শত ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যেও সত্যের পথে অবিচল থাকা, প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার শিক্ষা দেয় কারবালার স্মৃতি। সত্যাপন্থী মানুষের ধমনীতে প্রবাহিত রক্তের শোধন করার কথা স্মরণ করায় কারবালার স্মৃতি। সেই স্মৃতি আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কবি যখন বলে ওঠেন, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর কারবালা কে বাদ।’ কারবালার দিন স্মরণ করে সত্যপন্থী মানুষ জেগে ওঠে নতুন করে।
মহরম মাস আরবি বর্ষের সূচনার মাস। এই মাসের ১০ তারিখ হল আশুরা। আশুরা শব্দের অর্থ দশ। এদিন কারবালা প্রান্তরে শহিদ হয়েছিলেন, হজরত মহম্মদ সা.-এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত হোসাইন রা.। এদিন কারবালা প্রান্তরে সত্য ও গণতন্ত্রের পতাকা তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল জালিমের খঞ্জরে।
আরও পড়ুন-দোষী সাব্যস্ত যোগীর মন্ত্রী আদালত থেকে নিখোঁজ
আশুরা আদতে কী তা জানতে চোখ রাখতে হয় আবর ইতিহাসে। অসংগঠিত, শৃঙ্খলাহীন ও যাযাবর আরব জাতিকে সংগঠিত করতে, মানব প্রেম ও একেশ্বর প্রেমের নিবিড় পাঠ দিতে মক্কায় জন্মালেন হজরত মহম্মদ সা.। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। বহুত্ববাদী পরিবারে জন্মালেও বাল্যকাল থেকেই তিনি একেশ্বরবাদের প্রচার করতে শুরু করেন। ‘হেরা’ পর্বতের গুহাবাসী হয়ে তপস্যায় ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত বা সিদ্ধিলাভ করলেন তিনি।
তারপর থেকেই শুরু হল একেশ্বরবাদ ও গণতন্ত্রের প্রচার। ঘরে বাইরে বাড়তে থাকল শত্রু। নাছোড় মহম্মদ সা.। তিনি জনগণকে একেশ্বরবাদে সংগঠিত করতে লাগলেন। কুড়ি বছরের কঠিন লড়াইয়ে অনেকগুলো যুদ্ধ করতে হয়েছে। অত্যাচারের মাত্রা ক্রমে তীব্র হতে থাকল। ৬২২ সালে বাধ্য হয়ে তাঁকে মাতৃভূমিও ত্যাগ করতে হয়।
আরও পড়ুন-দিন-গাজন রাত-গাজন
মক্কা ছেড়ে মদিনায় এসেও তাঁর প্রচার থামেনি। অবশ্যে ততদিনে মদিনার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ফলে, তাঁরা নবীর একেশ্বরবাদের ছাতায় এসে গেলেন সহজে। এটা সত্য যে, নবীকে মক্কার আগে মদিনার মানুষ গ্রহণ করেছিলেন আগেই। মদিনার মানুষের সাহায্য নিয়ে কুড়ি বছর লড়াই চালান। এ সময় বিশ্বস্ত সেনাপতি হিসেবে ছিলেন জামাতা হজরত আলি রা.। মদিনাবাসীর সাহায্যে মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে জয় হয়েছিল গণতন্ত্র ও একেশ্বরবাদের। এরপর আরব জাতি হলেন সংগঠিত। এবং একেশ্ববাদের দৃঢ় সংকল্পে স্থির থাকল সংগঠিত মানুষ। এমনি করে আরবে গণতন্ত্র ফিরল হজরত মহম্মদ সা.-র হাত ধরে। মক্কা জয়ের পর নবী বেশিদিন হায়াতে ছিলেন না। কিন্তু আরব জাতিকে তিনি সংঘবদ্ধ করেছিলেন জীবদ্দশাতে। এবং আরব দেশকে তিনি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হজরতের মৃত্যু হল। বহাল রইল ইসলামের গণতন্ত্র। কিন্তু লোভ মুছে গেল না আরব জাতির সবার হৃদয় থেকে। তারই চূড়ান্ত পরিণতিতেই ৬৮০ সালে কারবালার যুদ্ধ। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে একনায়কতন্ত্রের জয়।
