চোরের মায়ের বড় গলা

দুর্নীতি নিয়ে আজ যারা ভয়ানক সরব, তারা আগে নিজেদের মুখ আয়নায় দেখুক। জনস্মৃতি দুর্বল, তা বলে এতটাও নয়। পুরনো সেই পাঁকের কথা মনে করিয়ে দিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র ও কলকাতা পুরসভার পুরপিতা অরূপ চক্রবর্তী

Must read

রাজ্যে বিরোধী পক্ষ গণতান্ত্রিক আবহের সৌজন্যে রাজ্য উচ্ছন্নে গিয়েছে, এই আওয়াজে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলেছেন। সরকারকে সমালোচনা করার অধিকার বিরোধীদের আছে, অবশ্যই আছে। কিন্তু যখন দেখি সিপিএম এই সমালোচনায় গলা মেলাচ্ছে, তখনই অনিবার্যভাবে একটা কথাই মনে পড়ে যায়— ‘চোরের মায়ের বড় গলা।’

আরও পড়ুন-রানওয়ে থেকে পিছলে গেল ইন্ডিগোর বিমান, সতর্কতামূলক ব্যবস্থার জন্য মুম্বইয়ে ওড়ার অনুমতি পেল না স্পাইসজেট

কোন সিপিএম আজ এসব বলছে? সেই সিপিএম যাদের প্রায় সাড়ে তিন দশকের শাসনকালের শেষ ১১-১২ বছর বাদে আর কখনও এসএসসি-র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। পুরো নিয়োগ-প্রক্রিয়া আলিমুদ্দিনের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। স্কুল পরিচালন সমিতি নিয়োগপত্র প্রদান করতেন। এই পরিচালন সমিতির শীর্ষপদে থাকতেন সিপিএমের লোকাল বা জোনাল কমিটির নেতৃবৃন্দ বা বামপন্থী নেতৃবর্গ। ফলে ১৯৭৭-’৯৭ রাজ্যের প্রায় প্রতিটি সরকারি বিদ্যালয়ে সিপিএম দলের কর্মী বা সমর্থক পরিবারের সদস্য শিক্ষকতার চাকরি লাভে সমর্থ হয়েছেন।

আরও পড়ুন-৪০০০ আসনের স্টেডিয়াম সাকোয়াঝোরা

১৯৯২। ব্রিগেডে বাম সমাবেশ. সেখানে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তাঁর বক্তৃতায় ‘বর্তমান’ পত্রিকা ও তার সম্পাদক বরুণ সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে একরাশ উষ্মা প্রকাশ করেন। কারণ, বর্তমান তখন জ্যোতি বসু ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের নানা দুর্নীতির কথা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছিল। এজন্যই জ্যোতি বসুর সেদিনকার বক্তব্য ছিল, রাজ্য সরকার ‘বর্তমান’কে আর্থিক সহায়তা দেয়নি বলেই বরুণ সেনগুপ্ত এরকম কুৎসা রটনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। এর প্রতিবাদে ওই কাগজেই বরুণ সেনগুপ্তর একটি লেখা প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি জ্যোতি বসুর উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন, ‘বয়স যত হচ্ছে তত মিছে কথা বলার অভ্যাস বাড়ছে কেন?’ বরুণবাবু সেদিন একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন বামফ্রন্টের সরকারের প্রধানকে। বলেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের দিয়ে একটা কমিশন তৈরি হোক। সেখানে ‘বর্তমান’-এর প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে জ্যোতিবাবুরা অভিযোগ দায়ের করুন। আর উল্টোদিকে বরুণবাবু জ্যোতি বসুর পরিবারের মাত্র তিন জন সদস্যের ‘বিড়লা’ হয়ে ওঠার বৃত্তান্ত পরিবেশন করবেন। কমিশন তদন্ত করে দেখুক কার কথা ঠিক। বলা বাহুল্য, জ্যোতি বসু সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেননি।

