থর মরুভূমি, সাহারা মরুভূমি, মৌসিনরাম (আগে চেরাপুঞ্জি ), সাইবেরিয়া ইত্যাদি জায়গাগুলির কোনওটি ভয়ানক গরমের জন্য, কোনওটি অতি-বৃষ্টির জন্য আবার কোনওটি চরম ঠান্ডার জন্য বিখ্যাত। এটাই হচ্ছে এক-এক জায়গার জলবায়ু। কিন্তু এমনটি হচ্ছে কেন? বা এমনই কি চিরকাল থাকবে? কী কী কারণে এইসব অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে তা নিয়ে, বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা করার আগে কয়েকটা বিষয় জানা দরকার। যেমন পৃথিবীর উত্তপ্ত অবস্থা, শৈত্যের অবস্থা সম্পর্কে একটু নজর দেওয়া এবং সম্যক ধারণা হতে হবে।
পৃথিবীর গতি
পৃথিবী লাট্টুর মতো ঘুরছে। ঘুরন্ত লাট্টুর যেমন মাটিতে পিন স্থির থাকলেও মাথাটি নিজের চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে একটি বৃত্তের পথে চলে, পৃথিবীর উত্তর মেরুও তেমনি একটি বৃত্তাকার পথে নিজের চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে চলে। এই বৃত্তাকার পথ একবার অতিক্রম করতে ২৬ হাজার বছর সময় লাগে। বস্তুত এখন উত্তর মেরু সূর্য থেকে দূরে যাওয়া শুরু করে দিয়েছে। এই কারণে গরম অবস্থা কাটিয়ে, পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে আগামী ১৩ হাজার বছর পর চরম শৈত্য আসবে। এর প্রভাব, আগামী ১ হাজার বছর পর থেকে বোঝা যাবে।
মেরুর দিকে গতি
সূর্যের আপাতগতি মোটামুটি বিষুবরেখা অঞ্চল দিয়ে। বিষুবরেখা অঞ্চলের তাপমাত্রা মেরু অঞ্চল থেকে অনেক বেশি । তাই জলীয় বাষ্প-সহ অন্যান্য গ্যাসীয় পদার্থ নিয়ে গঠিত বায়ুমণ্ডলের (atmosphere) উচ্চতা বিষুবরেখা অঞ্চলে সবথেকে বেশি। এই উচ্চতা প্রায় ১৬ থেকে ২০ কিলোমিটার। আগে ধরে নেওয়া হত, বিষুবরেখা অঞ্চল থেকে তাপ একটি মাত্র উল্লম্ব চক্রের মাধ্যমে উভয় মেরু অঞ্চলে পৌঁছায় । কিন্তু তাতে, মরুভূমি অঞ্চলের অধিক তাপমাত্রার ব্যাখ্যা দেওয়া যাচ্ছিল না। কারণ মোটামুটি ভাবে তাপগতির ফলে যেখানে বায়ুর ঊর্ধ্বগতি সেখানে নিম্নচাপ ও বৃষ্টিপাত এবং যেখানে বায়ুর নিম্নগতি, সেখানে উচ্চচাপ ও অনাবৃষ্টি । বর্তমানে বিষুবরেখা থেকে মেরু অঞ্চল পর্যন্ত ৩টি বিপরীতমুখী উল্লম্ব চক্র গতি বিবেচনা করা হয় । প্রথম চক্রটি হ্যাডলি চক্র, দ্বিতীয়টি ফেরারেলচক্র ও তৃতীয়টি পোলার চক্র। এই অনুযায়ী ৩০ ডিগ্রি লাটিটুড অঞ্চলে হ্যাডলি চক্র ও ফেরারেল চক্র উভয়েরই নিম্নমুখী গতি, তাই বৃষ্টিপাত কম, গরম বেশি। সাহারা ও থর মরুভূমি এই ল্যাটিচুডে অবস্থিত। বিষুবরেখা অঞ্চলে ও ৬০ ডিগ্রি লাটিটুড অঞ্চলে বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী গতি, তাই জায়গাগুলি যথাক্রমে সাইক্লোন ও টর্নেডোপ্রবণ। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে ত্রিমাত্রিকভাবে ৬টি বিশাল আকৃতির গাড়ির রবারের ফাঁপা টিউব দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে কল্পনা করা যেতে পারে । বিষুবরেখা সংলগ্ন দু-পারে হ্যাডলি চক্র, তারপর ফেরারেল চক্র ইত্যাদি। বিষুবরেখা থেকে চক্রগুলির সন্ধিস্থল-এর দূরত্ব তাপমাত্রার পরিবর্তনে পরিবর্তিত হয় । অর্থাৎ এখন যেখানে মরুভূমি সেখানে বৃষ্টি হতে পারে (দুবাইয়ে ব্যাপক বৃষ্টি, বিশ্ব উষ্ণায়ন-এর উদহারণ)।
বিষুবরেখা বরাবর
