আশ্চর্য এক আবিষ্কার

সাড়ে তিনশো বছর আগে নেহাতই এক আকস্মিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে আবিষ্কার হয়েছিল ফসফরাস। কে আবিষ্কার করেছিলেন, আর কী থেকেই বা তিনি পেয়েছিলেন এই মৌল? সেই আবিষ্কারের গল্প বললেন অর্পণ পাল

Must read

আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগেকার কথা। সাল ১৬৬৯। বছর চল্লিশেক বয়সের এক জার্মান এক ডাক্তার বেজায় আশ্চর্য হয়ে পড়েছিলেন সেদিন। বেশ খেটেখুটেই তিনি বানাতে চেয়েছিলেন এক জিনিস, কিন্তু বদলে অন্য যে-জিনিসটা সেদিন তৈরি হয়েছিল, তা দেখে তিনি হতবাক। সাদাটে হলদে সেই জিনিসটা থেকে অন্ধকারেও বেরিয়ে আসছিল আবছা একটা আলোর আভা! সেটা নিয়ে কী করবেন তা বুঝতেই পারছিলেন না তিনি। পরে অবশ্য সেই কাদার মতো থকথকে বস্তু থেকেই পাওয়া গিয়েছিল এমন এক মৌল, যা এর আগে আর কেউ কখনও দেখেনি। সেই মৌল আবিষ্কারের এই ইতিহাস গল্পকেও হার মানায়।
ওই ডাক্তার দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটাতেন ল্যাবরেটরিতেই। সেখানে নানা ধরনের রাসায়নিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন ও ফলাফল লিখে রাখতেন নোটবুকে। ওই সময় যেটা নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন, সেটার নাম শুনলে অনেকেরই নাক সিঁটকাবে। কারণ, সেটা আর কিছু নয়— মানুষের বিশুদ্ধ মূত্র!

আরও পড়ুন-গ্রামবাসীদের ক্ষোভের মুখে বিজেপি সাংসদ

বড় মাপের এক পাত্রে ফুটিয়ে চলেছিলেন গ্যালন-গ্যালন মূত্র। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে গোড়ায় তিনি মোট সাড়ে পাঁচ হাজার লিটার মূত্র জোগাড় করে এই পরীক্ষায় নেমেছিলেন! আর এক-দু’দিন না, সেই মূত্র ফোটানোর কাজটাও চলছিল প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে। ফোটানোর সময় তার সঙ্গে আবার মেশানো হয়েছিল কিছু বালি আর চারকোলের মিশ্রণ। একটানা কয়েকদিন প্রচণ্ড গরম চুল্লির মধ্যে ফোটানোর পর সেই মিশ্রণ কমতে কমতে এসে দাঁড়ায় একটা গামলার মতো আকারের পাত্রের আয়তনে, আর সেটার রং হয় উজ্জ্বল সাদাটে হলদে। তিনি হাত দিয়ে দেখেন, বেশ মোম-মোম একটা ভাব রয়েছে। এমন জিনিস তিনি আগে দেখেননি। সেটা আবার অন্ধকারে জ্বলে, একটা আলোর আভা বেরিয়ে আসছিল। এইসব দেখে অনেক ভেবে তিনি এর নাম দিলেন ‘ফসফরাস’। গ্রিক ভাষায় phosphorus শব্দের অর্থ যে জিনিস আলো দেয় বা আলো বহন করে। কিন্তু তখনও এটা নিয়ে কী করা যায়, বা কী ধরনের কাজে লাগতে পারে, সে সম্বন্ধে তাঁর কোনও ধারণাই ছিল না।
কী করা যায় ফসফরাস নিয়ে
মধ্যযুগে বহু মানুষের একটা আগ্রহের জায়গা ছিল অ্যালকেমি। এই বিশেষ বিদ্যাচর্চায় একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল সোনা তৈরি করা। সীসার মতো কিছু বিশেষ ধাতু থেকে সোনা তৈরির চেষ্টায় কত মানুষ যে জীবন কাটিয়ে ফেলেছিলেন, তার ইয়ত্তা নেই। তালিকায় আছেন আইজ্যাক নিউটনও। তিনি তাঁর জীবনের বেশ বড় একটা অংশ এই কাজেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন, এবং যথারীতি ব্যর্থ হয়েছিলেন অন্যদের মতো।
আজ আমরা মৌল বা যৌগ বলতে যেমনটা বুঝি, ওই সময়ে সেই ধারণার জন্মই হয়নি। পুরনো আমলের ধারা মেনেই তখনও মনে করা হত যে জগতের যাবতীয় জিনিস আসলে চারটে মূল উপাদানে তৈরি— আগুন, জল, বাতাস আর মাটি। এই উপাদানগুলোর কম-বেশি মিশ্রণে যাবতীয় বস্তু তৈরি বলেই মনে করতেন সকলে। আরও বেশ কয়েক বছর পর ফরাসি বিজ্ঞানী আন্তন ল্যাভয়সিয়ে দেখিয়েছিলেন কীভাবে মৌল আর যৌগ এই দুটো জিনিসের মধ্যে তফাত করা সম্ভব।

