অন্যকে বোকা বানিয়ে মজা করার দিন ১ এপ্রিল। যাঁরা বোকা বনে যান, তাঁদেরকেই বলে এপ্রিল ফুলস। বছরের এই একটা দিনে বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ অন্যকে ‘বোকা বানিয়ে’ হালকা ঠাট্টা করার সুযোগ খোঁজেন। একটু মন খুলে হাসার রসদ জোগান একে অপরকে। কবে থেকে এল এই দিনটি? কে প্রচলন করল? কেনই বা প্রচলন হল এমন লোক ঠকানোর দিন। সত্যি বলতে একথা কেউ জানে না। তাই এপ্রিল ফুলের উদ্ভব সম্পর্কে বহু পৃথক পৃথক তথ্য রয়েছে। অনেকেই বলেন সম্ভবত ১৫৮২ সাল থেকে এপ্রিল ফুলের সূচনা হয়। ওই বছর থেকেই ১ জানুয়ারিতে ফ্রান্স জর্জিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছর নির্ধারণ শুরু হয়। তার আগে পর্যন্ত ২৫ মার্চ দিনটিকে বছরের প্রথম দিন হিসেবে ধরা হত। শোনা যায়, একদল মানুষ জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারের ব্যবহার চালু হওয়ার পরও ২৫ মার্চকেই বছর শুরুর দিন হিসেবে মেনে চলতেন। এই সব মানুষকেই বাকিরা ‘ফুলস’ বা বোকা বলে বিদ্রুপ করতেন।
আরও পড়ুন-বোকা বানিয়ে মজার দিন, মুসলিম গণহত্যার দাস্তান
তবে এ কথাকে বেদবাক্য বলে কেউ মেনে নেয়নি। ইউরোপের মধ্যযুগের ইতিহাসে ১ জানুয়ারি ফ্রান্সে ‘ফিস্ট অফ ফুলস’ নামে একটি উৎসব পালিত হত। এই অনুষ্ঠানে খ্রিস্টান ধর্ম রীতি অনুসারে গির্জার একজন পোপ নির্বাচিত করা হত। এছাড়া, এ দিনে গির্জার বিভিন্ন আধিকারিকরা নিজেদের কাজ অদল বদল করে নিতেন। কেউ কেউ বলেন তখন থেকেই এপ্রিল ফুলের শুরু।
ষোড়শ শতকের পর ফ্রান্সে ১ এপ্রিলে পালিত হত ‘পয়জন দি’এভরিল’ নামের একটি আনন্দোত্সব। ‘পয়জন দি’এভরিল’-এর মানে হল এপ্রিল ফিশ। এই দিনে বন্ধুদের পিঠে কাগজের তৈরি মাছ আটকে মজা করা হত। স্কটল্যান্ডে এই অনুষ্ঠানকে বলা হত ‘গকি ডে’। ২ এপ্রিল পালিত হত এই ‘গকি ডে’। এই দিন বন্ধুদের পিঠে সুযোগ বুঝে ‘কিক মি’ লেখা কাগজ আটকে দেওয়া হত। ব্যস আর যায় কোথায়! যার পিঠে এমন কাগজ আটকানো থাকত তার ওপর নিগ্রহ চলত। খানিকটা র্যাগিং টাইপের ব্যাপার।
আরও পড়ুন-ব্যর্থ ব্যাটিং, হারেই শুরু নাইটদের
জার্মান লোককথা অনুযায়ী ১৫৩০ সালের ১ এপ্রিল, জার্মানির অগসবারগ শহরে একটি আলোচনাসভা বসার কথা ছিল। তাতে কি সিদ্ধান্ত উঠে আসে তা নিয়ে অনেকেই বিপুল টাকার বাজি ধরেছিলেন। আজকের দিনে ক্রিকেট নিয়ে যেমন হয়, খানিকটা তেমন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই সভা আর বসেনি। বহু মানুষের টাকা গচ্চা যায়। এই বোকামি থেকেই এপ্রিল ফুলের শুরু।
