দীর্ঘ দুরূহ পথের শেষে

রবীন্দ্রনাথের 'দেবতার গ্রাস'কে অপেরা লিব্রেটো-র রূপ দিয়েছিলেন তিনি। মাইকেলের 'মেঘনাদ বধ' থেকে উপেন্দ্রকিশোরের 'টুনটুনির বই' তাঁরই করা ইংরেজি তর্জমায় অ-বিশ্ব পাঠকের দরবারে ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্রিটেনে বঙ্গবিদ্যাচর্চার সেই স্থানটি শূন্য হয়ে গেল উইলিয়াম রাদিচের প্রয়াণে। লিখছেন বিতস্তা ঘোষাল

Must read

তিনি মনে করতেন, সাহিত্যসেবার একটা বড় ক্যানভাস হল অনুবাদ। বৃহত্তর সাহিত্যকে অনুবাদ করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এক সংস্কৃতি থেকে অন্য সংস্কৃতিতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। যুগ যুগ ধরে এই অনুবাদই ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে দুটো দেশকে কাছে এনে দিয়েছে।
তাঁর এ-বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য ছিল— যদি ট্রানস্লেশনকে একটি ছাঁকনির ওপর রাখা হয়, যেমন করে সোনা থেকে খাদ বের করা হয়, তাহলে দেখা যাবে বাহুল্য বা বাড়তি যেটুকু তা ছাঁকনি দিয়ে পড়ে গেছে, কিন্তু যেটুকু নিরেট ও নিখাদ তা ঠিকই ছাঁকনিতে থেকে যাবে। সেই নিখাদ নিরেটই সাহিত্যকর্মের আসল শক্তি। এবং তা অনুবাদ ছাড়া অপূর্ণ। তিনি উইলিয়ম রাদিচে।
সারা বিশ্বের ইংরেজি পাঠকদের কাছে ভারতীয় বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যকে তুলে ধরার নেপথ্যে এই মানুষটির অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর পূর্বপুরুষ ইতালি থেকে এসে লন্ডনে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ধীরে ধীরে তাঁরা ক্রমশ ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করে ব্রিটিশ নাগরিক হয়ে ওঠেন।

আরও পড়ুন-পড়ুয়ার ট্যাবের টাকা গায়েবের ঘটনায় সিট গঠন করে তদন্তে কলকাতা পুলিশ

উইলিয়ম রাদিচের জন্ম লন্ডনেই ১৯৫১ সালের ১০ নভেম্বর। শিক্ষাও সেখানেই। ভারতে এসেছিলেন উনিশশো ঊনসত্তর সালে। অক্সফোর্ড যাওয়ার আগে। একটি ভারতীয় পাবলিক স্কুলে কয়েক মাস পড়ানও। তখনই দিল্লি, বেনারস, চেন্নাই, কলকাতা— এসব জায়গায় আসেন। ভারতের যত জায়গায় গেছিলেন, তার মধ্যে কলকাতা তাঁর সবচেয়ে ভাল লেগেছিল— এ কথা তিনি বারবার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন।
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে (সোয়্যাস) বাংলা ভাষা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন তিনি। বাংলা শিখেছিলেন বাংলা শিখবেন বলেই। অক্সফোর্ডে ইংরেজিতে ডিগ্রি করার পর তিনি ভাবছিলেন, অতঃপর কী করবেন। তাঁর এক বাঙালি বন্ধু তাঁকে বাংলা পড়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, কাজ করার মতো অনেক উপাদান তিনি বাংলা ভাষায় পাবেন।

আরও পড়ুন-মোদীরাজ্যে সরকারি প্রকল্পের টাকার লোভে ৭ জনের অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি, মৃত ২

ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্যে তাঁর আগ্রহ ছিল। এর সঙ্গে যোগ হল ভাষা শেখার আগ্রহ। অতঃপর অধ্যাপক তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে বাংলা শিখে তাঁর শিষ্য হয়ে উঠলেন। কারও কারও ধারণা, একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রাদিচেকে আলোড়িত করেছিল, এটা ঠিক, তিনিও এ কথা বলেছেন বিভিন্ন সময়। শুধু ভাষাকে কেন্দ্র করে এমন আন্দোলন তিনি এর আগে দেখেননি। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর আগ্রহ বাড়ার এটাও একটা কারণ।
অনেকে মনে করেন, বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর আরও একটি আকর্ষণের কারণ— ব্রিটিশ শাসনের সময় তাঁর পিতামহ এবং তারপর তাঁর পিতৃব্য অবিভক্ত বাংলার আইসিএস অফিসার হিসেবে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেই সূত্রেও তিনি ছেলেবেলা থেকে বঙ্গদেশ এবং ভারতবর্ষের অনেক গল্প-কাহিনি শুনে ছিলেন, যা তাঁকে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে কৌতূহলী করে তুলেছিল। বিখ্যাত পরিচালক, লেখক ও চিত্রকর সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাও তাঁর ভেতরে মুগ্ধতা তৈরি করেছিল। এছাড়া তাঁর মা বেটি রাদিচেও ছিলেন সেই সময়ের ধ্রুপদী ল্যাটিন সাহিত্যকর্মের বিখ্যাত অনুবাদক ও সম্পাদক। এই বিষয়টাও তাঁর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
সব মিলিয়েই ক্রমশ তিনি ভারত তথা বাংলাভাষাপ্রেমী হয়ে ওঠেন। দুই বছর বাংলা পড়াশোনার পর বাংলায় ডিপ্লোমা করেন । তাঁর আগে কোনও ছাত্র সেখানে বাংলা নিয়ে পড়েননি।
সেই সময়ই তিনি ঠিক করেন, বাংলা ভাষার সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করবেন। কিন্তু তখনই শুরু করতে চাননি। এরপর নানা চাকরি, স্কুল শিক্ষকতা করেন।

আরও পড়ুন-মহারাষ্ট্রে অ্যাম্বুল্যান্সের অক্সিজেন সিলিন্ডারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ

১৯৮০ সালে অক্সফোর্ডে ফিরে মাইকেলের ওপর থিসিস লিখতে শুরু করেন। একই সময় রবীন্দ্রনাথের লেখা অনুবাদ করার জন্য পেঙ্গুইন থেকে একটি ফরমাশ পান।
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ‘স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ়’ (সোয়্যাস)-এর বাংলা ভাষার অধ্যাপক হন এরপর। এবং তখন থেকেই সক্রিয় ভাবে শুরু হয় বাংলার প্রথিতযশা লেখকদের লেখার অনুবাদের কাজ।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ তর্জমা করেন ‘দ্য পোয়েম অব দ্য কিলিং অব মেঘনাদ’ নামে।তাঁর কাছে মাইকেল অনুবাদ ছিল সহজ কাজ, কারণ শব্দাবলী অভিধানে পাওয়া যায়। শব্দও সীমাবদ্ধ। তাই তা দিয়েই শুরু হয় অনুবাদ।
এরপর উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘টুনটুনির বই’ তাঁর হাতে হয়ে ওঠে ‘দ্য স্টুপিড টাইগার অ্যান্ড আদার টেলস’।
ইংরেজিভাষী বহির্বিশ্বে এ-ভাবেই বাংলার ভাষা, সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ দূত হয়ে ওঠেন তিনি।
তবে তিনি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি ভাষান্তরের মূল পাণ্ডুলিপি নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজের পাশাপাশি অনুবাদ করেছেন রবি ঠাকুরের ৩০টি গল্প।
পেঙ্গুইনের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে রবিঠাকুরের ৪৮টি কবিতার কাব্যানুবাদ করেন ‘আধুনিক’ ইংরেজিতে এবং সেই অনূদিত কবিতা দিয়ে এমন একটি সংকলন প্রকাশ করেন, যা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ইংরেজ পাঠকদের কৌতূহল নতুন করে জাগিয়ে তোলে। এতে ‘দুই বিঘা জমি’র মতো আখ্যানমূলক কবিতা যেমন ছিল, তেমনি ‘সোনারতরী’, ‘শা-জাহান’ এবং শেষ দিকের গদ্যকবিতাও ছিল।
রাদিচের এই অনুবাদগ্রন্থটি আকারে ছোট, কিন্তু অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর ইংরেজ কবি ও সম্পাদক ক্যাথলিন রেইন এর আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ যে এত বড় কবি ছিলেন, তা তিনি এ- গ্রন্থ পড়ার আগে জানতেন না। এতদিনে তিনি অনুভব করছেন বিশ শতকের দুই শ্রেষ্ঠ কবি হলেন ইয়েটস আর রবীন্দ্রনাথ।
ব্রিটেনে তখন ‘দ্য রাজ কোয়ার্টেট’ উপন্যাসগুচ্ছ এবং তার ওপর ভিত্তি করে রচিত টিভির একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠান ‘দ্য জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন’, একাধিক নামকরা চলচ্চিত্র ‘গান্ধী’, ‘আ প্যাসিজ টু ইন্ডিয়া’ ইত্যাদি ফেলে আসা ভারতবর্ষ সম্পর্কে যে নস্টালজিয়া জেগে উঠছিল, তা-ও রবীন্দ্রনাথের পুনর্জাগরণে সহায়তা করে। সেই সঙ্গে অনুবাদক হিসেবে রাদিচেও পরিচিতি লাভ করেন।
‘জীবিত ও মৃত’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘কাবুলিওয়ালা’র ভাষান্তর ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের ‘কণিকা’, ‘লিখন’, ‘স্ফুলিঙ্গ’র অণুকবিতাগুলি নিয়ে রাদিচে লেখেন ‘পার্টিকলস, জটিংস, স্পার্কস’।

