সালটা ১৯১৩। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে লন্ডনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে এসছেন এক ঝকঝকে বাঙালি তরুণ। সেখানে তাঁর দেখা হল শান্ত, লাজুক স্বভাবের রামানুজনের সঙ্গে। কোন রামানুজন? বিখ্যাত ভারতীয় গণিতবিদ। যাঁর জন্মদিন, ২২ ডিসেম্বরে ভারতে ‘জাতীয় গণিত দিবস’ হিসাবে পালিত হয়। বাঙালি যুবকটির চেয়ে বছর চারেকের বড় রামানুজন। এখানেই তাঁদের দু’জনের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। এই রামানুজন তাঁকে শিখিয়েছিলেন ‘শূন্য’-কে হিন্দু দর্শনের নির্গুণ-ব্রহ্মের প্রতীক হিসাবে, ‘ইনফিনিটি’ বা ‘অসীম’-কে সমস্ত সম্ভাবনার সামগ্রিকতার সঙ্গে এক করে দেখতে, আর অন্য সকল সংখ্যাকে এই দুইয়ের গুণফল হিসেবে ভাবতে। কে এই বাঙালি তরুণ? সেই বাঙালি তরুণটি হলেন রাশিবিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। যাঁর যুগোত্তীর্ণ মহান সৃষ্টি হল ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট বা (আইএসআই)। রাশিবিজ্ঞান বিষয়টাকে সেই সাতসাগরের ওপার থেকে তিনিই নিয়ে এসেছিলেন এই দেশে।
আরও পড়ুন-বিভাজনের রাজনীতি বাংলায় খাটছে না
রাশিবিজ্ঞানীর জন্ম
২০১৫ সালে কেমব্রিজের পাট চুকিয়ে প্রশান্তচন্দ্র দেশে ফেরার জন্য প্রস্তুত। বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে নিয়ে তিনি তৈরি। জাহাজে রওনা দেবেন ঠিক সেই সময় জানতে পারলেন তাঁর জাহাজটি একটু দেরিতে ছাড়বে। এই সামান্য একটা ঘটনাই পরবর্তীতে বদলে দিয়েছিল ভারতীয় বিজ্ঞানের ইতিহাস। জাহাজ ছাড়তে দেরি আছে। কী করবেন ওই ফাঁকে একবার ঘুরতে গেলেন কিংস কলেজের লাইব্রেরিতে। ঘুরে ঘুরে বই দেখছিলেন। সেখানকার শিক্ষক ম্যাকালে লক্ষ্য করলেন প্রশান্তচন্দ্রের বিজ্ঞানের বই সম্পর্কে প্রবল আগ্রহ। তিনি তখন প্রশান্তকে বিশ্ববিখ্যাত রাশিবিজ্ঞানী কার্ল পিয়েরসনের স্ট্যাটিসটিক্স জার্নাল ‘বায়োমেট্রিকা অ্যান্ড বায়োমেট্রিক টেবলস’ সংক্ষেপে ‘বায়োমেট্রিকা’র দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ওই প্রথম তাঁর সংখ্যায়ন বা স্ট্যাটিসটিকস সম্পর্কে কৌতূহলের শুরু। তখন ন’টা খণ্ডের সেই বই কিনে নিলেন তিনি। ওই বইটি পড়ার পরে ঘুরে গেল তাঁর জীবনের গতিপথ। জন্ম হল এক যুগস্রষ্টা রাশিবিজ্ঞানীর।
শৈশব
প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ এক বিশিষ্ট বাঙালি, বিজ্ঞানী,পরিসংখ্যানবিদ। পরিসংখ্যানের ক্ষেত্র এবং সামাজিক গবেষণায় তাঁর অবদান অপরিসীম। তাঁকে ভারতের আধুনিক পরিসংখ্যানের জনক বলা হয়। প্রশান্তচন্দ্রের পিতামহ ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গুরুচরণ।
গুরুচরণের ওপর রবিঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর খুব প্রভাব ছিল। এই গুরুচরণের বড় ছেলে সুবোধচন্দ্র এবং ছোট ছেলে প্রবোধচন্দ্র। প্রবোধচন্দ্রই হলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের বাবা। ছয় সন্তানের সবচেয়ে বড় হলেন প্রশান্তচন্দ্র। ২১০ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে ১৮৯৩ সালের ২৯ জুন তাঁর জন্ম। মহলানবিশ কলকাতার ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং ১৯০৮ সালে স্নাতক হন। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দেন, যেখানে তিনি যে শিক্ষকদের সান্নিধ্য পান তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু এবং প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
আরও পড়ুন-ক্লাইভের বাড়ি সংস্কারের আর্জিতে মামলা
গবেষণা ও কর্মজীবন
১৯২২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। তিনি পরের তিন দশক ধরে কলেজে পদার্থবিজ্ঞান পড়ান। অধ্যাপনার পর বাকি সময় রাতদিন বুঁদ হয়ে থাকতেন রাশিবিজ্ঞানের গবেষণায়। সেই সময় বেশ কয়েকজন উৎসাহী ছাত্রকে নিয়ে নিজের কলেজেই গড়ে তুলেছিলেন সংখ্যায়ন গবেষণাগার। পরে তাঁরই অদম্য উদ্যোগে স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এবং প্রমথনাথ মুখোপাধ্যায়, নিখিলরঞ্জন সেন ও আরও কয়েকজনের উদ্যোগে এক সভায় স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট স্থাপনের বিষয়টি অনুমোদিত হয়। সেই চেষ্টার ফলশ্রুতিতেই ১৯৩১ সালের ১৭ ডিসেম্বর স্থাপিত