আশা ভোসলে (Asha bhosle) জড়িয়ে আছেন আপামর বাঙালির পুজোর গন্ধ ঘিরে। পুজোর প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসা তাঁর গান ‘চোখে চোখে কথা বলো’, ‘ময়না বলো তুমি কৃষ্ণ রাধে’, ‘মাছের কাঁটা খোঁপার কাঁটা’ যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগায় আজও। আজন্ম মারাঠি আশা কখন যেন হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি বাড়ির বউ। সুধীন দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষের হাত ধরে বাংলা গানে আশার প্রবেশ। ‘মনের নাম মধুমতী’, ‘আমি খাতার পাতায়’, ‘জীবন গান’, ‘নাচ ময়ূরী নাচ রে’ এক একটি চিরন্তন সৃষ্টি। আবার রবীন্দ্রসংগীতের রাবীন্দ্রিকতাও খুব সহজে ফুটিয়ে তুলেছেন। যে কারণে আশার কণ্ঠে আজও জনপ্রিয় ‘জগতের আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’, ‘বড় আশা করে এসেছি গো’, কিংবা ‘এসো শ্যামল সুন্দর’। আশার ক্যাবারে গান অনেক পরে এসেছে।
‘কুইন অফ ইন্ডিয়ান পপ’ ‘আশা তাই’। বড় গায়িকা না হলে নির্ঘাত হতেন বড় রাঁধিয়ে মানে গানের বদলে রান্নাই হত তাঁর পেশা। এমনটাই বলতেন তিনি সবাইকে, ‘গায়িকা না হলে পেশাদার রাঁধুনি হতাম’। পাঁচের দশকে তাঁর স্টাইলিশ কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হয়েছে আট থেকে আশি। অথচ কঠোর জীবনের সংগ্রামের ভরা ছিল তাঁর জীবন। সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির বাবা দীননাথের মৃত্যুর পর অকুলপাথারে পড়ে বোন লতাকে নিয়ে তাঁর গানের জগতে প্রবেশ। কিন্তু সাফল্যের আগে নিজেকে নিয়ে একেবারেই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না আশা। মাত্র ১৬ বছরে বিয়ে করে একটা সময় ছাড়তে বসেছিলেন গান। কিন্তু ভাগ্যের লিখন ছিল অন্য।
দিল চিজ কেয়া হ্যায় আপ মেরে…
শুরুর দিকে ভাল গানের জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতেন আশা ভোসলে (Asha bhosle)। ৫০-এর দশক লতা মঙ্গেশকর, নুরজাহান, শামসাদ বেগম, গীতা দত্তের গান গাইবার পর যে গান পড়ে থাকত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই গানগুলোই গাইতে হত তাঁকে। ভাল গানের জন্য পারিশ্রমিকের কথা ভাবতেন না কখনও। কিন্তু ‘উমরাও জান’ ছবির পরিচালক মুজফফর আলি তো সেকথা জানতেন না। তাঁর কম বাজেটের ছবি। আশাজিকে টাকা দিতে পারবেন না বলে কিছু বলতেই পারছিলেন না। পরিচালক আশার মেয়ে বর্ষাকে চিনতেন। ধরলেন গিয়ে তাঁকে। বর্ষা তখন মাকে শুধু বললেন একবার গানগুলো শুনে দেখো, পছন্দ না হলে গেয়ো না। আশা পরিচালককে ডেকে শুনলেন গানগুলো। একবার গানের সুর এবং কথা শোনার পরেই হ্যাঁ বলতে সময় নেননি। শুধু, তাই নয় এসবের বাইরে তাঁকে এমন একটা বিষয় সাহায্য করছেন যাঁর কথা সারাজীবন মুজফফর সাহেব ভুলতে পারেননি। এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রের জন্য তিনি রেখার কথা ভাবেন কিন্তু রেখা টাকার অঙ্ক শুনে একেবারেই আগ্রহ দেখাননি। তিনি ধরলেন আশা ভোসলেকে। আশা ভোসলের অনুরোধেই রেখা রাজি হয়ে যান। পরবর্তীটা তো ইতিহাস। ওই ছবিতে অভিনয়ের জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন ভানুরেখা গণেশন এবং গানের জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন আশা।
ব্রেক পেতে লেগেছিল ১৪ বছর