আরও পড়ুন-শিশু দিবসের ভোরে পাহাড়ে চেনা ছন্দে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

তাঁর ভাষান্তরে ‘দেবতার গ্রাস’ (স্ন্যাচড বাই দ্য গডস)-এর অপেরাধর্মী উপস্থাপনা করেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সুরকার পরম বীর। এমনকী ২০১২ নাগাদ কলকাতায় ইংরেজিতে ‘রাজা’ নাটকে রাজার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রাদিচে। থেকেছেন বিশ্বভারতীতেও দীর্ঘদিন। স্কটিশ সেন্টার অফ রবীন্দ্র স্টাডিজ-এর মুখ্য উপদেষ্টাও ছিলেন তিনি। তাঁর উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের লেখা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু হয়।
ইতিপূর্বে ২০০২ সালে, তিনি ৭৮৪ পাতার গ্রন্থ ‘মিথস অ্যান্ড লিজেন্ডস অফ ইন্ডিয়া’র সম্পাদনা করেন, এই বইটিতে হিন্দু পুরাণের পাশাপাশি মুসলিম, বৌদ্ধ, জৈন, সিরিয়ান, খ্রিস্টান এবং উপজাতীর থেকে কিংবদন্তি এবং লোককাহিনিগুলো ঠাঁই পেয়েছে।
নিজেকে ‘প্রাউড ট্রান্সলেটর’ বলে অভিহিত করলেও নিজের কবিতার জন্য পেয়েছেন ‘নিউডিগেট অ্যাওয়ার্ড’ ও ১৯৮৫ সালে পান আনন্দ পুরস্কার।
অনুবাদ ছাড়াও লিখেছেন ৩০টিরও বেশি নিজস্ব গ্রন্থ, সম্পাদক হিসাবেও একাধিক গ্রন্থের জনক তিনি। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ‘Teach Yourself Bengali’ গ্রন্থটি প্রাচ্যে যথেষ্ট আলোড়ন তৈরি করে।
বাংলা ভাষা সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষটি চলে গেলেন নিজের জন্মদিনেই। ১০ নভেম্বর, ২০২৪-এ। রয়ে গেল তাঁর বিস্তৃত গ্রন্থসম্ভার।

Latest article