আরও পড়ুন-অবনীন্দ্রনাথ এবং আরও কয়েকজন
ফিরে আসি আগের কথায়। হজরত মুহম্মদ সা.-এর পর একে একে আবু বক্কর সিদ্দিকী রা., হজরত ওমর ফারুক রা., হজরত ওসমান গণি রা. খলিফা হন। সর্বশেষ খলিফা হলেন নবীর জামাতা হজরত আলি রা.। উল্লেখ্য, হজরত ওমর রা.-এর রাজত্বকালে ইসলামি ভাবধারার চূড়ান্ত ব্যাপ্তি ঘটে। পরবর্তীতে হজরত আলি রা.-এর শাসনকালে তার সাংস্কৃতিক সম্প্রসারণ ঘটানো হয়। দক্ষ শাসক ছিলেন হজরত আলি রা.। এবং চার খলিফার মধ্যে তিনিই ছিলেন সংস্কৃতিমনস্ক। তিনি নিজেও কবিতার চর্চা করতেন। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীন আরবি সাহিত্যে কবি ইমরুল কায়েশ-এর পর হজরত আলি রা. ছিলেন শক্তিশালী কবি। ইরানের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে হজরত আলির রা.-এর কবিতা পড়ানো হয়।
আরবে সেই সময় সাহিত্যর সংস্কৃতিচর্চার ভাবধারা প্রভাব বিস্তার করেছিল আরবের বাইরেও। হজরত আলি রা.-এর আমলেই এই বিস্তার ঘটে। এমন একজন দক্ষ শাসক মর্মান্তিকভাবে খুন হয়ে গেলেন ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে। বলা হয়, হজরত আলি রা.–এর মৃত্যুর পর কার্যত হজরত মহম্মদ সা. প্রতিষ্ঠিত শক্তিশালী গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের সূচনা হয়ে যায়। এবং ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে কারবালা যুদ্ধের পর সেই গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটে। শুরু হয় রাজতন্ত্রের।
আরও পড়ুন-অবনীন্দ্রনাথ এবং আরও কয়েকজন
হজরত আলি রা. খুন হয়ে যাবার পর ইরাকের কুফা প্রদেশের শাসক মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ নিজেকে খলিফা ঘোষণা করে বসেন। কুফাবাসী যা চাননি। শুরু হয় দ্বন্দ্ব-কলহ। শাসক ইয়াজিদ এমনিতেই কুফার মানুষের গণতন্ত্র লুণ্ঠিত করেছে। তার ওপর গণতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে নিজেকে খলিফা ঘোষণা করায় ক্ষুদ্ধ হন কুফার জনগণ। এর সুষ্ঠ সমাধান চেয়ে কুফাবাসীরা চিঠি লিখে হজরত আলি রা.-এর পুত্র হজরত হোসাইন রা.-কে খলিফা হওয়ার আমন্ত্রণ জানান। কুফাবাসীরা মনে করেছিলেন, আলি রা.-পুত্রকে অমান্য করতে পারবেন না অত্যাচারী ইয়াজিদ। কারণ তাঁর পিতা মুয়াবিয়াকে হজরত মহম্মদ সা. মক্কা বিজয়ের পর ক্ষমা করেছিলেন। কারণ, ইসলাম প্রচারে সবচেয়ে বিরোধিতা করেছিলেন মুয়াবিয়া। মক্কা বিজয়ের পর পরাজিত মুয়াবিয়ার মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তির কথা। নবী তা করেননি। ক্ষমা করেছিলেন মুয়াবিয়াকে। ক্ষমা প্রপ্তির পর তিনি নবীর একান্ত সহচর হন। তার পরে মুয়াবিয়া ও তার পুত্র ইয়াজিদকে কুফা প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। কুফাবাসী মনে করেছিলেন নবী হোসাইন রা. খলিফা হলে কুফায় গণতন্ত্র ফিরবে। এবং বিদ্রোহী ইয়াজিদকে অপসারণ করবেন।
আরও পড়ুন-বইপাড়ার বনস্পতি