হয় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট। আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এই ইনস্টিটিউটের সুনাম আজ বিশ্বের সর্বত্র। তাঁর বিশাল কর্মকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম ‘মহলানবিশ দূরত্ব’ নামক একটি পরিসংখ্যানগত মাপ তৈরি করেন, যা দুটি ডেটার মধ্যে তুলনা করার জন্য ব্যবহৃত হয়। তিনি আবহাওয়া বিজ্ঞান এবং নৃতত্ত্বের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রেও রাশিবিজ্ঞানের প্রয়োগ করেন এবং ‘ফোটোগ্রাফিক প্রোফাইলোস্কোপ’ নামক একটি যন্ত্র তৈরি করেন যা নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় কাজে লাগত। নিজে হাতে তৈরি করেছিলেন আরও একটি যন্ত্র, যার নাম ‘কোঅর্ডিনেটোগ্রাফ’, যা দরকার হত শস্য-সম্পর্কিত সমীক্ষার প্রয়োজনে। স্বাধীন ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, যার প্রস্তাব করেছিলেন মহলানবিশ যা পরবর্তীতে মহলানবিশ পরিকল্পনা নামে খ্যাত হয়।
মহলানবিশকে বলা হয় ভারতের রাশিবিজ্ঞানের ভগীরথ। তিনি নিজের হাতে রাশিবিজ্ঞানের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র যে বীজটি বপন করেছিলেন ক্রমে তা মহীরুহ হয়ে ওঠে। এই যাত্রাপথে তাঁকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন এক ঝাঁক দক্ষ তরুণ, পরবর্তী কালে যাঁরা নিজেরাও হয়ে উঠেছেন এক-একজন মাইলস্টোন।
তৎকালীন সরকার ১৯২২-এর উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ বন্যা সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট নিয়ে প্রশান্তচন্দ্রের মতামত জানতে চেয়েছিল, তিনি ৫০ বছরের বৃষ্টিপাত ও বন্যার পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করেন যা কার্যকরী হিসেবে প্রমাণিত হয়। একইভাবে ওড়িশার ১৯২৬ সালের বন্যা প্রসঙ্গে তাঁর ৬০ বছরের তথ্যের বিশ্লেষণ-ভিত্তিক সুপারিশের নির্ভুল যুক্তিতেই মহানদীতে হীরাকুঁদ বাঁধ তৈরি করা হয়। তিরিশের দশকে মহলানবিশ এক উল্লেখযোগ্য নমুনা সমীক্ষা করেন বাংলার পাট উৎপাদন নিয়ে। তাঁর উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় স্টেট স্ট্যাটিসটিক্যাল ব্যুরো। ব্রিটেন বা ইউরোপের তুলনায় ভারতে যে অনেক দেরিতে এই রাশিবিজ্ঞান চর্চা শুরু হয়, সেই সূচনার একক কৃতিত্ব বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের।
আরও পড়ুন-পেশাকে অপমান, সুকান্তর বিরুদ্ধে রাজপথে সোনাগাছি
ছিলেন রবীন্দ্র অনুরাগী
প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক ছিল গভীর এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর পথপ্রদর্শক বন্ধু। মহলানবিশের প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের কাগজপত্রে রবীন্দ্রচর্চার বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া যায়, যা থেকে তাঁদের সম্পর্কের গভীরতা বোঝা যায়। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামে একটি গ্রন্থও সম্পাদনা করেছেন, যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কিত তাঁর বিভিন্ন রচনা ও মূল্যায়ন সংকলিত হয়েছে। শুধু রাশিবিজ্ঞানে নয়, রবীন্দ্র গবেষণাতেও সমান সাবলীল ছিলেন তিনি। প্রশান্তের রাশিবিজ্ঞান গবেষণাতেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিল অসীম সস্নেহ আগ্রহ। ১৯২২ থেকে ১৯২৬ সালে প্রশান্তচন্দ্রের আলিপুর ‘অবজারভেটরি’তে আবহাওয়াবিদ হিসেবে কর্মজীবনকালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাসভবনে বহুবার এসেছেন। প্রশান্তচন্দ্র ব্রাহ্মনেতা হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের কন্যা নির্মলকুমারীর বিবাহ উপলক্ষে আশীর্বাণী স্বরূপ খুব সুন্দর
একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবির ইউরোপ
যাত্রায় ছায়াসঙ্গী ছিলেন সস্ত্রীক প্রশান্তচন্দ্র। গোটা দুিনয়ায় পরিসংখ্যান দিবস পালিত হয় অক্টোবরের ২০ তারিখ। ভারতে কিন্তু সেই দিনটি হল ২৯ জুন। অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের জন্মদিনকেই বেছে নেওয়া হয়েছে পরিসংখ্যান দিবস হিসেবে, স্বাধীন ভারতের উন্নয়নযজ্ঞে তাঁর অবিস্মরণীয় ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিতে। আর, ২৮ জুন হল তাঁর মৃত্যুদিন।