অম্বিকা কালনা

মন্দিরের শহর কালনা। অম্বিকা কালনাও বলা হয়। প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক মন্দিরের পাশাপাশি আছে রাজবাড়ি। এছাড়াও আছে আরও কিছু দর্শনীয় স্থান। একদিনের জন্য ঘুরে আসতে পারেন। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা। বলা হয় মন্দিরের শহর। প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক মন্দিরের পাশাপাশি আছে রাজবাড়ি। এছাড়াও সংলগ্ন এলাকায় আছে কিছু দর্শনীয় স্থান। বর্ধমানের রাজারা ছিলেন শিবের উপাসক। তাই তাঁরা কালনা জুড়ে বহু শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কালনা এক সময় ছিল তন্ত্রসাধনার পীঠস্থান। তার বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। অনেকেই মনে করেন, ‘কালী’ থেকেই এই শহরের নামকরণ হয়েছে কালনা। এই শহরের আরাধ্যাদেবী মা-সিদ্ধেশ্বরী। যাঁর পূর্ব নাম অম্বিকা, তাঁরই নামানুসারে এই শহরের নাম ‘অম্বিকা কালনা’। কী কী মন্দির আছে?

আরও পড়ুন-খারিজ মামলা আজ শুনানি

কালনা দর্শনীয় স্থানগুলির অন্যতম ১০৮ শিব মন্দির। স্থানীয়দের কাছে নবকৈলাস মন্দির নামে পরিচিত। জানা যায়, মহারাজা তেজচন্দ্র বাহাদুর ১৮০৯ সালে এই মন্দির তৈরি করেন। মন্দিরগুলো এখন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে রয়েছে। মন্দিরের শৈলী অবাক করার মতো। দুইটি সমকেন্দ্রিক বৃত্তের ওপর তৈরি। ভিতরের বৃত্তে আছে ৩৪টি এবং বাইরের বৃত্তে আছে ৭৪টি মন্দির। তৈরি হয়েছে আটচালা স্টাইলে। ভিতরে আছে একটি করে শিবলিঙ্গ। শোনা যায় এই মন্দিরের দেওয়ালে রামায়ণ আর মহাভারতের গল্প লেখা আছে। প্রথম বৃত্তের মন্দিরগুলোয় প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ শ্বেত অথবা কষ্টিপাথরের। পরের বৃত্তের মন্দিরগুলো কেবলমাত্র শ্বেতপাথরেই নির্মিত। জপমালার প্রতীক হিসেবে মন্দিরগুলো উপস্থাপিত হয়েছে।
কালনা রাজবাড়ির ইতিহাস আর এই কালনা শহরের ইতিহাস একসূত্রে গাঁথা। অষ্টাদশ শতাব্দীর সময়, বর্ধমানের মহারাজারা বেশ কয়েকটি মন্দির নির্মাণ করেন। ওই সময়টাই ছিল কালনার ইতিহাসের সবথেকে গৌরবময় অধ্যায়। জানা যায়, ১৮৪৯ সালে রাজকুমার প্রতাপচন্দ্রের স্ত্রী পেয়ারি কুমারী এই দেউল গঠন শৈলীর প্রতাপেশ্বর মন্দির নির্মাণ করেন। আবার বর্ধমানের মহারাজ কীর্তি চাঁদের মা ব্রজকিশোরী দেবী লালজি মন্দির নির্মাণ করেন। টেরাকোটার কাজ সমৃদ্ধ মন্দিরগুলোর নান্দনিক মূল্য অপরিসীম। কালনার দর্শনীয় স্থান যতগুলি আছে, তারমধ্যে রাজবাড়ি অন্যতম। রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে ঢুকে বাঁদিকে প্রথমে পড়বে প্রতাপেশ্বর মন্দির, রাস মঞ্চ, লালজি মন্দির। ডানদিকে ঘুরলেই বাঁ হাতে পড়বে আরও একটা ছাদওয়ালা স্ট্রাকচার। একটু এগিয়েই সামনে পঞ্চরত্ন মন্দির, বিজয় বৈদ্যনাথ মন্দির আর ডানদিকে পড়বে কৃষ্ণচন্দ্রজি মন্দির।
প্রতাপেশ্বর মন্দির ১৮৪৯ সালে তৈরি হয়। একটি উঁচু ভিতের ওপর বানানো। আকারে সব থেকে ছোট হলেও এই মন্দিরের টেরাকোটার কাজ দেখার মতো। মন্দিরের চারদিকে আছে পোড়ামাটির কাজ। যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি এবং প্রধান মহাকাব্যের দৃশ্যগুলোর বিশেষ উপস্থাপনা।

