পয়লা বৈশাখ দিনটাই যেন একটু অন্যরকম। বছরের বাকি দিনগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। নরম ভোরের মধ্যে লেগে থাকে আনন্দের গুঁড়ো। সেই গুঁড়ো অজান্তেই ছড়িয়ে যায় শরীরে, মনে। সঙ্গে থাকে সারাদিন। তীব্র দাবদাহে তাই কষ্ট উধাও। সন্ধেবেলার মৃদু হাওয়ার শিরশিরানি রবীন্দ্রনাথের গানের মতো। আনন্দকে পৌঁছে দেয় চরমে।
পয়লা বৈশাখ (Pahela Boisakh) মানেই বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানা। নতুন পোশাক, ভালমন্দ খাওয়াদাওয়া, দোকানে দোকানে হালখাতা করতে যাওয়া। আর? একটু গান শোনা, দু’চার পাতা বইপড়া।
বই বলতেই মনে পড়ে গেল কলেজ স্ট্রিটে বইপাড়ার কথা। নববর্ষে (Pahela Boisakh) বইপাড়া সেজে ওঠে অন্যরকম সাজে। ছোট-বড় প্রায় সমস্ত প্রকাশকের ঘরেই হয় হালখাতার পুজো। প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় কয়েকদিন আগেই। লেখকদের নিমন্ত্রণ, ঘরদোর ঝাড়পোঁছ, কেনাকাটা ইত্যাদি। পয়লা বৈশাখের সকালে ফুল, আম-পল্লব ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয় প্রকাশনার ঘর। পুরুষরা নিজেদের সাজিয়ে তোলেন ধুতি-পাঞ্জাবিতে, মহিলারা অবশ্যই শাড়ি। হালখাতার পুজো হয় কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর, ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি প্রভৃতি মন্দিরে। ভোর ভোর পুজোপাট সেরে লক্ষ্মী-গণেশ নিয়ে বইপাড়ায় হাজির হয়ে যান প্রকাশকরা। কেউ কেউ ঘরেই করেন পুজোর আয়োজন।
বেলার দিকে একে-একে আসতে শুরু করেন কবি-সাহিত্যিকরা। প্রচ্ছদ-অলংকরণ শিল্পীরাও আসেন। তাঁদের জন্য থাকে বিশেষ আপ্যায়নের ব্যবস্থা। ডাবের জল, শরবত, মিষ্টি, নোনতা, চা ইত্যাদি। সঙ্গে নতুন ক্যালেন্ডার। দমফেলার সময় থাকে না কর্মীদের। একসঙ্গে নয়, লেখকরা আসেন নিজেদের সুবিধামতো। বিভিন্ন প্রকাশকের ঘর ঘুরে, বিভিন্ন সময়ে। নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। প্রবীণ লেখকের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেন নবীন লেখকরা। সারাদিন চলে জমজমাট সাহিত্য-আড্ডা। সিরিয়াস আলোচনার পাশাপাশি অনেকেই মেতে ওঠেন রঙ্গরসিকতায়। বহু উৎকৃষ্ট সাহিত্যের বীজ মনের মধ্যে বপন হয়েছে এইসব মননশীল আসর থেকেই।
কোনও কোনও প্রকাশক নববর্ষ উপলক্ষে প্রকাশ করেন নতুন বই। পয়লা বৈশাখে কেনাকাটার উপর কোথাও কোথাও দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়। এইদিন কিছু কিছু লেখকদের প্রাপ্তিযোগও ঘটে। প্রকাশকের তরফে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয় বকেয়া অর্থ।
ভিড় জমান পাঠকরাও। বই কেনেন। নেন প্রিয় লেখকদের অটোগ্রাফ। এখন অবশ্য নিজস্বীর যুগ। সারাদিন গমগম করে বইপাড়ার অলিগলি। সর্বত্র ধরা পড়ে উৎসবের মেজাজ। ছড়িয়ে থাকে অদ্ভুত একটা ভাললাগা।
বইপাড়ায় নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস বহু পুরোনো। কেমন ছিল অতীতের উৎসবের রং? স্মৃতিচারণ করলেন মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স-এর কর্ণধার সবিতেন্দ্রনাথ রায় (ভানুবাবু)। জানালেন, আগে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বেশ কয়েকটি জায়গায় আড্ডা বসত। সঙ্গে খাওয়াদাওয়া। বেলার দিকে আমাদের ঘরে আসতেন দিকপাল লেখকরা। গজেন্দ্রকুমার মিত্র এবং সুমথনাথ ঘোষকে ঘিরে জমে উঠত আড্ডা। আলো ছড়াতেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কবিশেখর কালিদাস রায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, বনফুল, দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত প্রমুখ। কেউ পছন্দ করতেন মিষ্টি, কেউ নোনতা, কেউ ডাবের জল, শরবত, কেউ চা। কোনও কোনও বছর খাদ্য তালিকায় থাকত জনাইয়ের মনোহরা। এখন আসেন নতুন প্রজন্মের লেখকরা।
দে’জ পাবলিশিং হাউসে সাতের দশকের মাঝামাঝি শুরু হয়েছে নববর্ষের আড্ডা। কর্ণধার সুধাংশুশেখর দে জানালেন, একটা সময় আমাদের ঘরে দেখা যেত নক্ষত্রসমাবেশ। আসতেন সমরেশ বসু। তাঁকে ঘিরে ধরতেন সই শিকারিরা। এ-ছাড়াও আসতেন রমাপদ চৌধুরি, বিমল কর, সন্তোষকুমার ঘোষ, গৌরকিশোর ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, শংকর, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, নারায়ণ সান্যাল, নিমাই ভট্টাচার্য, প্রফুল্ল রায়, বরুণ সেনগুপ্ত, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ, পূর্ণেন্দু পত্রী, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, তারাপদ রায়, সুবীর ভট্টাচার্য, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, নবনীতা