বর্তমানকে খোলা চিঠি প্রথমের

নাহ্! এরকম চিঠি কস্মিনকালেও লেখেননি নেহরু। সে সুযোগই পাননি। জওহরলাল যখন প্রয়াত হন, তখন নরেন্দ্র মোদির বয়স ছিল কমবেশি ১৪ বছর। সাবালকত্বও অর্জন করেননি, সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠা তো দূরস্থ। বেঁচে থাকলে এখন নেহরুর বয়স হত ১৩৬ বছর। এত দীর্ঘায়ু ভারতীয় সচারচর দেখা যায় না। সুতরাং এখন এরকম চিঠি লেখার সম্ভাবনা নেহরুর পক্ষে কোনওদিনই তৈরি হয়নি। তবু, তবুও, ২০২৫-এ জীবিত থাকলে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদিকে এরকমই একটি চিঠি লিখতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এমন অনুমান বোধকরি অসঙ্গত নয়। প্রসঙ্গ স্মর্তব্য, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন রাজ্যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীদের নানা বিষয়ে চিঠি লেখার অভ্যাস নেহরুর ছিল। ইতিহাসসিদ্ধ সেই অভ্যাসের কাল্পনিক রূপ এই পত্র। লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

প্রিয় নরেন্দ্র,
একদা আমি যে দায়িত্ব বহন করেছি, এখন সেই দায়িত্ব আপনার ওপর। মধ্যবর্তী সময়ে চারপাশের পৃথিবীতে বদল এসেছে অনেক। এইসব পরিবর্তন অনেকাংশেই অনপনেয়। তবু দুটি প্রশ্ন, আমার-আপনার ভারতবর্ষে শাশ্বতই রয়ে গিয়েছে—
(১) ক্ষমতার উদ্দেশ্য কী?
(২) কোন ধরনের দেশ গঠন আমাদের লক্ষ্য?

