বাকরোধে

অ্যাফাসিয়া মস্তিষ্কের ক্ষতির থেকে সৃষ্ট এক ব্যাধি যার প্রভাবে হারিয়ে যায় ভাষা প্রকাশের ক্ষমতা। শুনতে অচেনা লাগলেও ভারতে প্রতিবছর অ্যাফাসিয়ায় আক্রান্ত হন লক্ষাধিক মানুষ। তাই প্রতিবছর জুন-এ পালিত হয় ‘জাতীয় অ্যাফাসিয়া সচেতনতা মাস’। সাধারণের মধ্যে অ্যাফাসিয়া সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিই এর মূল উদ্দেশ্য। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

অ্যাফাসিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ায় অভিনয় ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা ব্রুস উইলিস। অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা সময় অভিনয় থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। তাঁর অ্যাফাসিয়া হওয়ার কারণ সম্পর্কে যদিও বিশেষ কিছু জানা যায়নি। বিশ্বে প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। শুধু আমেরিকাতেই ২০ লক্ষ মানুষ এই রোগে ভুগছেন। ভারতে প্রতিবছর ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ মানুষ অ্যাফাসিয়ায় আক্রান্ত হন। মস্তিষ্কে ক্ষতির কারণে এই ব্যাধি সৃষ্টি হয়। এই রোগটি প্রাথমিক লক্ষণ হল কথা বলতে, বুঝতে, লিখতে সমস্যা হওয়া। স্ট্রোকের কারণে প্রায় ৩০% মানুষের এই রোগ হয়। তাই প্রতিবছর জুনে পালিত হয় জাতীয় ‘অ্যাফাসিয়া সচেতনতা মাস’।


কী এই রোগ অ্যাফাসিয়া
বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যাফাসিয়া হল একটি ব্যাধি যা মস্তিষ্কের যে অংশের মাধ্যমে কথা বলার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয় সেই অংশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে ব্যক্তির ভাষা প্রকাশে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির কথা বলতে সমস্যা হয়। সেই সঙ্গে আসে নানা শারীরিক জটিলতা। আমেরিকান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেল্থ অনুসারে অ্যাফাসিয়া রোগ মস্তিষ্কের টিউমার বা একটি ক্রমবর্ধমান স্নায়বিক রোগের ফলেও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
সাধারণত মাথায় আঘাত ও স্ট্রোকের মতো রোগের পর মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে রক্তপ্রবাহের সমস্যা দেখা দেয় যা এই রোগের কারণ। এছাড়াও মস্তিষ্কের টিউমার, নিউরোডিজেনারেটিভ অসুখের ফলেও হতে পারে। স্নায়ুঘটিত রোগ ও মস্তিষ্কের বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের ফলে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এছাড়া মস্তিষ্কের ফোড়া, মাইগ্রেন, মৃগীরোগ, ব্রেন টিউমার, পারকিনসন্স ডিজিজ ইত্যাদি রোগের জন্য মস্তিষ্কের ক্ষতি হলে অ্যাফাসিয়া হয়।
উপসর্গ
যে কোনও বস্তু, পরিচিত ব্যক্তি, স্থান এবং কোনও ঘটনার নাম আলাদা করতে অসুবিধে হওয়া।
পড়া, লেখা এবং কথা বলার সময় সঠিক শব্দ খুঁজে পেতে অসুবিধা হওয়া।
শব্দলি উচ্চারণ করার সময় সমস্যার সম্মুখীন হওয়া, যাকে বলে ডিসারথ্রিয়া।
ফ্লুয়েন্সি বা একটানা বিনা ছেদে কথা বলার সমস্যা।
ব্যাকরণগত ভুল। কথা বলার সময় সাধারণ বা ছোট শব্দ যেমন was, the, of, এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।
থেমে থেমে বা ছোট ছোট বাক্যে কথা বলা। অর্থহীন কথাবার্তার প্রবণতা।
তাদের নিজের বলা বক্তব্যের ত্রুটি বুঝতে না পারা, সচেতনতার অভাব।
বোধগম্যতার অভাব। অপরদিক থেকে কেউ কিছু বললে বা নির্দেশ দিলে বুঝতে না পারা।
সহজ গাণিতিক সমাধান সম্পাদনে অসুবিধা হওয়া।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া।
অ্যাফাসিয়ার ধরন
ব্রোকা’স বা অ্যাফাসিয়া
অন্যেরা কী বলছে এরা তা বুঝতে পারে এবং তার সঙ্গে ছোট ছোট বাক্য বা শব্দ ব্যবহার করে কথা বলতে পারে। এমন ব্যক্তিরা শব্দগুলি বের করতে, শব্দ বাদ দিতে এবং খুব ছোট বাক্যে কথা বলতে লড়াই করে। ‘‘আজ পার্কে হাঁটব’’ বা ‘‘খাবার চাই’’ এইটুকু ভাষা প্রকাশ করতে পারে। শ্রোতা সাধারণত অর্থ বুঝতে পারে। এদের ডানদিকে দুর্বলতা বা পক্ষাঘাত থাকতে পারে।
এসপ্রেসিভ অ্যাফাসিয়া
একে ওয়ার্নিকেস অ্যাফাসিয়াও বলা হয়। এই ধরনের অ্যাফাসিয়া আক্রান্ত দীর্ঘ, জটিল বাক্যে অনায়াসে এবং সাবলীলভাবে কথা বলতে পারে যা অর্থবোধক নাও হতে পারে বা ভুল, অচেনা শব্দের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। রোগী সাধারণত কথ্যভাষা ভালভাবে বুঝতে পারে না। অন্যরাও তাদের বুঝতে পারে না।
গ্লোবাল অ্যাফাসিয়া
শব্দ এবং বাক্য গঠনে অসুবিধা হয় এই ধরনের অ্যাফাসিয়াতে। বোধগম্যতা থাকে না। গ্লোবাল অ্যাফাসিয়া মস্তিষ্কের ভাষা নেটওয়ার্কের ব্যাপক ক্ষতির কারণে ঘটে। গ্লোবাল অ্যাফাসিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা অভিব্যক্তি এবং বোঝার ক্ষেত্রে গুরুতর অক্ষমতায় ভোগেন।