আরও পড়ুন-ফাঁসি চাই না সঞ্জয়ের! কোর্টে দাঁড়িয়ে বিস্ময়কর বয়ান মৃত পড়ুয়ার বাবা-মা’র

জার্মানির হামবার্গ শহরের ওই ডাক্তার হেনিগ ব্র্যান্ড-ও অ্যালকেমি বিদ্যার পরিচিত সেই কাজটাই করতে চেয়েছিলেন তাঁর পরীক্ষাগারে। যার জন্য তাঁর এত খাটাখাটনি। মূত্রের রং যেহেতু হালকা হলদে, তাই সে-সময়ে আরও অনেকের মতো তাঁরও মনে হয়েছিল যে মূত্রে হয়তো সোনা থাকলেও থাকতে পারে। সেই জন্যেই অত পরিমাণ মূত্র নিয়ে পরীক্ষায় নেমেছিলেন তিনি। কিন্তু সে-খাটুনির ফল ফলেছিল সম্পূর্ণ আলাদা। আর সেই ঘটনার জন্যেই তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় হয়ে রয়ে গিয়েছে। ফসফরাস নামের মৌলটি আবিষ্কারের কৃতিত্ব পেয়ে গিয়েছেন তিনি, নেহাতই আকস্মিকভাবে। ইতিহাসে অবশ্য এই ধরনের তথ্য কোথাও নেই যে তিনি অত পরিমাণ মূত্র কোথা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন, বা সেদিন তাঁর নাকে ওই ফুটিয়ে থকথকে হয়ে যাওয়া মূত্রের গন্ধ কেমন লেগেছিল।
তবে এই আবিষ্কারের পরেও প্রায় পঞ্চাশ বছর ফসফরাস দিয়ে কী করা যেতে পারে, তা বুঝে উঠতে পারেনি কেউই। তারপর ধীরে ধীরে জিনিসটা দোকানে বিক্রি হতে শুরু করল, তা দিয়ে তৈরি হল সবচেয়ে দরকারি একটা জিনিস— জমিতে দেওয়ার সার। আরও পরে জানা যেতে লাগল যে এই ফসফরাস জিনিসটা উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের দেহের জন্য কতটা দরকারি। কোষের বিভাজন, কোষের মধ্যে প্রোটিন তৈরি হওয়া, বা দেহের বৃদ্ধি— ফসফরাস এ-সবের জন্য খুবই দরকারি। ১৮৪০ সালে জাস্টাস ফন লিবিগ দেখান যে উদ্ভিদের বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ফসফরাস বড় ভূমিকা নেয়। আমাদের দেহের বেশ কিছু জায়গাতেই থাকে ফসফরাস, আবার মাংস বা দুধ থেকেও শরীরে ঢোকে এই মৌল। দেহের বর্জ্য থেকে ফসফরাস নির্গতও হয়, যে ঘটনাই এক কালে এই মৌল আবিষ্কারে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল। আরও পরে, এই জিনিসটা বোমা তৈরিতেও বড় ভূমিকা নিয়েছিল। অজস্র জিনিসে থাকে ফসফরাস, যেমন দেশলাইয়ের যে গায়ে কাঠি ঘষা হয়, সেখানকার একটা প্রধান উপাদান এই মৌল। এমন অনেক জিনিসই আছে যা উপকারে লাগে, আবার ক্ষতি করতেও, যে যেভাবে সেগুলোকে ব্যবহার করতে চায়। ফসফরাসও সেরকমই একটা জিনিস, যেটা আবিষ্কৃত হয়েছিল নেহাতই আকস্মিকভাবে। তবে আজ এই মৌল আর মূত্র থেকে তৈরি করা হয় না, পাথুরে ফসফেট থেকে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বের করে নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন-বিজিবিএস-এর সর্বাঙ্গীন প্রস্তুতির নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রীর

হেনিগ ব্র্যান্ড-এর ওই আবিষ্কারের একশো বছর পর, ১৭৯৫ সালে এক ব্রিটিশ শিল্পী জোসেফ রাইট অঙ্কন করেন ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট’ নামে একটি ছবি। সেখানে তিনি হেনিগ ব্র্যান্ড-এর ওই পরীক্ষা করবার দৃশ্যকেই আশ্চর্য আলো-ছায়ার মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সোনা বানাতে পারেননি বটে, তবে এই ছবির মধ্যে দিয়েই হেনিগ ব্র্যান্ড অমর হয়ে রয়েছেন।

Latest article