জেনোগ্লসি

অজানা ভাষা বলার দক্ষতা সত্যি নাকি মিথ, নাকি এর পেছনে আছে কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। সত্যতা বিচারের জন্য আলোচনায় প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

কী এই জেনোগ্লসি
একই মানুষের বিভিন্ন ভাষায় কথা বলার দক্ষতা তবে সেই ভাষাটিকে না জেনেই বা না শিখেই, বিজ্ঞানের ভাষায় একেই বলে জেনোগ্লসি। এই শব্দটি আসলে এসেছে গ্রিক শব্দ ‘জেনোস’ থেকে, যার অর্থ হল বিদেশি আর ‘গ্লসা’, যার অর্থ হল জিহ্বা বা ভাষা। এই দুইয়ে মিলে হয় জেনোগ্লসি। এই শব্দটি প্রথম ১৯০৫ সালে ফরাসি প্যারাসাইকোলজিস্ট চার্লস রিচেট ব্যবহার করেছিলেন। জেনোগ্লসির বিবরণগুলি নিউ টেস্টামেন্টে অর্থাৎ বাইবেলের নতুন নিয়মেও পাওয়া যায় এবং জেনোগ্লসি সম্বন্ধীয় সমসাময়িক দাবিগুলি প্যারাসাইকোলজিস্ট ছাড়াও আইয়ান স্টিভেনসনের মতো পুনর্জন্ম বিষয়ক গবেষকরাও করেছেন। তবে জেনোগ্লসি আসলেই সত্য ঘটনা কি না সেটি কিন্তু তর্কের দাবি রাখে। আর আদৌ এটা কতটা যুক্তিযুক্ত সেটাও কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার আর্জি জানায়।

আরও পড়ুন-সৌরভের হস্তক্ষেপে খেলা শুরু ইডেনে

ইতিহাসে
ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কানাডিয়ান প্যারাসাইকোলজিস্ট এবং সাইকিয়াট্রিস্ট আইয়ান স্টিভেনসন দাবি করেছিলেন যে কয়েকটি মুষ্টিমেয় ঘটনা রয়েছে যা জেনোগ্লসির প্রমাণ দেয়। এর মধ্যে দুটি ঘটনা অন্তর্ভুক্ত ছিল যেখানে সম্মোহনের অধীনে থাকাকালীন অবস্থায় একটি মানুষ বিদেশি ভাষায় কথা বলার পরিবর্তে বা কেবল বিদেশি শব্দ উচ্চারণ করাতে সক্ষম হওয়ার পরিবর্তে কেবল সেখানকার লোকেদের সঙ্গে কথোপকথন করতে পারে।
স্টিভেনসন আমেরিকান গৃহবধূকে সম্মোহনের পর পরীক্ষা করে দেখেছিলেন যে তিনি ‘জেনসেন জ্যাকোবি’ নামে একটি সুইডিশ কৃষকের পুরুষ ব্যক্তির পরিচয়ে সুইডিশ ভাষায় কথোপকথন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যদিও এটি সাবলীলভাবে নয়। তবে খুব দৃঢ়ভাবে তিনি প্রত্যেকটি কথার সুইডিশ ভাষায় জবাব দেননি। কয়েকটি ভাঙাচোরা শব্দ বলেছিলেন মাত্র। তিনি কোনও জটিল বাক্য বা শব্দ বলতে অক্ষম ছিলেন।
আবার স্টিভেনসন আরেকটি পরীক্ষা করেছিলেন ডলোরেস জে নামে আর এক আমেরিকান মহিলার ওপর। সম্মোহনের পর, সেই মহিলাটি ‘গ্রেচেন’ নামে একটি জার্মান কিশোরীর ব্যক্তিত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। স্টিভেনসন দাবি করেছিলেন যে মহিলাটি জার্মান ভাষায় কথোপকথন করতে সক্ষম হয়েছিল।
তবে এই দুই ক্ষেত্রেই গবেষক থমসন প্রমাণ করেন যে এই মহিলাটিও খুব স্পষ্ট ভাষা বলতে পারেন না এমনকী জার্মান বইও পড়তে পারেন না। কেবল কয়েকটি শব্দ বা অস্পষ্ট বাক্য বলতে পারেন শুধু। আরও খোঁজ চালিয়ে থমসন এও জানতে পারেন যে এই মহিলাটি কোনও জার্মান টিভি প্রোগ্রাম দেখত, তাই কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করা বা অস্পষ্ট বাক্য উচ্চারণ করার যথাযথ বৈজ্ঞানিক যুক্তি এখানে খাটে।
হুলমের বিশ্লেষণ
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, স্ব-ঘোষিত মিশরোলজিস্ট আলফ্রেড হুলমে ইংল্যান্ডের ব্ল্যাকপুলের আইভি কার্টার বিউমন্ট(যিনি ‘রোজমেরি’ নামেও পরিচিত ছিলেন) নামে এক যুবতীকে তদন্ত করেছিলেন, যিনি একটি ব্যাবিলনীয় রাজকন্যার ব্যক্তিত্বের প্রভাবের মধ্যে রয়েছেন বলে দাবি করেছিলেন। হুলমে নিশ্চিত হয়েছিলেন যে তিনি একটি প্রাচীন মিশরীয় উপভাষায় কথা বলেছেন। তবে ভাষাবিদ ক্যারেন স্টলজনোর মতে, ‘‘বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ উঠে আসা তথ্যগুলিকে স্বাধীনভাবে পরীক্ষা করেছিলেন এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে হুলমের বিশ্লেষণগুলি চূড়ান্তভাবে ভুল ছিল। হুলমে মধ্য মিশরীয় এবং প্রয়াত মিশরীয়কে বিভ্রান্ত করেছিলেন’’ এবং সম্ভবত ‘‘অনেক ফলাফল মিথ্যা বলেছিলেন’’।
আবার, ১৭৯১ সালে ইবারহার্ড জিমলিন, একজন জার্মান চিকিৎসক প্রায়শই ‘বিচ্ছিন্ন পরিচয় ব্যাধি’ বা ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার আবিষ্কারের জন্য কৃতিত্ব নিতেন, তিনি মেটালিয়েন ফার ডাই নৃতাত্ত্বিক নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে তিনি স্টুটগার্টের শহর থেকে একজন ২০ বছর বয়সি জার্মান মহিলার একটি ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন। এই মহিলাটি একটি ফরাসি বিমানের জন্য তাঁর ব্যক্তিত্বকে বদলে ফেলেছিলেন তার সঙ্গে বদলে ফেলেছিলেন তাঁর ভাষাও। ‘ফরাসি’ রাজ্যে জিমলিন নিজেকে তাঁদেরই একজন বলে অভিহিত করেছিলেন, তিনি ফ্রান্স দেশ কখনও না-দেখে বা সেখানকার ভাষা না-শিখেই অসম্ভব সুন্দরভাবে ফরাসি বলেছিলেন এবং এসবের পাশাপাশি তিনি কিন্তু তাঁর নিজের মাতৃভাষা, জার্মান মনে রেখেছিলেন, এবং তিনি ফরাসি উচ্চারণ-সহ জার্মান ভাষায় কথা বলতে পেরেছিলেন। যাইহোক, এটি জেনোগ্লসির উদাহরণ হিসাবে গ্রহণ করা যায় না, কারণ মহিলাটি সম্ভবত ফরাসি বিপ্লবের সূচনা, ১৭৮৯ সালে স্টুটগার্টে আগত অভিজাত শরণার্থীদের কাছ থেকে ভাষার শিক্ষা পেয়ে থাকতে পারেন বা তাদের সঙ্গে মিশে এই ভাষা রপ্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-ছবি অপব্যবহারে জঘন্য নোংরামির কড়া জবাব চলবে, ফাঁস কুৎসাকারীর নেপথ্যকাহিনি