আরও পড়ুন-উন্নয়নমূলক প্রকল্প বার্ষিক রিপোর্ট কার্ড দেখবেন মুখ্যমন্ত্রী

আমাদের সংবিধানে যে ধরনের ভারতের কথা বলা হয়েছে, তা এক নীতিভিত্তিক দেশের অবয়ব। তা কোনওভাবেই ভোট-বাজারের কাঠামো নয়। ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৪৬-এ গণপরিষদের সামনে আমি বলেছিলাম, আমরা গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ রূপের পক্ষে। এই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে সংবিধানে সর্ববিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। অর্থনীতিক, গণতান্ত্রিক, সামাজিক, ন্যায় ও আইনের দৃষ্টিতে সমতা, কোনও কিছুই সেখানে উপেক্ষিত হয়নি। বরং এই বিষয়গুলোকেই ভিত্তিপ্রস্তর জ্ঞানে আমরা সংবিধান রচনায় ব্রতী হয়েছিলাম। স্বাধীনতা, সাম্য আর সৌভ্রাতৃত্ব— এই তিনটি বিষয়কে নির্ভর করে ভারত সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার দিক নির্দেশক শক্তি হয়ে উঠবে, এমনটাই ভেবেছিলাম আমরা। অথচ আজ ধর্ম ও কৌম পরিচিতিকে হাতিয়ার করে বিভাজনের বীজ উপ্ত হচ্ছে। জনজীবনে রূঢ়তার প্রয়োগ উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। অসহিষ্ণুতা প্রকটতর হচ্ছে। নির্বাচনে সর্বজনীন অংশগ্রহণের ধারণাকে বর্জন করে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বর্জনকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা প্রাধান্য পাচ্ছে। ক্ষমতার হৃদিমূল থেকে সহানুভূতির উৎপাটন গণতন্ত্রের মূলগত ভাবনায় কুঠারাঘাত করছে। আমরা যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেখানে বিতর্ক গণতান্ত্রিক দর্শনের ভিত মজবুত করত। আর এখন বিতর্ককে, ভিন্ন মতের অবতারণাকে অবাঞ্ছিত আপদ বলে গণ্য করা হচ্ছে। সেখানে সংস্কারের পাঁচিলগুলোর চেয়ে জ্ঞানের মন্দিরের চূড়াগুলি উঁচু বলে মান্যতা পেত। আর এখন ভীতি হয়ে উঠছে বিশ্বাসের বীজ, সুরে সুর মেলানোটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে দেশপ্রেমের শর্ত। যদি সরকার ভুলে যায় ক্ষমতা অর্জন হল উপায়, গন্তব্য নয়, তবে সেই সরকারের নৈতিক ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে যায়। আর সেটাই এখন হচ্ছে।
গণতন্ত্রে জনগণের সম্মতিই ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়। ক্ষমতার প্রয়োগ ও প্রদর্শনে সংযম তাকে শুদ্ধতর করে তোলে। পক্ষান্তরে, সংখ্যাগরিষ্ঠের ঔদ্ধত্য, জয়ের গরলায়ন এবং দেশ ও শাসকের সমীকৃত হওয়াটা গণতন্ত্রের ক্ষয়িষ্ণুতার সূচক। সত্যিকার নেতৃত্ব পরীক্ষিত হয় পরিষেবা প্রদানকালে নম্রভাব প্রদর্শনে, বিজয়-উত্তর পর্বে সংযত থাকার সূত্রে। ঘৃণার সাফল্য আমি দেখেছি আমার জীবদ্দশাতেেই। দেশের অন্ধকারতম অধ্যায় রচিত হয়েছিল দেশভাগের সূত্রে। ট্রেন বোঝাই হয়ে স্টেশনে পৌঁছাত লাশ। অগণিত পরিবার সর্বহারায় পরিণত হয়েছিল তখন। প্রতিবেশী অভিযোজিত হয়েছিল শত্রুতে। প্রায় দেড় কোটি মানুষকে সীমান্ত পেরোতে হয়েছিল। দুই থেকে কুড়ি লক্ষ মানুষ নিহত হয়। আর, ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮-এ প্রার্থনা সভায় নাথুরাম গডসের তিনটে গুলি চিরতরে স্তব্ধ করে দেয় মহাত্মার কণ্ঠ, তাঁর নৈতিকতার উচ্চারণ। আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভা গান্ধীজিকে দেশভাগের জন্য দায়ী সাব্যস্ত করেছিল। নাথুরাম গডসের সঙ্গে সংস্রব ছিল তাদের। গডসে তাঁর স্বীকারোক্তিতে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রচারক গান্ধিজীকে হত্যা করার জন্য কোনও অনুশোচনা দেখাননি, এতটুকু অনুতাপ ছিল না তাঁর মধ্যে। যাঁরা সেই নৃশংসতার সাক্ষী ছিলেন তাঁরা সর্বথা ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে দমনের পক্ষে সওয়াল করে গিয়েছেন। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই ছিল গান্ধিজির আদর্শ। তাঁর আদর্শকে সম্বল করেই আম্বেদকর আমাদের সাধারণতন্ত্রের রূপদান করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের বারংবার সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে যে, শিকল পরানো জাতি তার স্বাভাবিক সৃজনশীলতা হারায়। সংবিধান রচনাকালে সেই দিকটিও উপেক্ষিত হয়নি।

আরও পড়ুন-জয়ের চোট নিয়ে অস্বস্তি ইস্টবেঙ্গলে

আমরা জেনেছিলাম, দুটো বিষয়ের মূল্য সমধিক। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্মান। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম, ক্ষয়িষ্ণু নৈতিকতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অথচ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, এরকম রাষ্ট্রও বেশিদিন টিকতে পারে না। আমরা দেখেছিলাম, বিশ্ব ভারতবর্ষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তার বিশাল আকৃতি বা বিপুল জনসম্পদের কারণে নয়, তার চিন্তা দর্শনের জন্য, সকল বিরুদ্ধতাকে অভিযোজিত করে আত্তীকরণ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে অগ্রগমনের কারণে। ভারতবর্ষ গণতন্ত্রের প্রতি তন্নিষ্ঠ ছিল বলেই এটা সম্ভবায়িত হয়েছে যুগ যুগ ধরে। আমাদের সাধারণতন্ত্র গড়ে উঠেছে যুক্তিনিষ্ঠার সৌজন্যে, সংলাপে আস্থা রাখার কারণে, সকল নাগরিকের প্রতি মানবিক থাকার প্রয়াসে। বৈশিষ্ট্যগুলোই অপরাপর দেশের মধ্যে কালে কালে বিশিষ্ট করে তুলেছে ভারতকে।
স্বাধীনতার প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে কী বলেছিলাম, আজও তা মনে আছে। ‘নিয়তির সঙ্গে অভিসার’ শীর্ষক সেই ভাষণে আমি ঘোষণা করেছিলাম, ‘আমরা যে যে ধর্মেরই মানুষ হই না কেন, আমরা সবাই সমানভাবে ভারতের সন্তান, আমাদের প্রত্যেকের সমান অধিকার, সমান সুযোগ ও সমান দায়িত্ব আছে। বলেছিলাম, ‘আমরা সাম্প্রদায়িকতাকে বা সংকীর্ন মানসিকতাকে উৎসাহিত করতে পারি না কারণ, কোনও জাতির সদস্যরা যদি চিন্তায় অথবা কর্মে সংকীর্ণচেতা হয়, তবে সেই জাতি কখনও বৃহৎ ও মহৎ হতে পারে না।’

