়ে তিন-চারবার বাথরুমে ছুটল অজপা। কোনওরকম উদ্বেগ, টেনশন হলেই ওর এরকমটা হতে থাকে। অজপার আবার কস্টিপেশনও রয়েছে। কখনও পেট ভয়ঙ্কর লুজ তো কখনও টাইট। বাওয়েল মুভমেন্ট নিয়ে ওর বরাবরের সমস্যা ছিল যা দিনে দিনে বেড়েছে।
ঘন ঘন বাথরুমে ছোটা বা টেনশনের সময় পেটে মোচড় দেওয়া, হঠাৎ ডায়রিয়াকে অনেকেই সাধারণ পেটের সমস্যা বলে গুরুত্ব দেন না। কিন্তু বিশেষজ্ঞের মতে এটা মোটেই সাধারণ পেটের অসুখের লক্ষণ নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় মলত্যাগের অনিশ্চিত সমস্যার নাম ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম বা আইবিএস। আমাদের গোটা শরীরের সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। সেখান থেকেই সিগনাল আসে ও তার ফলে বাওয়েল মুভমেন্ট হয় দ্রুত। তার পরেই আসে মলত্যাগের বেগ। কিন্তু এই সিগনালিংয়েই ফাংশনাল সমস্যা থাকলে তৈরি হয় আইবিএস। এই রোগে ব্যক্তির নিয়মিত মলত্যাগের অভ্যাসেটাই বদলে যায়। যখন-তখন মলত্যাগের প্রবণতা তৈরি হয়। মানসিক উদ্বেগ এই সমস্যাকে আরও বাড়ায়।
আরও পড়ুন-অবমাননার আর্জি শুনবে সুপ্রিম কোর্ট
ঝালে, ঝোলে, অম্বলে বাঙালিদের মধ্যে ‘আইবিএস’ আম-ঘটনা। শুধু ভারত নয় পরিসংখ্যান বলছে বিশ্বের কুড়ি থেকে তিরিশ শতাংশ মানুষ পেটের সমস্যায় ভুগছেন। ১০০ জনের মধ্যে প্রতি পঞ্চম এবং দশম ব্যক্তি এই রোগে আক্রান্ত। আইবিএস-এ বেশি ভোগেন কমবয়সিরাই। প্রতিবছর এপ্রিল জুড়ে পালিত হয় বিশ্ব আইবিএস সচেতনতা মাস। এই রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতেই মাসটি উদযাপিত হয়।
আপাতদৃষ্টিতে দেখতে সোজাসাপটা রোগ মনে হলেও এই রোগে জীবনধারণের মান কমে যেতে পারে। কাজ করার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। আইবিএস দীর্ঘস্থায়ী হলে দেখা দিতে পারে অবসাদ, হতাশা, ক্লান্তি, উদ্বেগ।
ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া যে কারণেই গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ইনফেকশন হোক না কেন এটাই আইবিএস-এর প্রাথমিক কারণ। এটি একধরনের গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ব্যাধি যা বৃহদন্ত্র বা কোলনের উপর প্রভাব ফেলে। অতিমারি-পরবর্তীতে আইবিএস রোগী-সংখ্যা বেড়েছে।
আইবিএস দু-ধরনের সমস্যা তৈরি করে প্রথম ডায়ারিয়া বা পেট খারাপ এবং দ্বিতীয় কনস্টিপেশন বা কোষ্ঠকাঠিন্য অর্থাৎ পেট পরিষ্কার না হবার সমস্যা।
আইবিএস-আক্রান্ত ব্যক্তির দু’ধরনের অন্ত্রের পেশির সংকোচন দেখা যায়। কিছু সংকোচন শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী হয় এর ফলে ডয়ারিয়া হয় এবং অপর ক্ষেত্রে সংকোচন দুর্বল এবং ক্ষণস্থায়ী হয় এর ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়।
উপসর্গ
পেটে ব্যথা এবং ব্যথার মাঝেই খিঁচুনি ধরে। পেটে ব্যথা করে সাধারণত মলত্যাগ হয়। শারীরিক অস্বস্তি থাকে সারাক্ষণ।