গান গাইবার সময় খুব সতর্ক থাকতেন আশা। যাতে তাঁর কণ্ঠ লতা, শামসাদ বেগম, নুরজাহানের মতো না শোনায়। স্বতন্ত্র গায়কি আনতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাঁকে। সফল হয়েছিলেন— তা সত্ত্বেও বলার মতো ব্রেক পেতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় ১৪ বছর। ১৯৪৩ সালে ৯ বছর বয়সে গেয়েছিলেন প্রথম গান। তাঁর ৯ বছর পর দিলীপকুমারের ‘সঙ্গদিল’ ছবিতে গান গেয়ে আরও একটু পরিচিতি পান। এরপর আশা ভোসলে কেরিয়ারে উত্থান মূল তিনটে পর্বে। একেবারে ১৯৫৭ সালে ও পি নাইয়ারের সংগীত পরিচালনায় দিলীপকুমার-বৈজয়ন্তীমালা অভিনীত ‘নয়া দওর’ ছবিতে সাহির লুধিয়ানভির কথায় মহম্মদ রফির সঙ্গে ‘মাঙকে সাথ তুমহারা’, ‘সাথী হাথ বাড়হানা’ আর উড়ে যব যব’ বড়সড় ব্রেক দিল। এরপর ওয়াক্ত, গুমরাহ, হামরাজ, আদমি ওউর ইনসান, হাওড়া ব্রিজ, মেরে সনম, কাশ্মীর কি কলি ইত্যাদি বহু হিট ছবিতে আশা ভোসলের কণ্ঠকে দারুণ ব্যবহার করেছেন ও পি নাইয়ার। একটা সময় পর্যন্ত ক্যাবারে ডান্স বিশেষত হেলেনের লিপে গান মানেই ধরে নেওয়া হত আশা ভোসলেই গাইবেন। সুপার ডুপার হিট সেই সব গান। ‘পিয়া তু আব তো’ (ক্যারাভান), ‘ও হাসিনা জুলফো ওয়ালি’ (তিসরি মঞ্জিল), ‘ইয়ে মেরা দিল প্যায়ার কা দিওয়ানা’ (ডন)-এর মতো ব্যাপক জনপ্রিয় গানের সঙ্গে লিপ দিয়েছেন হেলেন আর নেচে উঠেছে দর্শক, শ্রোতা।
আরও পড়ুন- সৌদি-কন্যা মহাশূন্যে গড়লেন ইতিহাস
আশা ভোসলে, রাহুলদেব বর্মণ
ও পি নাইয়ারের সঙ্গে একটা সময় বেশ দূরত্ব তৈরি হয় আশাজির। ঠিক তার পরবর্তী ধাপে তাঁর কেরিয়ারের উত্থানের দ্বিতীয় পর্বের শুরুটা হয় রাহুল দেববর্মণের সঙ্গে। পঞ্চমের সংস্পর্শে এসে আশা ভোসলে নতুন রূপে হাজির হলেন দর্শকদের সামনে। ১৯৬৬ সালেই ‘তিসরি মঞ্জিল’ ছবি দিয়ে পঞ্চম এবং আশার পথ চলা শুরু গানের জগতে। তিসরি মঞ্জিল ছবির জন্য ‘আযা আযা ম্যায় হুঁ প্যায়ার তেরা’ গানটার জন্য দশদিন ধরে নিজেকে তৈরি করে রেকর্ডিং করছিলেন। রেকর্ডিং শেষ হতেই মুগ্ধ রাহুল একশো টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর হাতে পুরস্কারস্বরূপ। একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কখন ৬ বছরের বড় আশার প্রেমে পড়ে যান আর ডি। পরে তাঁদের বিয়ে হয়। বহু সাক্ষাৎকারে আশা ভোসলে (Asha bhosle) বলেছেন, ‘সংগীতই ছিল আমাদের বিয়ের মূল ভিত্তি। আমরা বিসমিল্লাহ খান, বিটলস, শার্লি বাসে… এবং আরও অনেকের গান ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনতে পারতাম। সংগীতের প্রতি আমাদের ভালবাসা ছিল একই রকম এবং এটাই ছিল আমাদের চিরস্থায়ী বন্ধন।’
ক্যাবারে, রক, ডিসকো, গজল
ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল আর ডি-র সুরে কী গাননি তিনি! যে কোনও গান রেকর্ডিংয়ের আগে পঞ্চম সুরটা একটু বাতলে দিয়ে আশাকে (Asha bhosle) বলতেন, ‘এবার তুমি নিজের মতো করে গাও’। প্রত্যেকটা লাইন অন্তত দশরকম করে গাইতেন আশা। তার পর সেই দশটা থেকে শুনে সবচেয়ে পছন্দেরটা বেছে নিতেন পঞ্চম। দম মারো দম (হরে রাম হরে কৃষ্ণ), চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে (ইয়াদও কী বারাত), দুনিয়া মে (আপনা দেশ) মেহবুবা মেহবুবা (শোলে), মেরা কছ সামান (ইজাজত), পিয়া তু আব তো আজা (ক্যারাভান) তৈরি করেছিল ইতিহাস।
সংগীত জীবনে পেয়েছেন দাদাসাহেব ফালকে, পদ্মবিভূষণ, বঙ্গবিভূষণ, সাতটি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, জাতীয় পুরস্কার। তিনি অন্যতম ভারতীয় যিনি মনোনীত হয়েছিলেন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্য। এ-ছাড়া পেয়েছেন অগুনতি সম্মান এবং স্বীকৃতি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিতে ‘লতা দীননাথ মঙ্গেশকর অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে মঙ্গেশকর পরিবার। এ বছর এই পুরস্কারটি পেয়েছেন আশা ভোসলে।