আরও পড়ুন-পর্যটনে বন-লাগোয়া জমি এবার লিজে

বরুণ সেনগুপ্ত সেদিন যে হুইসেল ব্লোয়ারের কাজটা করেছিলেন, পরবর্তী দু’দশকে সিপিএম সেই অপকর্মটি আরও সংগঠিত ও পরিকল্পিত উপায়ে জারি রেখেছিল। ১৯৯৫-এর পর থেকে টিভির মতো গণমাধ্যমগুলো এত বেশি জনপ্রিয়তা পায়, তার আগে এদের দর্শক এত ছিল না। এত বিপুলতা, এ প্রাবল্য ছিল না। সেসময় হাউ টক ইন্ডিয়া-তে করণ থাপার জ্যোতি বসুর একটি সাক্ষাৎকার নেন, সেখানে তিনি সরাসরি জ্যোতি বসুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনাদের আমলে উচ্চশিক্ষায় নিয়োগ বন্ধ এবং আপনাদের আমলে একটিও শূন্য পদ নতুন করে তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপারটা চলে আসছে। কেন? জ্যোতি বসু প্রকারান্তরে সেখানে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাঁদের জমানাতেই নানা অস্বচ্ছতার কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। তখনও এসএসসি বাজারে আসেনি। কার নম্বর বেশি কার নম্বর কম এসব এখনকার মতো জানার বোঝার কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। তখন সিপিএম পার্টি নিজের হোলটাইমারদের এবং তাঁদের আত্মীয় পরিজনদের চিরকুটে লিখে দিয়ে শিক্ষকতায় প্রার্থীদের নিয়োগ করত। সংগঠিতভাবে। সুচারুভাবে। প্রতিবেশী রাজ্য ত্রিপুরা, সেখানে আবার আর এক কীর্তি। ১০,৩২৩ শিক্ষককে রীতিমতো আইনি বিধি লঙ্ঘন করে, তাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে নিয়োগপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা সেরে ফেলেছিল সিপিএম, ত্রিপুরাতে। ক্যাডারদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল সেখানে। সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে মামলা হল। মামলা গেল সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সেই নিয়োগ অবৈধ বলে ঘোষিত হল। তার পর বিজেপি ক্ষমতায় এল। কিন্তু সেই অবৈধ নিয়োগ আজও বৈধতা অর্জন করেনি। শিক্ষক নিয়োগ সেখানে বিশ বাঁও জলে। এখন তা আটকেই আছে। ৮৪ জন এখনও পর্যন্ত এই ইস্যুতে আত্মঘাতী হয়েছেন। চাকরি না পাওয়ায় তাঁদের জীবন শেষ হয়ে গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে কাউকে কাউকে মালির চাকরি দেওয়া হয়েছে। বাথরুমের জমাদারের চাকরি দেওয়া হয়েছে। কেউ শিক্ষকের চাকরি পাননি।

আরও পড়ুন-আমেরিকার কেন্টাকি প্রদেশে ভয়াবহ বন্যা, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৫

সিপিএম আজ দুর্নীতি নিয়ে এত কথা বলছে। আসলে তারা ভাবছে, সঞ্চয়িনী, সঞ্চয়িতার কথা মানুষ ভুলে গিয়েছেন। এমনকী সারদার সূচনাও ওই বাম জমানাতেই। সারদার কর্তা আজ মা-মাটি-মানুষের সরকারের সৌজনে কারান্তরালে। আর বাম জমানায় সঞ্চয়িনী, সঞ্চয়িতার মতো চিটফান্ডের মালিকদের রহস্যময় মৃত্যু হয়েছিল। আসলে তাদরে মুখ চিরতরে বন্ধ রাখার জন্য ওই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। জ্যোতি বসুর ভাগনে বিজন নাগের নিজস্ব চিটফান্ড ছিল। সেখান থেকে লক্ষাধিক মানুষ আজও একটা টাকাও পাননি।

আরও পড়ুন-যে লেখিকা ম্যাজিক জানেন, জোয়্যান রোওলিং

সারদার উত্থান দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা থেকে। তখন সিপিএমের একচ্ছত্র আধিপত্য ওই জেলায়। সেখানকার ৮০-৯০ শতাংশ বিধায়ক তখন সিপিএমের। সমস্ত সাংসদ সিপিএমের। অন্যতম সাংসদ তখন সুজন চক্রবর্তী। তাঁর শ্বশুরমশাই তখন পার্টির জেলা সম্পাদক। ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ তখন শমীক লাহিড়ী। সেই সাংগঠনিক জেলা থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন মুখ্যমন্ত্রী। এরকম একটা আবহে রীতিমতো একটা খুন হওয়ার পর সারদার রমরমা বাড়ল। বিষ্ণুপুর বিধানসভা থেকে। সেখানেও সিপিএমের বিধায়ক আনন্দবাবু। তিনি এই বৃদ্ধিতে বিরাট ভূমিকা পালন করেন।
সিপিএম এখন সেসব ভুলিয়ে ঘুলিয়ে দিয়ে ন্যাকা সাজছে।