রোমান লোককথা আবার অন্য কথা বলে। রোমান দেবতা প্লুটো যখন তাঁর স্ত্রী পারসিফনকে অপহরণ করে আনেন, তখন পারসিফনের মা সেরিস মেয়েকে খোঁজার অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু পান না। মেয়ে তখন মাটির নিচে। কিন্তু তাঁর মা ‘বোকার মতো’ মাটির উপরে খুঁজতে থাকেন। সেই ‘বোকামি’র কথা ভেবেই নাকি রোমানরা এই দিনটিতে বোকামি দিবস পালন করত।
আরও পড়ুন-নিউ গড়িয়া মেট্রো রুটে ভাড়া ঘোষণা
রোমান লোককথা অনুসারে, ব্রিটেনের নটিংহ্যামশায়ারের গথাম শহর বোকাদের শহর নামে পরিচিত ছিল। বিশ্বাস করা হত সেখানে বোকা লোকেরা বাস করত। ত্রয়োদশ শতকের দিকে নিয়ম ছিল, ব্রিটেনের রাজা যেখানে যেখানে পা রাখবেন তা হয়ে যাবে রাষ্ট্রের সম্পত্তি। যখন গথামবাসীরা শুনল রাজা জন আসছেন তাদের শহরে, তারা রাজাকে কিছুতেই ঢুকতে দেবে না গথামে। তা শুনে রাজা খেপে গেলেন এবং সৈন্য পাঠালেন। রাজার সৈন্যরা যখন শহরে এল, প্রধান ফটক থেকে তারা দেখল সারা শহরে হুলস্থুল কাণ্ড। গথামের বাসিন্দারা বোকার মতো নানান কাজ করছে। সৈন্যরা হেসে ফেলল। তারা ফিরে গিয়ে রাজাকে জানাল বোকাদের অস্বাভাবিক কাজকর্মের কথা। সব শুনে রাজা বললেন, এই বোকাদের শাস্তি দেওয়া যায় না। রাজা গথামবাসীদের মাফ করে দিলেন। গথাম স্বাধীন থাকল। গথামবাসীদের এই কৌশলকে স্মরণ করে পালন করা হয় এপ্রিল ফুলস ডে।
আরও পড়ুন-এমএলএ কাপের উদ্বোধন
অনেকে বলেন, বোকা বানানোর এই দিনটির সূচনা হয় ১৫৭২ সালের ১ এপ্রিল। এদিন নেদারল্যান্ডসের ডেন ব্রিয়েল শহরটি স্প্যানিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়। এই দিন বিদ্রোহীরা স্পেনের শাসকদের বোকা বানিয়ে ছাড়ে। তার পর থেকেই নাকি এপ্রিল ফুল পালন করা হয়।
ভারতে ঠিক কোন সময় থেকে এপ্রিল ফুল চালু হল তা কোথাও স্পষ্ট করে উল্লেখ নেই। ব্রিটিশরা ভারতে প্রায় ২০০ বছর শাসন করে। তবে ব্রিটিশ ছাড়াও, ফরাসি ও পর্তুগিজরাও এই মাটি দখলের চেষ্টা কম করেনি। তাই ব্রিটিশদের হাত ধরে এখানে এপ্রিল ফুল দিবস ঢুকেছিল নাকি এর পিছনে ফরাসি কিংবা পর্তুগিজরা ছিল তা কোথাও স্পষ্ট নেই। যেহেতু দিনটি নিছক দুষ্টুমিতে ভরা তা মানুষ তাকে আপন করে নিয়েছিল চট করে। সব মানুষেরই কমবেশি দুষ্টুমি করতে ইচ্ছা করে। যা করতে পারে না তারা দুষ্টুমি উপভোগ করে।
আরও পড়ুন-বাংলার সংস্কৃতিতে মুগ্ধ বিদেশি অতিথিরা
এই দিনটির ভিতর আলাদা করে আর কিছু থাকে না। ঠকাও, বোকা বানাও, ধরা পড় আর তারপর সকলে মিলে হেসে ওঠ। উৎপত্তি ও ইতিহাস যাই হোক না কেন, মোদ্দা কথা, এটাই হল এপ্রিল ফুল। তবে এই সময়ে দেশের দিকে তাকিয়ে অনেকে বলছেন, অমৃতকালে যা যা হচ্ছে তাতে বোকা বানানোর দিন আর ১ এপ্রিলে থমকে নেই। বছরের বেশিরভাগ দিনই আসলে বোকা বানানোর। ভোটার কার্ড হাতে নেওয়া নাগরিক প্রজারা তা মোক্ষম টের পাচ্ছে!