মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস

জুন হল মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস সচেতনতা মাস। এটি একটি বিরলতম অটোইমিউন নিউরোমাসকুলার অসুখ। বিরল হলেও গোটা বিশ্ব জুড়ে এই রোগের পরিসংখ্যান খুব একটা কম নয়। তাই এই মাস জুড়ে চলে রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি কর্মশালা ও প্রচারাভিযান। কী এই মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস? কেন হয় এই অসুখ? চিকিৎসাই বা কী? লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

কদিন ধরেই একবার বসলে আর উঠতে পারছিল না সুহিনা। খুব দুর্বল বিশেষ করে বিকেলের পর থেকে। কিছুদিন পর থেকে চোখ ছোট হতে শুরু করে। ঠিক করে তাকাতে পারছিল না। পলক পড়ে যাচ্ছিল। দু-তিনটে ভিশন আসতে শুরু করে ফলে রাস্তা পার হতে পারত না সে। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না যে কী করবে। শেষে চক্ষু চিকিৎসকের যায় সুহিনা। ভাবল চোখেই কোনও সমস্যা হয়েছে। কিন্তু চোখ পরীক্ষার পর দেখা গেল তার চোখে কোনও সমস্যাই নেই। তখন ডাক্তার ব্রেন এমআরআই করতে বলেন কিন্তু তাতেও কিছু বেরয় না। এরপর নিউরোর কিছু পরীক্ষা করাল সেখানেও সদুত্তর মিলল না। বিভিন্ন চিকিৎসক বিভিন্ন কথা বলতে থাকেন। এরপর একদিন তার চিবিয়ে খেতে গেলে কষ্ট হল। ভাত ঠিকমতো খেতে পারল না। বেশকিছুদিন জ্যুস খেয়ে থাকল। হাঁটতে গিয়ে পড়েও যাচ্ছিল। দিশেহারা সুহিনা কী করবে! ঠিক তখনই একজন চিকিৎসক সুহিনাকে মায়েস্থেনিয়া গ্র্যাভিস টেস্ট করতে দেন। আর সেই পরীক্ষায় সুহিনার রিপোর্ট পজিটিভ হয়। এ আবার কেমন রোগ? সারবে তো!
বিশ্ব জুড়ে প্রতি ১০ হাজার জনের মধ্যে প্রায় ২০ জন মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসে আক্রান্ত হন। প্রকৃত সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে, কারণ হালকা উপসর্গ যুক্ত বেশকিছু মানুষ হয়তো জানেনই না যে তাঁদের এই রোগ রয়েছে। ভারতে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস পুরুষদের মধ্যেই বেশি দেখা যায় মহিলাদের থেকে, যেখানে পুরুষ ও মহিলার অনুপাত প্রায় ২.৭ : ১। তাই প্রতিবছর জুন মাসে বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় বিশ্ব মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস সচেতনতা মাস।

আরও পড়ুন-আর কোনওদিন দেখা হবে না ছেলের সঙ্গে মুম্বইয়ের বাড়িতে ক্যাপ্টেন সুমিতের দেহ, কান্নায় ভেঙে পড়লেন বৃদ্ধ বাবা

কী এই মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস
মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস হল নিউরোমাসকুলার ডিসর্ডার বা অটোইমিউন অসুখ।
এমন এক অসুখ যাতে শরীরে রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা ম্যাল ফাংশন করে অর্থাৎ ইমিউন সিস্টেমের অস্বাভাবিক ক্রিয়ার ফলে নার্ভ এবং মাংসপেশির মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শরীরের নিজস্ব রোগ-প্রতিরোধ শক্তি ভুলবশত মস্তিষ্ক ও পেশির স্নায়ুপ্রান্তের সুস্থ কোষকে আক্রমণ করে। অ্যাসিটাইল কোলিন নামক রাসায়নিক যা মস্তিষ্ক ও পেশির মধ্যে পরিবাহিত হয় সেটির ঘাটতির জন্য এই কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে মাংসপেশি ঠিক মতো কাজ করে না, প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং ক্ষতি করে। এটি স্নায়ু বা পেশির মধ্যে রাসায়নিক বার্তার আদানপ্রদানকে প্রভাবিত করে। ফলে পেশির কার্যকলাপ ব্যাহত হতে শুরু করে। একে অটোইমিউন মায়াস্থেনিয়াও (এ এম)বলে। এ এম ছাড়াও এর আরও দুটো ধরন রয়েছে সেগুলো হল—
কনজেনিটাল মায়াস্থেনিয়া
জন্মের পর শিশুর এই রোগ ধরা পড়লে তাকে বলে কনজেনিটাল মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস। এটা আবার ইমিউনিটির কারণে হয় না এটা একটা জেনেটিক পরিবর্তন।
নিওনেটাল মায়াস্থেনিয়া
গর্ভে সন্তান থাকাকালীন কোনও মা যদি মায়াস্থেনিয়ায় আক্রান্ত হন তখন সেই ভ্রূণটি তার মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস আক্রান্ত মায়ের কাছ থেকে কিছু নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি পায়। ফলে জন্মের পর শিশুটির কান্নার অনুভূতি দুর্বল হতে পারে, আরও কিছু লক্ষণ দেখা যায়। এই অস্থায়ী লক্ষণগুলি সাধারণত তিন মাস পরে চলে যায়।
মহিলাদের কমবয়সে এই রোগটি বেশি হয় এবং পুরুষেরা এই রোগে আক্রান্ত হন বেশি বয়সে। এই রোগে সমানভাবে আক্রান্ত হয় শিশুরাও।

