দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষে স্বীকৃতি, বাংলা এখন ধ্রুপদী ভাষা

লড়াইয়ের পতাকা ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। দাবি ছিল, আমাদের মায়ের ভাষা, আমাদের মিষ্টি ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি দিতে হবে। অবশেষে এল সেই শিরোপা। কাকে বলে ধ্রুপদী ভাষা? এই স্বীকৃতির যোগ্যতা মান কী কী? সেসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় বাংলা ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক ড. অর্ণব সাহা

Must read

লড়াইটা আরম্ভ হয়েছিল ২০১৩ সালে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐকান্তিক আগ্রহে এবং উপদেশে। একঝাঁক বিশিষ্ট বাঙালি স্কলার ও অধ্যাপক দীর্ঘ অধ্যবসায়ের সঙ্গে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন বাংলা যে ভারতের অন্যতম একটি ধ্রুপদী ভাষা, তা প্রমাণ করার। ৩ অক্টোবর, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা বাংলা-সহ আরও চারটি ভাষা—পালি, প্রাকৃত, মারাঠি ও অহমিয়াকে ‘ধ্রুপদী ভাষা’-র মর্যাদায় উন্নীত করেছে। বাংলার মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন—“অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমাদের দীর্ঘ লড়াইয়ের পর আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে ভারত সরকার একটি ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। অনেকদিন ধরে আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের কাছে এই সংক্রান্ত গবেষণালব্ধ বিপুল তথ্য জমা দিয়ে দাবি করছিলাম যাতে বাংলা ভাষাকে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আজ আমাদের স্বপ্ন পূরণ হল। কেন্দ্রীয় সরকার আজ সন্ধ্যায় আমাদের দাবি মেনে নিয়েছে।” কলকাতার ‘আইএলএসআর’ (ইনস্টিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ)-র গবেষকেরা গত বছরেই চার খণ্ডের বিশাল গবেষণাপত্র তৈরি করেছিলেন, বাংলা ভাষার ধ্রুপদী রূপ প্রমাণের স্বপক্ষে। এই যৌথ কৃতিত্ব তাই বাংলার শ্রেষ্ঠ মনীষার গুণ, অনুসন্ধিৎসা, একাগ্রতাকেই আরেকবার প্রমাণ করল।

আরও পড়ুন-আজ থেকে কমবে বৃষ্টি, স্বস্তি পুজোয়

কোন ভাষাকে ‘ধ্রুপদী’ বলা হবে, কোন কোন বৈশিষ্ট্য বা বিশেষত্ব থাকলে সেই ভাষা ‘ধ্রুপদী’র মর্যাদা পাবে, তার মান্য নিরিখও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক। যেমন, ২০০৪ সালে যখন তামিল ভাষাকে ‘ধ্রুপদী’ আখ্যা দেওয়া হয়, তখন যে বৈশিষ্ট্যগুলি চিহ্নিত করা হয়েছিল তা হল, অন্তত একহাজার বছরের পুরনো ভাষাতাত্ত্বিক নিদর্শনবিশিষ্ট টেক্সট, প্রজন্মের পর প্রজন্মবাহিত ওই ভাষায় রচিত উন্নত মানের সাহিত্যের বিস্তৃত নিদর্শন, ওই সাহিত্যিক ধারাবাহিকতা যেন অন্য ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়, তাদের যেন পূর্ণ মৌলিকতা থাকে। এইবছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালে, এই মান নির্ধারক কমিটি ছিলেন সাহিত্য আকাদেমি। টেক্সটের প্রাচীনত্বের সীমা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৫০০-২০০০ বছর, গদ্যসাহিত্যের নিদর্শন থাকার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, একইসঙ্গে বলা হয়েছে, ধ্রুপদী ভাষার প্রাচীন স্তরের চেহারার সঙ্গে বর্তমানের চেহারার মৌলিক ফারাক থাকতেও পারে। সবক’টি ক্ষেত্রেই বাংলা তার ধ্রুপদী ভাষা হয়ে ওঠার কাম্য মান স্পর্শ করেছে। বাংলার শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ব্রাত্য বসু ট্যুইট করেছেন—‘‘আইএলএসআর-এর ২ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলা ভাষাকে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের থেকেও প্রাচীন হিসেবে প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণ করা হয়েছে।” এই কৃতিত্ব অভাবনীয়।