চিকিৎসা
* অ্যাফাসিয়ায় সম্পূর্ণ নিরাময় নেই। আক্রান্তের মস্তিষ্কের ক্ষতির পরিমাণ কতটা অর্থাৎ হালকা, মাঝারি বা গুরুতর তার ওপর নির্ভর করে এর চিকিৎসা।
যদি মস্তিষ্কের হালকা ক্ষতি হয় তবে কোনও চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন নেই। স্পিচ থেরাপির মাধ্যমে ভাষা বা যোগাযোগের ক্ষমতা উন্নত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞের মতে, অনেক সময় ভিটামিন বি১২-এর অভাব ও থাইরয়েডের সমস্যা থেকেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রেও ওষুধপত্র রয়েছে।
স্ট্রোকের কারণে যদি এই সমস্যা দেখা যায় তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরাময় সম্ভব। ওষুধ ও স্পিচ থেরাপির মাধ্যমেই রোগীকে স্বাভাবিক জায়গায় ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু স্ট্রোকের ২-৩ মাসের পরেও যদি সমস্যা না যায় তবে নিরাময়ের সম্ভাবনা কমে যায়।
* বর্তমানে, অ্যাফাসিয়ার চিকিৎসা নিয়ে কিছু ওষুধের উপর গবেষণা চলছে। যা মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহকে উন্নত করতে পারে, মস্তিষ্কের পুনরুদ্ধারের ক্ষমতা বাড়াতে পারে বা ক্ষয়প্রাপ্ত নিউরোট্রান্সমিটার প্রতিস্থাপন করতে সহায়তা করবে।

বাড়িতে অ্যাফাসিয়া রোগী থাকলে
কথা বলার আগে তার মনোযোগ আকর্ষণ করুন।
কথা বলার সময় পারিপার্শ্বিক শব্দ যত কম থাকে ততই ভাল।
সহজ ও ছোট ছোট বাক্য বলুন।
মূল শব্দের ওপর জোর দিন।
ধৈর্য রাখুন, আক্রান্ত ব্যক্তির বাক্য পূরণ করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।
শারীরিক ভাষা, লেখা বা ছবি ব্যবহার করুন।
স্বাধীনভাবে চেষ্টা করতে উৎসাহ দিন।
কার্যকরী সংযোগ স্থাপনের জন্য মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করুন।

Latest article