আরও পড়ুন-লগ্নিতে টাটাও আগ্রহী : মুখ্যমন্ত্রী

প্রতাপেশ্বর মন্দিরের ঠিক ডানদিকেই রয়েছে অষ্টভুজাকার রাসমঞ্চ। রাসমঞ্চের ছাদ বহুদিন আগেই ভেঙে গেছে। এখন রাসমঞ্চের বাকি অংশ ২৪টি পিলারের উপর দাঁড়িয়ে। রাস উৎসবে সাধারণ মানুষ এখানে লালজি ও মদন গোপালজিউয়ের গল্প বর্ণনা করেন।
রাসমঞ্চ থেকে সামনে এগোলেই একটি দরজা পড়ে। সেটা দিয়ে ভিতরে ঢুকলেই দেখতে পাওয়া যায় লালাজি মন্দির। ১৭৩৯ সালে তৈরি। এটা এই মন্দির চত্বরের প্রাচীনতম মন্দির, যা মহারাজা জগৎ রামের স্ত্রী ব্রজকিশোরী দেবী তৈরি করেছিলেন। এই মন্দিরটি রাধাকৃষ্ণের আরাধনার জন্য বানানো। ইট দিয়ে তৈরি। পঞ্চবিংশতি রত্ন স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। মোট তিনটি তলা আর ২৫টি চূড়া আছে। এছাড়াও মন্দিরের সামনে আছে একটি চার চালা নাটমঞ্চ। এই মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ মুগ্ধ করবেই।
লালজি মন্দির থেকে বেরিয়েই বাঁদিকে গেলে চোখে পড়বে পঞ্চরত্ন মন্দির। ঊনবিংশ শতাব্দীতে তৈরি। পাঁচটি মন্দিরের প্রতিটির আকৃতি অন্যটির থেকে আলাদা। পঞ্চরত্ন মন্দির থেকে সামনে এগিয়েই ডানদিকে আছে কৃষ্ণচন্দ্রজি মন্দির।
কালনার দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির। শহরের প্রাচীনতম মন্দির। হাজার বছরের পুরনো এই দেবীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু জনশ্রুতি। সিদ্ধেশ্বরী বাড়ির কাছের গঙ্গার ঘাট যা অম্বুয়ার ঘাট বা সিদ্ধেশ্বরী ঘাট নামে প্রসিদ্ধ। মন্দিরের ফলক থেকে জানা যায়, ১৭৪১ সালে বর্ধমানের মহারাজা চিত্রসেন, অম্বরীশ ঋষির উপাস্য দেবী মাতা অম্বিকা বা সিদ্ধেশ্বরীর মন্দির পুনর্নির্মাণ তথা সংস্কার করান। কিন্তু জনশ্রুতি অনুসারে আরও অনেক আগে, আনুমানিক ১৬০০ সালে দেবী অম্বু বা অম্বুয়া তন্ত্রসাধক অম্বরীশের আরাধ্যা দেবী ছিলেন। অম্বরীশ মুনির নামানুসারে দেবীর নাম হয় অম্বিকা। টোটো ভাড়া করে দেখে নেওয়া যায় রাজবাড়ি এবং মন্দিরগুলো। পাবেন ইতিহাসের ছোঁয়া। হালকা শীতের মরশুমে বহু পর্যটক ভিড় জমান।

Latest article