আরও পড়ুন-উন্নয়নমূলক প্রকল্প বার্ষিক রিপোর্ট কার্ড দেখবেন মুখ্যমন্ত্রী

কে কাকে নির্বাচনে পরাস্ত করল, সে কথা ইতিহাস মনে রাখবে না। ইতিহাস তাদের কথাই মনে রাখবে যারা বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে, দুর্বলকে রক্ষা করতে পারবে, যে মূল্যবোধগুলো ভারতীয় সভ্যতার আত্মাস্বরূপ সেগুলোকে আঁকড়ে থাকতে পারবে। মনে আছে, ১৯৫১-৫২-র সাধারণ নির্বাচনে আমি ২৫ হাজার মাইল জুড়ে ভারতের মোট জনসংখ্যার এক দশমাংশ, প্রায় ৩৫ লক্ষ দেশবাসীর মধ্যে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছিলাম। আমি জানতাম প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিষয়ে দেশবাসীকে অবহিত করা আমার কর্তব্য। একটি ব্রিটিশ সংবাদপত্র লিখেছিল, যদি কোনও দেশ গণতন্ত্রের জন্য অন্ধকারে ঝাঁপ দেয়, সে দেশ হল ভারত। ঝাঁপ দেওয়াটা বৃথা হয়নি। কারণ, বর্জন নয়, অন্তর্ভুক্তকরণে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছিলাম আমরা। বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলাম আলাপ-আলোচনার ওপর, বিদ্বেষ-বিভাজনের ওপর নয়। প্রতিহিংসা চরিতার্থকরণের পরিবর্তে সংযম সেদিন অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছিল।
গণপরিষদে ভাষণদানকালে একদা বলেছিলাম, আমরা সেই ধরনের সরকারই এখানে প্রতিষ্ঠিত করব যা দেশবাসীর মানসিকতার সঙ্গে খাপ খায় এবং তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশবাসীর লক্ষ্য, চরিত্র ও চিন্তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। যাঁরা অন্যরকম ভাবছেন, অন্যরকম ধর্মাচরণ করছেন এবং যাঁদের দেখতে অন্যরকম, তাঁদের প্রতি আমরা কীরকম ব্যবহার করছি, তাঁদের সম্পর্কে আমরা কী ধ্যানধারণা পোষণ করছি, সেটাই গণতন্ত্রের আসল মাপকাঠি। মহাত্মাজী পর নিধনের পর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে আমি বলেছিলাম, আমাদের জীবন থেকে আলো অন্তর্হিত হল, চারিদিকে এখন কেবল অন্ধকার। কিন্তু নিজে বিশ্বাস করতাম, সেই আলো আরও সহস্র বৎসর স্থায়ী হবে। সেই আলো হল মহাত্মাজীর বাণী: হিংসা হিংসারই জন্ম দেয়; ঘৃণার শিকার হয় ঘৃণিত ও ঘৃণাকারী; আর সবাইকে আপন করে নেওয়ার মধ্যেই ভারতের শক্তি নিহিত।
এটা ঠিক, যে সাধারণতন্ত্রের নির্মাণ আমরা করেছিলাম তা পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত ছিল না। চেষ্টা করেছিলাম যাতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও ভাষা নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক নিজেকে ভারতবাসী ভাবতে পারে। চেষ্টা করেছিলাম যাতে গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনব্যবস্থার চেয়ে বেশি কিছু বলে অনুভূত হয়। যাতে ভারতীয় গণতন্ত্র সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার এবং সকলের সমান সুযোগ প্রাপ্তির অবলম্বন হয়ে ওঠে। এই উত্তরাধিকারই আপনার ওপর বর্তেছে। এটিকে রক্ষা করার দায়িত্ব এখন আপনারই।
ইতি, শুভেচ্ছান্তে,
জওহরলাল নেহরু

Latest article