মলত্যাগের পরিবর্তন হয় অর্থাৎ আপনার হয়তো স্বাভাবিক মলত্যাগ হত হঠাৎ করেই কোষ্ঠকাঠিন্য। আবার মাঝেমধ্যে ডায়ারিয়া হতে পারে।
পেটে এবং শরীরে একটা ফোলা ভাব থাকে বা গ্যাসের সমস্যা তৈরি হয় ফলে বেশ অস্বস্তি হতে পারে।
কিছু-কিছু ক্ষেত্রে বমি-বমি ভাব, মলের সঙ্গে শ্লেষ্মা অথবা মলত্যাগের পর সম্পূর্ণ না হওয়ার অনুভূতি হয়।
আইবিএস পরীক্ষা
আইবিএসে ধরা পড়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনও পরীক্ষা নেই। পেটব্যথা, ক্রাম্প, একটানা হজমের সমস্যা হতে থাকলে চিকিৎসক উপসর্গ বুঝে কিছু পরীক্ষা করতে দেন যেমন— কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি), মলপরীক্ষা, কোলনোস্কোপি, এন্ডোস্কোপি ইত্যাদি তাতে বোঝা যায়, অন্য কোনও অসুখ আছে কি না। এরপর আইবিএস-এর চিকিৎসা শুরু হয়।
কী খাবেন না
আইবিএস কিন্তু এখন লাইফ স্টাইল ডিজিজ। এই রোগ নিয়ন্ত্রণে আনার বড় উপায় হল খাবার এবং জীবনযাত্রায় বদল আনা।
আপেল, ড্রাইফ্রুটস, ফ্রুট জুস যেগুলিতে ফ্রুকটোজ রয়েছে এবং কলা, ব্লুবেরি, আঙুর, স্ট্রবেরি, ক্র্যানবেরি, আম, পিচ, বরই, তরমুজ ইত্যাদি ফল খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।
উচ্চ ফাইবার রয়েছে এমন খাবার খাদ্যতালিকায় রাখবেন না। এতে গ্যাস এবং ফোলাভাব আসতে পারে।
বিশ্বের ৭০% বয়স্ক মানুষ শরীরে বেশি পরিমাণে ল্যাকটোজ তৈরি করতে পারে না। দুগ্ধজাত দ্রব্য বেশি খেলেই আইবিএসের রোগীর শরীরে ফোলাভাব আসে, গ্যাস তৈরি হয়। তাই দুগ্ধজাত দ্রব্য বাদ দিতে হবে।
কাঁচা রসুন, পেঁয়াজ, শসা, মুলা এবং ঝাল বা স্পাইসি খাবার বাদ দিতে হবে। অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে।
সফট ড্রিঙ্কস, অ্যালকোহল, তামাক, জর্দা, সিগারেট বাদ দিতে হবে।
হার্ড চিজ, মেয়োনিজ, পনির বাদ দিতে হবে। গমের জিনিস, বিস্কুট, রুটি, পাউরুটি ইত্যাদি, রাই, কৃত্রিম মিষ্টির খাবার বাদ দিতে হবে।
সবজির মধ্যে ব্রকোলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রাসেলস স্প্রাউট, এগুলো খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।
ছোলার ডাল, কালো ডাল, মুসুর ডাল আইবিএস রোগীর জন্য সহজপাচ্য নয়। নারকেল, চিনি বাদ দিতে হবে।
কী খাবেন
ল্যাকটোজ ফ্রি দুধ, সয়া মিল্ক, রাইস মিল্ক, শেডার চিজ, লপালমেশন চিজ খেতে হবে। মাখনের বদলে ব্রেড স্প্রেড যাতে দুধ নেই। প্রোবায়টিক হিসাবে দই খান।
প্রোটিনে চিকেন, ডিম, মাছ, চিংড়ি, টোফু, বিফ, ল্যাম্ব, পর্ক খেতে পারেন।
গোটা শস্য, ব্রাউন রাইস, ওট্স, কিনোয়া খেতে পারেন।
অলিভ অয়েল আর নারকেল তেল খান।
ফলের মধ্যে কলা, ব্লুবেরি, কিউয়ি, লেবু, কমলা, আনারস, স্ট্রবেরি, পেঁপে খেতে পারেন।
সবজিতে পালং, গাজর, বেল পেপার, বেগুন, টম্যাটো, বিন স্প্রাউট খেতে পারেন।
বাদাম এবং আমন্ড, চিনে বাদাম, আখরোট, কুমড়ো-তিল, সূর্যমুখীর বীজ, আখরোট খেতে পারেন।
আইবিএস-এর রোগী একবারে অনেকটা না খেয়ে বারে বারে ছোট ছোট মিলে খান। প্রতিদিন নিয়ম মেনে শরীরচর্চা, যোগাসন করুন।