পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজকে সংক্ষেপে বলা হয় ‘পিসিওডি’। ‘পিসিওএস’ হল পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম। দুটোই হরমোনের ভারসাম্যতার সমস্যা। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর মেয়েদের ডিম্বাশয় থেকে প্রতি মাসে ডিম্বাণু নির্গত হয়। নিষেক না ঘটলে সেই ডিম দেহ থেকে বেরিয়ে যায় রক্তের মাধ্যমে। পিসিওডির ক্ষেত্রে এই ডিম নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে নির্গত হয় না। অপরিণত ডিম বা আংশিক অসম্পূর্ণ ডিম বেরয় এবং তা ডিম্বাশয় ভরে যায়। এগুলো দেহের বাইরে বেরতে পারে না এবং জমে সিস্টের আকার নেয়। ছোট ছোট টিউমারের মতো দেখতে এই সিস্টগুলো তরল উপাদান দিয়ে তৈরি হয়। দেখতে অনেকটা আঙুরের থোকার মতো লাগে যাকে সিস্ট বলা হয়। পলি অর্থাৎ অনেক তাই পলিসিস্ট। ডিম্বাশয় যদি এরকম সিস্ট থাকে তাহলে ডিম্বাণু সম্পুর্ণ হতে পারে না এবং জরায়ুর দিকে এগতে অক্ষম হয়। অন্যদিকে, শুক্রাণু নিষিক্ত হবার জন্য এলে পরিপূর্ণ ডিমটিকে ওই অসম্পূর্ণ সিস্টের ভিড়ে খুঁজে পায় না। ফলে একটা সময়ের পর তা নষ্ট হয়ে যায়। এই কারণেই পলিসিস্ট রয়েছে যাঁদের তাঁদের বন্ধ্যত্ব দেখা দেয় বা সন্তানধারণের নানা জটিলতা তৈরি হয়। হরমোনাল ইমব্যালেন্স, স্ট্রেস, ওবেসিটি, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল থাকলে যেমন এই রোগের সম্ভাবনা রয়েছে তেমনই এটা এখন একধরনের লাইফস্টাইল ডিজিজও। অত্যধিক জাঙ্ক ফুড, তেল মশলাযুক্ত খাবার দীর্ঘদিন খেলে এই রোগ বাড়ে। ইউরিন ইনফেকশনও এই রোগের অন্যতম কারণ। পিসিওসের ক্ষেত্রে ডিম্বাশয় থেকে পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন এতটাই নিঃসরণ হয় যে ডিম্বাশয়ের ধারে ফোস্কার মতো সিস্ট হয়। তাই পিসিওএস যে মেয়েদের থাকে তাঁদের শরীরে পুরুষালি রোম, গোঁফের রেখা দেখা দেয়, প্রজননে সমস্যা দেখা দেয়, গায়ে ঘামের দুর্গন্ধ খুব বেশি হয়।
উপসর্গ বুঝতে হবে
এই রোগের প্রধান উপসর্গ হল পিরিয়ডের সমস্যা বা অনিয়মিত ঋতুস্রাব।
কারও কারও তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। ভারী হয়ে যায় তলপেট।
কারও অতিরিক্ত ফ্লো থাকে একটানা আবার একই সঙ্গে ভীষণ অনিয়মিত হয় এবং এক মাসে দুবারও ঋতুস্রাব দেখা দেয়।
ঋতুস্রাবের সময় ব্লাড ক্লট হয়ে নির্গত হয়। পেটে ক্রাম্প ধরে।
প্রচণ্ড মুড স্যুইং হয়। মাথার যন্ত্রণা হয় এবং ব্রেস্টেও ব্যথা হয়।
খুব ওজন বেড়ে যায় অনেকের। আবার কেউ কেউ খুব শুকিয়ে যান।
মুখ ভীষণ তৈলাক্ত থাকে। খুব ব্রণ হয়। শরীরে বিভিন্ন অংশে অবাঞ্ছিত রোমের সমস্যা দেখা দেয়। চুল পড়ার সমস্যাতেও ভোগেন অনেকে।
কোন বয়সে দেখা দেয়