ক্রিপ্টোমনেসিয়া
এত আলোচনা-পর্যালোচনা এটাই প্রমাণ করে যে গোটাটাই একটি মিথ্যে তবে এটা আমাদের মেনে নেওয়া একটু কষ্টকর, তাই বিজ্ঞানের ব্যাখ্যাই পারে এই সবকিছুতে আমাদের একটুখানি স্বস্তি দিতে। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বলে এর পিছনে কারণ হচ্ছে ‘ক্রিপ্টোমনেসিয়া’ যা আমাদের কোনও ভুলে যাওয়া স্মৃতি বা ঘটনা বা কথাকে এমনভাবে প্রদর্শন করে যা কিছু কিছু সময় আমাদের বিস্ময়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
১৮৭৪ সালে ক্রিপ্টোমনেসিয়া প্রথম নথিভুক্ত করা হয়েছিল, এটিতে স্টেইনটন মুসা নামক এক ব্যক্তি যিনি এটি বিশ্বাস করতেন যে ভারতে থাকা সম্প্রতি নিহত দুই ভাইয়ের সঙ্গে আধ্যাত্মিকভাবে যোগাযোগের জন্য তিনি সক্ষম ছিলেন। তিনি নাকি তাঁদের সঙ্গে রোজ কথা বলেন কোনও যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও। তবে মানুষের মস্তিষ্কও আজব জায়গা, যেখানে স্মৃতির ঘনঘটা সেই ব্যক্তিকে ভুলিয়ে দিয়েছিল যে এক সপ্তাহ আগেই তিনি ওই দুই ভাইয়ের সম্বন্ধে কাগজে পড়েছিলেন তাই তাদের সমস্ত তথ্য তিনি জানেন বলেই তিনি এটা ধারণা করছেন যে তিনি তাদের চেনেন বা তাদের ভাষায় কথা বলতে পারেন।
আসলে কোনও ঘটনার প্রেক্ষিতে উৎসগুলিকে সঠিকভাবে নিরীক্ষণ করার ক্ষমতা যখন প্রতিবন্ধী হয়ে যায়, তখন ক্রিপ্টোমনেসিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। উদাহরণস্বরূপ, লোকেরা যখন ধারণার মূল উৎস থেকে দূরে থাকে তখন ক্রিপ্টোমনেসিয়া বৃদ্ধি পায় এবং যখন অংশগ্রহণকারীদের তাদের ধারণাগুলির উৎসের দিকে মনোযোগ দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয় তখন এটি হ্রাস পায়। অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে যে ধারণার সময়টিও গুরুত্বপূর্ণ। যদি অন্য কোনও ব্যক্তি স্ব-ধারণা তৈরি করার আগেই কোনও ধারণা তৈরি করে তবে অন্যটির ধারণাটি নিজের হিসেবে দাবি করার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আর এর ফলস্বরূপ আমরা কখনও জেনে বা অজান্তেই এমন কিছু তথ্যকে গ্রহণ করে বসি যা আমাদের রোজনামচার কাছে একেবারে বিদেশি হয়ে ওঠে, এই স্মৃতিগুলোই পরে অবচেতনে এসে এমনভাবে ধরা দেয় তখন এই তথ্যগুলি আমাদের কাছে কীভাবে এল তার উৎসগুলি হারিয়ে যায়, যা কিনা পরবর্তীতে রহস্য, আধিভৌতিক বা পুনর্জন্মের মতো নানান রোমাঞ্চকর গল্পের রসদ জোগায়।

Latest article