এতক্ষণ বিষুবরেখা অঞ্চল থেকে মেরুর দিকে কীভাবে তাপগতি হয়, তারই আলোচনা হচ্ছিল। যেহেতু পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘুরছে, তাই পৃথিবীর ওপর বায়ুমণ্ডল, জাড্যতার জন্য পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যাচ্ছে। আবহাওয়াবিদরা রেডিও সন্দি রেডিও উইন্ড (RSRW) বেলুন পর্যবেক্ষণ করে এগুলি উপলব্ধি করেছেন। আবার এই বায়ুমণ্ডলের পশ্চিম গতিও বিষুবরেখা অঞ্চলে বেশ কয়েকটি পূর্ববর্ণিত চক্রাকার উলম্ব ঘূর্ণনের দ্বারা পৃথিবীকে বেষ্টন করে রেখেছে। এগুলিকে বলে ওয়াকার সার্কুলেশন। উলম্ব গতিচক্রগুলির সংযোগস্থল কোনওটি ঊর্ধ্বমুখী (নিম্নচাপ, বৃষ্টিপাত) আবার কোনওটি নিম্নমুখী (ঊর্ধ্বচাপ, অনাবৃষ্টি) অঞ্চল। তাপমাত্রার পরিবর্তনে এই অঞ্চলগুলিও পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ অনিয়মিত, অপরিণত মৌসুমিবায়ুর প্রভাব বাড়বে। তাই কালের (শীত, বর্ষা, গ্রীষ্ম, ইত্যাদি) পরিবর্তন অনিবার্য।
বিপদ বৃদ্ধি
তাপ বাড়লে হট এয়ার বেলুনের মতো উল্লিখিত টিউবগুলির এবং ওয়াকার সার্কুলেশন-এর আয়তন বৃদ্ধি পাবে অর্থাৎ তাপ পরিবর্তনে, মেরুর দিকে তাপগতির যেমন ব্যাঘাত হবে, তেমনি পশ্চিম গতি বা ওয়াকার সার্কুলেশনও বিঘ্নিত হবে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে (atmosphere) তাপমিশ্রণ ঘটনাটি অনেকটা কৌটোর মধ্যে ঝালমুড়ি মাখার মতো। এখানেও তাপ সারা বায়ুমণ্ডলে (atmosphere) ছড়িয়ে পড়বে এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের পথ সুগম করবে। এর ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলা থেকে শুরু করে সমুদ্রসমতলের উচ্চতা বৃদ্ধি, বাষ্পায়ন বৃদ্ধি, অবাঞ্ছিত জায়গায় প্রতিকূল, অসহনীয়, অবর্ণনীয় পরিবেশ চক্রাকারে বাড়বে। এক কথায় পরিবেশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে। এশিয়া মহাদেশকে সব থেকে বেশি জনবহুল ও সুবিশাল হিমালয় পর্বতমালার অবস্থানের জন্য বিশ্ব উষ্ণায়নের আঁতুড়ঘর বলা হয়।
আরও পড়ুন- বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠকে মুখ্যসচিব
বর্তমান অবস্থা
বিশ্ব উষ্ণায়ন একটি সংবেদনশীল, একেবারেই মানব সভ্যতার দ্বারা সংঘটিত অতি ধীরগতি থেকে বর্তমানে ভয়ানক তরান্বিত গতি হয়েছে। ঘটনাটি এই রকম— ১৯০০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত যদি ১০০ একক তাপ বেড়ে থাকে তবে ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে বেড়েছে ৫০ একক তাপ এবং ২০২১ থেকে ২০২৩-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ বছরে বেড়েছে ৫০ একক তাপ। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ (IPCC)-এর সতর্কবাণী ছিল ২০৩০ পর্যন্ত যেন তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায়। বাস্তবে তা ঘটে গেছে তার অনেক আগেই ২০২৩ নভেম্বর মাসে। এর ফলে ২০৪০ সালের বিপর্যয়পূর্ণ পরিবেশ আমরা ২০৩০ সালেই পেতে চলেছি। আর এটাও বলে রাখা ভাল যে পরিবেশের দিক থেকে সুন্দরবন অঞ্চল পৃথিবীর সবথেকে সমুদ্র সমতলের কাছাকাছি সমস্ত প্রাণিজগতের জন্য বিপজ্জনক জায়গা। এখনই ইনটেনসিভ কেয়ার না নিলে অদূর ভবিষতে মানচিত্র থেকে সুন্দরবনের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
সাবধানতা অবলম্বনে
যদিও আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ড তবুও প্রতিটি রাজ্যের উচিত শহরে বসবাসের জনসংখ্যার ঊর্ধ্বসীমা রাখা। ঊর্ধ্বসীমার বেশি জনসংখ্যা হলেই আর একটি সমস্ত সুযোগ-সুবিধা সমেত ৫০ কিলোমিটারের বাইরে নতুন শহরের প্রণয়ন। আগামী ৫ বছরের মধেই বকখালি-ত্রিবান্দম-পরবন্দর ন্যাশনাল বিচ রোড প্রস্তুত করা উচিত। প্রতিটি ব্লকে সরকারি বৃক্ষরোপণ সংস্থা থাকা উচিত। যেখানে বৃক্ষরোপণ শংসাপত্র থেকে গাছের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে । কোন ছাত্র বা ছাত্রী কতগুলি বৃক্ষ রোপণ করেছে তার ওপরেও আবশ্যিক নম্বর রাখা উচিত। শুধু তাই নয়, কর্মরত জীবনে প্রমোশন, কোম্পানির লাইসেন্স, গাড়ি কেনার পারমিশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৃক্ষ রোপণের শংসাপত্র থাকা বাধ্যতামূলক করা উচিত।