কুফাবাসীর বার্তা পেয়ে শেষ পর্যন্ত হজরত হোসাইন রা. তাঁর সঙ্গী ও পরিবার নিয়ে রওয়ানা দিলেন কুফার উদ্দেশ্যে। কিন্তু কুফা যাওয়ার পথে ইরাকের কারবালা প্রান্তরে অবরুদ্ধ হলেন তিনি। কারবালা প্রান্তরেই তাঁবুতে অবস্থান করতে শুরু করলেন হোসাইন রা. সঙ্গী ও পরিবারের সকলে। ইয়াজিদ অবরোধ করে রাখল ফোরাত নদী। এক আঁজলা পানি দিতে চায়নি বিদ্রোহী ইয়াজিদের লোকজন। এক সপ্তাহ অবরোধে থাকার ফলে তাঁবুতে তখন খাদ্য ও পানীয় শেষ। অনিবার্য হয়ে উঠল যুদ্ধ। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর শুরু হয় কারবালা মাঠে সেই ঐতিহাসিক সংঘর্ষ। যুদ্ধ শেষে তাঁবুর মহিলা, শিশু ছাড়া সমস্ত পুরুষ সদস্য শহিদ হলেন। গণতন্ত্রের মৃত্যু হল। জয় হল স্বৈরতন্ত্রের। দিনটা ছিল ১০ মহরম।
কারবালার মর্মান্তিক যুদ্ধের কথা আরবের অন্যান্য প্রদেশে পৌঁছতে সময় লেগেছিল। আজকের মতো যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকাই এর কারণ। না হলে নবী-নাতির খুন হয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় গৃহযুদ্ধ ঘটে যাবার সম্ভাবনা ছিল। দেরিতে খবর প্রচারিত হলেও নবীর ক্ষমাকে আদর্শ মনে করে ইয়াজিদ ক্ষমিত হলেন। কিন্তু কারবালার খলনায়ককে মন থেকে মুছে ফেলতে পারল না গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ। প্রতি বছর আশুরার দিনটাকে আজও স্মরণ করে সমগ্র পৃথিবীর ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা।
আরও পড়ুন-লাল-গেরুয়া ভাই ভাই, স্ক্যামে ওরা জগাই-মাধাই
মহরমের সামাজিক শিক্ষা হল, কারবালার স্মৃতি স্মরণ করে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা নিয়ম করে স্বৈরতন্ত্রকে ঘৃণা ও গণতন্ত্রের সেবা করার বার্তা দিয়ে থাকে। আশুরা পালিত হয় সমগ্র পৃথিবীতে। তবে শিয়া মতাবলম্বীদের আশুরা পালন একটু অন্যমরকম। শিয়ারা মহরম মাসের শুরু থেকে দশ দিন দশ রকমভাবে পালন করে। শিয়া মতাবলম্বীরা বাড়িতে রান্না করেন না। বসতির কোথাও লঙ্গরখানা খোলা হয়। তিন বেলার খাবার বাড়ি বাড়ি বিতরণ করা হয়। সুুন্নি মতাবলম্বীরা আশুরার দিন উপোস করেন। মৃত্যু-বাড়িতে যেভাবে শোকের আবহাওয়া থাকে সে-ভাবেই সুন্নি-বাড়িতে পরিবেশ থাকে। কোথাও কোথাও মর্শিয়া বা স্মৃতি–গীতের আসর বসে।
আরও পড়ুন-বিধানসভায় আসন বিন্যাস
ষষ্ঠ শতাব্দীর আশির দশকে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমগ্র পৃথিবীর সাহিত্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে। বাংলায় কারবালার স্মৃতিতে প্রথম সাহিত্য রচনা করেন মীর মোশাররফ হোসেন। কারবালা স্মৃতি-সাহিত্য ‘বিষাদসিন্ধু’ বহু হিন্দু পরিবারেও পঠিত হয়। এ-ছাড়া কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘মুহররম’ কবিতাটি আশুরার অনেক অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়। বাংলায় একমাত্র শোকস্মৃতি আশুরার মিছিলে মানবিক সমর্থন থাকে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের। যেহেতু এটা শোক উদ্যাপন।