আরও পড়ুন-অনায়াস জয় ভারতের

কারণ, এতদিন আমরা জানতাম বাংলা ভাষার আদিতম নিদর্শন চর্যাপদ। যদিও চর্যাপদে বাংলা, হিন্দি, মৈথিলি, অহমিয়া ও ওড়িয়া— এই পাঁচটি ভাষার মিশ্রণ দেখা যায়, কিন্তু ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘দ্য অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ বইতে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করেন, চর্যাপদের ভাষাই বাংলা ভাষার অদ্যাবধি আবিষ্কৃত আদিতম রূপ। ১৯২৭ সালে ডক্টর মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ্‌ প্যারিস থেকে প্রকাশিত Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha বইতে সুনীতিবাবুর মতকেই সমর্থন করেন। চর্যাপদের ভাষার উপর নিজেদের অধিকারিত্বের দাবি জানিয়েছিল আরও একাধিক পূর্বভারতীয় ভাষাগোষ্ঠী। কিন্তু ভাষাবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ফল বাংলার অনুকূলেই যায়। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র মতে চর্যাপদের ভাষা বঙ্গ-কামরূপী। এতে পশ্চিম বাংলার প্রাচীন কথ্য ভাষার নমুনা দেখতে পাওয়া যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর সম্পাদিত ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা বৌদ্ধ গান ও দোহা’ বইয়ের ভূমিকায় চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদ ও কৃষ্ণাচার্যের দোহা এবং ডাকার্ণবকে সম্পূর্ণ প্রাচীন বাংলার নিদর্শন বলে দাবি করেছেন। ভাষাতাত্ত্বিক যে যে বৈশিষ্ট্যের সাপেক্ষে এর বাংলা ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি কার্যকরী হয়, তা হল— সম্বন্ধ পদে ‘অর’ বিভক্তি, সম্প্রদানে ‘কে’, সম্প্রদানবাচক অনুসর্গ ‘অন্তরে’, অধিকরণবাচক অনুসর্গ— মাঝে, অতীত ক্রিয়ায়—ইল ও ভবিষ্যৎ ক্রিয়ায় ‘অব’ ইত্যাদি। গুনিয়া, লেহঁ, ভণিআ, উঠি গেল, কহন ন জাই, আপনা মাংসে হরিণা বৈরী, হাড়িতঁ ভাত নাহি ইত্যাদি বাগভঙ্গিমা ও শব্দযোজনা বাংলা ভাষায় পরবর্তীকালেও সুলভ। এর সঙ্গে অবশ্য বেশ কিছু পশ্চিমা অপভ্রংশ শব্দও রয়েছে এখানে। তবে সেগুলি মূলত কৃতঋণ শব্দ হিসেবেই চর্যায় ব্যবহৃত হয়েছে। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন—“চর্যার আচার্যেরা কামরূপ, সোমপুরী, বিক্রমপুর—যেখান থেকেই আসুন না কেন, আশ্চর্যের বিষয়, এঁরা সকলেই রাঢ় অঞ্চলের ভাষানীতি গ্রহণ করেছিলেন।”

আরও পড়ুন-পাকিস্তানকে হারিয়ে প্রথম পয়েন্ট, বোলারদের দাপটে সহজ জয়

শেষে কিছু অপ্রিয় কথা না বললেই নয়। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০২০-তে বেশ কিছু ভাষাকে ধ্রুপদী বলে উল্লেখ করে সেগুলোর উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করার কথা বলা হয়েছে। সংস্কৃত, লাতিন, গ্রিকের সঙ্গে সঙ্গে ক্ল্যাসিকাল হিসেবে তামিল, তেলুগু, কানাড়া, মালয়ালম, ওড়িয়াকেও কেন্দ্রীয় সরকারি স্তরে আগেই ‘ধ্রুপদী ভাষা’ হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে। তাহলে মোদি সরকার বাংলাকে ‘ধ্রুপদী’ মর্যাদা দিতে এত দেরি কেন করল? স্পষ্টতই, উদ্দেশ্যটা রাজনৈতিক। ২০১৭ সালে বাংলার রাজ্য বিজেপির এক মুখপাত্র প্রকাশ্য টক শো-তে দাবি করেছিলেন, বাংলা ভাষার ‘ধ্রুপদী’ মর্যাদা পাওয়ার কোনও অধিকারই নেই। কারণ, এই ভাষাটাই নাকি আদৌ মৌলিক নয়। বাঙালির জাতিসত্তা, মেধাসত্তা ও গৌরবকে যারা অস্বীকার করে, ঘৃণা করে, তারাই আবার বাংলা দখলের খোয়াব দেখে। আজ, বোঝাই যাচ্ছে বাংলায় নিজেদের পায়ের ছাপ দৃঢ় করার অভিসন্ধি নিয়েই তারা বাংলা ভাষাকে সম্মান জানাচ্ছে। কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব কোনও মোদি-শাহর দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করে না। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যিকরা জন্মেছেন এই ভাষায়। বাংলা ভাষা চিরকালই ধ্রুপদী। চিরকালই তা সম্ভ্রমের।

Latest article