সাধারণত সদ্য ঋতুচক্র শুরু হয়েছে এমন মেয়েরাই বেশিরভাগ পিসিওডি বা পিসিওএসের সমস্যায় ভোগেন। ওজন যার যত বেশি তাঁর এই ধরনের সমস্যা তত বেশি। যেহেতু সচেতনতা কম এই অসুখে তাই অনেক মেয়েই বিয়ের পর সন্তানধারণ নিয়ে জটিলতায় ভোগেন। হয়তো দেখা গেল আগে থাকতেই ঋতুচক্রের সমস্যায় ভুগছে, অনিয়মিত ঋতুস্রাবের সমস্যা রয়েছে বা একবার শুরু হয়ে একটানা চলছে এছাড়া রয়েছে উপরিউক্ত বিভিন্ন উপসর্গ তখন চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি দেখেন যে পিসিওডি বা পিসিওএস-এর সমস্যা রয়েছে কি না। সেক্ষেত্রে পরীক্ষানিরীক্ষার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই অসুখে আক্রান্ত। এন্ড্রোমেট্রিওসিস থাকলেও এই রোগ হয়। ইউরিন ইনফেকশন থেকেই এই অসুখ হতে পারে।
সচেতনতা নেই
আমাদের দেশে মেয়েদের মধ্যে এই অসুখটি সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। শতকরা ৭০ ভাগ নারী এই রোগ সম্পর্কে অবহিত নন। কারণ এদেশে এই সম্পর্কে যথাযথ শিক্ষার অভাব। বেশিরভাগ পরিবারে মেয়েরা এই সমস্যা বুঝতে পারে না। বুঝলেও বলতে পারে না। কিন্তু পিসিওডি বা পিসিওএসের অবেহলা পরবর্তীকালে নিয়ে আসতে পারে দুরারোগ্য ব্যাধিও। তাই আরও বেশি করে সচেতনতা গড়ে তোলার সময় এসেছে। এই রোগ থেকে যে যে জটিলতাগুলো আসতে পারে মেয়েদের সেগুলো হল বন্ধ্যাত্ব, পেট ফুলে থাকা, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, জরায়ুর ক্যান্সার, ফ্যাটি-লিভার, মানসিক অবসাদ, অ্যাংজাইটি, দুশ্চিন্তাগ্রস্ততা ইত্যাদি।
প্রতিরোধ
সবার আগে জরুরি সচেতন হওয়া। এরপরে যেটা দরকার তা হল জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। রোজকার খাওয়াদাওয়া অর্থাৎ ডায়েট, ওজন সবটাই এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই অসুখ চিহ্নিত করার জন্য চিকিৎসক একটা আলট্রাসোনোগ্রাফি টেস্ট করতে বলেন এতেই পিসিওডি বা পিসিওএস রয়েছে কি না তা ধরা পড়ে যায়। এরপর তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে বিশেষ করে পেটের মেদ ঝরিয়ে ফেলতে হবে।
পেটের মেদ কমলে সিস্ট কমবে, ওজন কমলে ওভিউলেশন বাড়বে, ঋতুস্রাব নিয়মিত হবে। ডায়াবেটিস এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রিত হবে। অবাঞ্ছিত রোম গজানো কমবে। আর শারীরিক কসরত মানসিক অবসাদ, অ্যাংজাইটি দূর করতে সাহায্য করবে। এর পাশাপাশি থাইরয়েড বা শুগার থাকলে তার চিকিৎসা জরুরি।
ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোনসমৃদ্ধ ওরাল বার্থ কন্ট্রোল পিল বা জন্মনিয়ন্ত্রক বড়ি এই রোগের এক দীর্ঘমেয়াদি সফল চিকিৎসা। এই বড়ি অতিরিক্ত এন্ড্রোজেন নিঃসরণ রোধ করে। এন্ড্রোজেনের প্রভাব কমায়। ঋতুস্রাব নিয়মিত করে। জরায়ুর ক্যানসার হবার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয় অনেকটা।
এছাড়াও আরও কিছু মেডিকেশন রয়েছে। যা ব্লাড শুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনে। কোলেস্টেরল কমায়, বন্ধ্যাত্ব প্রতিরোধ করে। ব্রণ বা অ্যাকনে কমায় যেটা এই অসুখের কারণেই বাড়ে। চার থেকে ছ’মাস এইভাবে চললে ওভিউলেশন শুরু হয়ে যায় স্বাভাবিকভাবেই। এর পাশাপাশি অবাঞ্ছিত রোম এবং অ্যাকনে ট্রিটমেন্টেরও পরামর্শ দেন চিকিৎসক। এই অসুখে উচ্চমাত্রায় ফাইবার রয়েছে এমন খাবার রাখুন ডায়েট চার্টে।