আরও পড়ুন-৫ দিনের দিল্লি সফরে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী

ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এত দাপট সে-সময় ছিল না বলেই বিষয়গুলো তেমনভাবে প্রচারের আলো দেখেনি।
বালি পুরসভার সাব-অ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর বাড়ির কমোড থেকে ২৮ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছিল। সেই টাকার মালিকানায় যাঁরা অভিযুক্ত ছিলেন, যাঁদের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছিল, তাঁদের অন্যতম সিপিএম-এর স্বদেশ চক্রবর্তী। অরুণাভ লাহিড়ী, প্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়-সহ আরও একডজন সিপিএম নেতার নাম সামনে এসেছিল তখন ওই টাকার সঙ্গে যোগ থাকার সূত্রে। আর সেই সিপিএম এখন সততা নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছে!

আরও পড়ুন-তিন কবির গান

২০১৩, রাজ্যের নাম ত্রিপুরা। সিপিএম-এর সমর আচার্য ওরফে বাবুল। তাঁর স্বপ্ন ছিল টাকার বিছানায় ঘুমোবেন তিনি। আগরতলায় স্টিং অপারেশনের ফলে বাবুলের কীর্তি ফাঁস হয়। যে টাকার বিছানায় তিনি শুতেন সেটির নিচে রাখা টাকা যে তিনি ঘুষ হিসেবে পেয়েছেন, সেটাও বাবলু আগরতলার ওই টিভি চ্যানেলকে জানিয়ে দেন। এ নিয়ে কোনও মামলা কোথাও হয়নি।
সিপিএমের গণশক্তি। বছরে ২৪ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন পেত সারদা থেকে। গণশক্তি ডায়াল-এর স্পনসর ছিল রোজ ভ্যালি। সেই সিপিএম এখন সাধুর ভেক ধরছে!
পশ্চিম মেদিনীপুরের সিপিএম নেতা দীপক সরকার। তাঁর দাপটে ওই জেলায় বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত। ব্যাঙ্কের টাকা তছরুপ করেছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ব্যাঙ্ক দখলে নিয়েছিল।

আরও পড়ুন-ময়দানে প্রাণ ফেরায় খুশি সুব্রত-মানসরা

জ্যোতি বসুর সুপুত্র চন্দন বসুর বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারির কথা প্রায় সবার জানা।
যাদবপুরে গণ-উদ্যোগ কমিটি। হকার পুনর্বাসনের জন্য বাড়ি তৈরি করল। চারতলা বাড়ি পুরসভার অনুমোদন পেল। বাড়ি যখন হল তখন সেটি সাততলা! গণ-উদ্যোগ কমিটির মাথায় বিকাশ ভট্টাচার্য। আজও যিনি শুভেন্দু অধিকারী, সৌমেন্দু অধিকারীর হয়ে মামলা লড়েন। রাজ্যসভার সাংসদ। কিন্তু অন্যায়ভাবে বহিষ্কৃত সাংসদদের প্রতিবাদী ধরনায় শামিল হওয়ার সময় পান না। সেই বিকাশ ভট্টাচার্যদের গণ-উদ্যোগ কমিটির তৈরি হকার পুনর্বাসনের জন্য তৈরি বাড়ি রাতের অন্ধকারে বেসরকারি নার্সিংহোমকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। রাজা এস সি মল্লিক রোডের এই কেলেঙ্কারির কথা সবাই জানে।
সেই সিপিএম, সেই বিকাশ ভট্টাচার্যরা যখন বড় বড় বুলি আওড়ান। তখন একটা কথাই বলতে ইচ্ছে করে।
চোরের মায়ের বড় গলা

Latest article