আরও পড়ুন-যান্ত্রিক ত্রুটি, মঙ্গলবার বাতিল হল এয়ার ইন্ডিয়ার ৭ আন্তর্জাতিক বিমান, ক্ষুব্ধ যাত্রীরা

কেন হয় এই অসুখ
রোগপ্রতিরোধ শক্তিকে নিয়ন্ত্রণকারী থাইমাস গ্ল্যান্ডের যখন ক্ষতি হয় তখন এই রোগের রিস্ক বেড়ে যায়।
কর্কট রোগের পরবর্তীতে এই অসুখের সম্ভাবনা বাড়ে।
পরিবারে এর আগে কারও এই রোগের ইতিহাস থেকে থাকলে সম্ভাবনা থাকে।


উপসর্গ
মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের প্রাথমিক উপসর্গগুলো হঠাৎ দেখা দেয়। সাধারণত ব্যক্তি যখন সক্রিয় থাকে তখন পেশিগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে ফলে ক্লান্তি লাগে আবার বিশ্রাম নিলে পেশির শক্তি ফিরে আসে। পেশির দুর্বলতা দিনে দিনে বাড়ে। এই রোগাক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষের দিনের শুরুতে নিজেকে বেশ এনার্জিটিক, তন্দুরুস্ত মনে হলেও দিনের শেষে খুব দুর্বল বোধ করেন।
মায়েস্থেনিয়া গ্র্যাভিসে প্রথম আক্রান্ত হয় চোখ। ঝুলে পড়ে চোখ। অর্থাৎ চোখ খুলে রাখা যায় না, পলক পড়ে যায় বারবার। মনে হয় নিচের দিক থেকে কেউ টানছে।
ডবল ভিশন হয় বা দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়।
মুখে পক্ষাঘাত। মুখ বেঁকেও যেতে পারে।
কথা বলতে, চিবোতে এবং খাবার গিলতে অসুবিধা হয়।
মাথা উঁচু করে রাখতে পারা যায় না, নিচে নেমে আসে।
ডায়াফ্রাম এবং বুকের পেশিগুলির দুর্বলতা। শ্বাসকষ্ট।
দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি। শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে অসুবিধে হয়।
বাহু, পা এবং আঙুলে দুর্বলতা। অনেক সময় কোনও একটা হাত অসাড় হয়ে যায়। হাঁটতে গিয়ে পড়ে যাওয়া।
ওজন তুলতে অসুবিধা হয়। গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে যায়।
পরীক্ষানিরীক্ষা
থাইমাস গ্ল্যান্ডের সিটি স্ক্যান, এমআরআই আর থাইরয়েড পরীক্ষা করতে হবে।
পালমোনারি ফাংশন টেস্ট অর্থাৎ শ্বাস নেবার ক্ষমতা চেক করা হয়।
ইলেকট্রোমায়োগ্রাফি যা মাংসপেশির ক্রিয়াশীলতা পরীক্ষা করে।
এন্ড্রোফোনিয়াম ক্লোরাইড টেস্ট এতে মাসল মুভমেন্ট কতটা তার পরিমাপ করা যায়। এছাড়া অ্যাসিটাইল কোলিন পরীক্ষা।
আইসপ্যাক পরীক্ষা।

আরও পড়ুন-মে মাসে দেশে বাড়ল বেকারত্বের হার, কাজ নেই মহিলাদের হাতে

চিকিৎসা
এই রোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি যদি ধৈর্য ধরে করা যায় তাহলে রোগী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। কিছু কিছু অন্য রোগের ওষুধ রয়েছে যা মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিস বাড়ায়। সেগুলো চিকিৎসকের কাছে জেনে নিতে হবে প্রথমেই। সেই ওষুধ বা সেই কম্পোজিশনের ওষুধ কোনওভাবেই খাওয়া চলবে না।
এরপর মেডিকেশন। কিছু ওষুধ রয়েছে যা নিয়মিত খেলে মায়াস্থেনিয়া গ্র্যাভিসের উপসর্গগুলো ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। কিন্তু এর মূল চিকিৎসা হল স্টেরয়েড, প্লাজমা এক্সচেঞ্জ, ইন্ট্রাভেনাস ইমিউনোগ্লোবুলিন এবং সার্জারি যাকে বলা হয় থাইমেকটমি। কার ক্ষেত্রে অসুখটা কত গুরুতর তার ওপর নির্ভর করবে কোন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতে হবে।

Latest article