গণতন্ত্রকে শেষ করার চেষ্টা

একনায়কতন্ত্রী স্বৈরাচারী কর্তৃত্ববাদী শাসন শেষ করে দিতে চাইছে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ভিত। শাহ-মোদি সরকারের লক্ষ্যই হল পশ্চিমবঙ্গকে এলোমেলো করে দেওয়া। কীভাবে সেই ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন হচ্ছে, তুলে ধরছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বরিষ্ঠ অধ্যাপক ড. শিবরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

Must read

নিছক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা নয়, পশ্চিমবঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন একতরফাভাবে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কয়েকজন আধিকারিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে। রাজ্যকে তার ন্যায্য আর্থিক পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ১০০ দিনের কাজের টাকা দেওয়া হচ্ছে না। কয়েক বছর আগে মুখ্যসচিবের অবসরের প্রাক্কালে তাঁকে কেন্দ্রে বদলির নির্দেশ দেওয়া হল। নির্দেশে বলা হল, মুখ্যসচিব তাঁর অবসরের দিন প্রথমার্ধে দিল্লিতে কর্মীবৃন্দ ও প্রশাসনিক সংস্কার মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট করবেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অবসর নেবেন। এই ধরনের সরকারি হুকুমনামা ভূ-ভারতে কোথাও হয়েছে, শুনিনি। রাজ্যের সঙ্গে কোনও পরামর্শ না করে, এককথায় গায়ের জোরে রাজ্য সরকারের একাধিক উচ্চপদস্থ আইপিএস আধিকারিককে কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ দেওয়ার আদেশ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে নজিরবিহীনভাবে জারি করা হল। ইদানীং বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য বাংলার বাইরে বাঙালিদের পেটানো হচ্ছ। কেন্দ্র নীরব দর্শক। অন্যায়-অবিচারের সাম্প্রতিকতম সংযোজন হল, ১৮ অক্টোবর (২০২৫) দার্জিলিং পাহাড়-ডুয়ার্স অঞ্চল আচমকা পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অন্ধকারে রেখে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জনৈক অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস আধিকারিককে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করল। এই অঞ্চলটি গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ) এলাকার অন্তর্ভুক্ত, যেটা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রশাসনিক আওতার বাইরে নয়। এর ফলে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের মূল নীতি লঙ্ঘন করা হল এবং সেই কারণে ভারতীয় সংবিধানের মূল কাঠামোকে আঘাত করা হল। জিটিএ এলাকার প্রশাসন পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা থাকলেও চূড়ান্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত রাজ্য সরকারের হাতেই আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। অপরদিকে সমগ্র ভারতবর্ষের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। তাই বলে থানার বড়বাবু জেলার পুলিশ সুপার বা জেলাশাসক নিয়োগের দায়িত্ব কি কেন্দ্র গ্রহণ করতে পারে? রাজ্য কি মধ্যস্থতাকারী চেয়েছিল? রাজ্য সরকারকে এড়িয়ে এই ধরনের একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিপজ্জনক প্রবণতা। কোনও দলই চিরকাল শাসনক্ষমতায় থাকে না। কিন্তু থাকে দেশ, সংবিধান, সরকার ও প্রশাসন। যদি ভবিষ্যতে নতুন কোনও সরকার এসে এই ধরনের অপ্রীতিকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তা হলে বর্তমান শাসকদল সেই সিদ্ধান্ত সমর্থন করবে তো? আমরা কিন্তু তখনও বিরোধিতা করে যাব। মনে পড়ছে, রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, ‘পিএম টু ডিএম’ প্রস্তাবটি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারি স্তরে আলোচনা চলছিল। অথাৎ প্রধানমন্ত্রী সরাসরি জেলাশাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। রাজ্য সরকারের কোনও ভূমিকা থাকবে না। রাজ্য সরকারকে জানানোর প্রয়োজন নেই। তবে আর যুক্তরাষ্ট্র থাকল কোথায়? পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার-সহ একাধিক রাজ্য সরকার যথার্থভাবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল। জেলাশাসকরা রাজ্য সরকারের অধীনে কাজ করেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে রাজ্য সরকারের মাধ্যমেই করতে হবে। অবশেষে এই প্রস্তাব বাতিল হয়। আশঙ্কা হয়, মান্যবর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আবার এই প্রস্তাবটি কার্যকর করার চেষ্টা না করেন।
বলা হচ্ছে, আগেও দার্জিলিংয়ে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করা হয়েছিল। ঠিক কথা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সম্মতিক্রমে। প্রথমবার সুবাস ঘিসিং-এর আন্দোলনের সময়। আটের দশক। কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার। পাহাড়ের আন্দোলনে বামফ্রন্ট সরকারের বেসামাল অবস্থা। দার্জিলিং রেঞ্জের ডিআইজি আন্দোলনকারীদের গুলিতে গুরুতর আহত হন (পাহাড়ের তৎকালীন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে জলপাইগুড়ি রেঞ্জকে ভাগ করে দার্জিলিং ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে সাময়িকভাবে নতুন পুলিশ রেঞ্জ অর্থাৎ দার্জিলিং রেঞ্জ তৈরি হল)। চিন্তিত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু মুখ্যসচিবের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। কেন্দ্রের কাছে মধ্যস্থতাকারী চাওয়া হয়, যাতে আন্দোলনের তীব্রতা কমে আসে। একই সঙ্গে প্রকাশ্যে বলা যাবে না যে রাজ্য সরকারই অনুরোধ করেছে। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সচিব, স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক) দফতর নিজে ফাইল তৈরি করলেন। মুখ্যমন্ত্রীর আরও একটি অনুরোধ ছিল, কোনও আমলা নয়, যেন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে মধ্যস্থতাকারী করা হয়। সেইমতো একজন কংগ্রেস সাংসদকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দ্বিতীয়বার ২০০৯ সালে কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারের আমলে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করা হয়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ড. মনমোহন সিং। পাহাড় আবার উত্তাল। গোর্খাল্যান্ড পার্বত্য কাউন্সিলের (Gorkhaland Hill Council) প্রধান সুবাস ঘিসিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন চলছিল। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এক সামরিক আধিকারিককে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে নিয়োগ করেছিল। তিনি অবশ্য কিছুদিন পর পদত্যাগ করেছিলেন। ইতিমধ্যে ২০১১তে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। পাহাড়ের সমস্যার সমাধানে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। জিটিএ সংক্রান্ত খসড়া বিল তৈরি, আইন প্রণয়ন এবং এবং এই সংস্থাটি আইন অনুযায়ী গঠনের ব্যাপারে মমতা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। এখন কী সমস্যা হচ্ছে? জিটিএ-তে কোনও প্রশাসনিক সমস্যা হচ্ছে কি? আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে কি? কোনও উত্তাল আন্দোলন আছে কি? সম্প্রতি প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে পাহাড়ের মানুষ ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। কোনও কেন্দ্রীয় সাহায্য নেই। সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ। ২০২৬-এ বিধানসভার নির্বাচন। নির্বাচনের আগে পাহাড়কে অশান্ত করার, গোর্খাল্যান্ডের দাবি তোলার হীন প্রচেষ্টা। লাভ কিছু হবে না। স্বামী বিবেকানন্দের চিরস্মরণীয় কথা— চালাকির দ্বারা কোনও মহৎ কাজ হয় না।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে হল ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান

Latest article