দেবসেন, বাণী বসু প্রমুখ। একটার পর একটা পুরাতনী গেয়ে আসর মাতিয়ে রাখতেন বুদ্ধদেব গুহ। এখন আসর মাতিয়ে রাখেন এই সময়ের লেখকরা। প্রতি বছর লেখকদের সামনে সাজিয়ে দেওয়া হয় একটি খাতা। পাতার পর পাতা ভরে যায় কবি-সাহিত্যিকদের সরস মন্তব্যে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী একবার লিখেছিলেন, ‘রোজ নববর্ষ হোক’। মন্তব্য লেখার পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের স্কেচ আঁকতেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। একবছর চার লাইনের একটি ছড়ায় পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছিলেন, ‘আমাদের মোটা-সোটা/ রয়্যালটির হেতু/ দে-জ রোজ বড় হোক/ যেন কালকেতু।’ বহু অজানা কথা উঠে আসত লেখকদের আড্ডায়। নববর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত হত বই। এবারেও আমরা কয়েকটি বই প্রকাশ করছি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উৎসাহেই কলেজ স্কোয়্যারে আমরা শুরু করেছিলাম নববর্ষ বইমেলা। এইবছর কলেজ স্কোয়্যারে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বইমেলা ও সাহিত্য উৎসব। সবমিলিয়ে নববর্ষে জমজমাট বইপাড়া।
ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান দেবসাহিত্য কুটীর। একটা সময় মহাসমারোহে উদযাপিত হত পয়লা বৈশাখ। ডিরেক্টর রূপা মজুমদার জানালেন, চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে দু’বেলা ধরে নববর্ষ উদযাপন করা হত। বাড়িতে ভিয়েন বসত। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আসতেন সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। দেবসাহিত্য কুটীর ছিল সংস্কৃতির পীঠস্থান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আসতেন মধুসূদন মজুমদারের কাছে। আসতেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অনেকেই। সারাদিন চলত আড্ডা, খাওয়াদাওয়া, গানবাজনা। সন্ধের পর উৎসবে শামিল হতেন বাবুদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এবং কর্মচারীদের পরিবার। তখন পয়লা বৈশাখে বেরত নানান বই। শাশুড়ির কাছে শুনেছি, একটা সময় ছাদে অর্ধেক জায়গায় ত্রিপল টাঙিয়ে হালখাতা রাখা হত। এখন ঠাকুরঘরে আমি নিজেই হালখাতার পুজোর আয়োজন করি। হালখাতা পনেরোটার মতো। বেশিরভাগ কাজই হয় কম্পিউটারে। ল্যাপটপ, মেশিনে ফুল দেওয়া হয়। এখন পয়লা বৈশাখে আমাদের দপ্তরে লেখকরা আসেন। আসেন পাঠকরা। আড্ডা হয়। খাওয়াদাওয়া হয়। সবার হাতে তুলে দেওয়া হয় মিষ্টি, নতুন ক্যালেন্ডার। বাঁধাইঘর ও ছাপাখানা থেকেও লোকজন আসেন। প্যাকেট ও ক্যালেন্ডারের আদান-প্রদান হয়। এইভাবেই কাটে দিনটি।
২০০৯ সাল থেকে পত্রভারতী বইবিপণিতে বসছে জমজমাট পয়লা বৈশাখের আড্ডা। কর্ণধার ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় জানালেন, কোভিডের কারণে এক বছর বন্ধ ছিল। আমাদের নববর্ষের আড্ডায় এসেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়, পবিত্র সরকার প্রমুখ প্রবীণ লেখকরা। অনীশ দেব ছিলেন আমাদের ঘরের লোক। তিনি সারাক্ষণ থাকতেন। তাঁর অভাব অনুভব করছি। এ-ছাড়াও আসেন এই সময়ের বিশিষ্ট লেখকরা। মিষ্টিমুখের ব্যবস্থা থাকে। গায়ক নচিকেতা চক্রবর্তী আসেন। তাঁর বেশকিছু বই আমরা প্রকাশ করেছি। তিনি এলে বিপণির সামনে জমে যায় ভক্তদের ভিড়। প্রতি বছর নববর্ষে আমরা কিছু নতুন বই প্রকাশ করি।
স্মৃতিচারণ করলেন কয়েকজন সাহিত্যিক। মণিশংকর মুখোপাধ্যায় (শংকর) জানালেন, আমি আগে যেতাম। অনেকের সঙ্গে দেখা হত। কোনও কোনও পয়লা বৈশাখে বেরিয়েছে আমার নতুন বই। দেখা হত পাঠকদের সঙ্গেও। ভালই লাগত।
ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় বললেন, আনন্দ পাবলিশার্সে বসত চাঁদের হাট। থাকত খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। বহু বিখ্যাত লেখক আসতেন। একবার দেখা হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে।
নববর্ষে বইপাড়ায় যান প্রচেত গুপ্ত। তিনি জানালেন, কলেজ স্ট্রিট বইপাড়াতেই পয়লা বৈশাখের ছবিটা ঠিকমতো ধরা পড়ে। সারাদিন সরগরম থাকে। লেখকরা আসেন, পাঠকেরা আসেন। সবার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়। হইচই হয়।
যতদিন বাঙালি থাকবে, ততদিন বেঁচে থাকবে বইপাড়া। ঘুরেফিরে আসবে পয়লা বৈশাখ। হালখাতাকে কেন্দ্র করে ফি-বছর বইপাড়া মেতে উঠবে নববর্ষ-উৎসবে। এই উৎসব মিশে গেছে বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গে। কোনওদিন ছেদ পড়বে না।