তাক লেগে গেল মানুষজনের। আলো দৌড়াচ্ছে রাস্তা দিয়ে। টুনি বাল্ব জ্বলছে আর নিভছে। আর তাতেই মনে হচ্ছে, আলোগুলো ছোটাছুটি করছে।
কাণ্ডটা যে ঘটিয়েছে তার বয়স মোটেই বেশি নয়। একেবারে হাফপ্যান্ট পরা ছেলে। নাড়ুয়া শ্রীশিক্ষায়তনে পড়ে। থাকে বিদ্যালঙ্কার পাড়া থেকে একটু এগিয়ে। তারই জাদু প্রদর্শনী এটা।
অবাক চোখে চন্দননগরের লোক সেবারই প্রথম চিনল আলোর খেলা কাকে বলে!
কিন্তু বিস্ময়ের আয়ু মোটে একদিন। পাড়ার প্রবীণরা বললেন, অমন ভাবে আলো জ্বলছে নিভছে বলে রাস্তায় যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে। রাস্তাটা অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। তাই, জগদ্ধাত্রী পুজোর নবমী কাটলেই টুনি লাইটগুলো রাস্তা থেকে খুলে ফেলা হল। সিদ্ধান্ত পুজো কমিটির কর্তাদের।
কষ্ট পেল ছেলেটা। কিন্তু জেদ চেপে গেল। গোটা একটা বছর সেই জেদ বুকে ধরে রাখল ক্লাস এইটের হাফ প্যান্ট। পরের বছর বিদ্যালঙ্কার বারোয়ারির পুজো মাত হয়ে গেল তারই আলোর খেলায়। বিদ্যালঙ্কার পুকুর থেকে হাসপাতাল মোড়। পুরো এলাকা জুড়ে টুনি বাল্ববের জ্বলা-নেভা। আলোর ছোটাছুটি। হইচই পড়ে গেল সারা চন্দননগরে।
জাদুকরী আলোর ভেলকি কার সৌজন্যে? শ্রীধর দাসের। নাড়ুয়া শ্রীশিক্ষায়তনের সরস্বতী পুজোতে আলোর খেলা দেখানো শুরু। স্কুলের সরস্বতী পুজোর বাজেট ১০ টাকা। তার মধ্যে ২ টাকা বরাদ্দ হল শ্রীধর দাসের আলোর ম্যাজিকের জন্য। সেবার তিনটে বার্লির কৌটো জোগাড় করেছিল শ্রীধর। আর কিনেছিল তিনটে সস্তার হোল্ডার। সেই সঙ্গে তিনটে ২০০ ওয়াটের বাল্ব, দুটো পেরেক আর ইলেকট্রিকের তার। এই সামান্য উপকরণ দিয়ে তৈরি হল লাল-নীল-হলুদ সিগন্যাল। আলোগুলো জ্বলছে আর নিভছে। আলোর এই ম্যাজিক দেখে সব্বাই কুপোকাত। হইচই পড়ে গেল গোটা স্কুল জুড়ে।
একটা দুটো নয়। চোদ্দোটা ভাইবোন শ্রীধরের। বাবা প্রফুল্ল দাস আলেকজান্ডার জুট মিলের কেরানি। মাইনে সপ্তাহে পনেরো টাকা। অভাবের সংসার। তার মধ্যেই শ্রীধর ওই আলোটুকুকে জাপটে ধরল। স্কুলের সরস্বতী পুজো থেকে এসে পড়ল একেবারে জগদ্ধাত্রী পুজোর বারোয়ারিতে।
ফরাসি বিপ্লবের সন্তান যেমন সম্রাট নেপোলিয়ন, তেমনই একদা ফরাসি উপনিবেশে দেবেন সরকারদের আলোর বিপ্লবের সন্তান শ্রীধর দাস, আলোর ম্যাজিশিয়ান।
আরও পড়ুন- দিল্লির ২১ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এফআইআর
বাবু পালের (Babu Paul) মতো আলোকশিল্পীরা একেবারে শ্রীধর দাসের গুরুকুলের ছাত্র। একই ঘরানার মানুষ। আলো নিয়ে কস্মিনকালে কোনও ট্রেনিং নেননি। পুরো ব্যাপারটাই হাতে কলমে শেখা। পারিবারিক ব্যবসা ছিল লোহার দোকানের। এবং সেটা কলকাতায়। তিন পুরুষের ব্যবসা। কলকাতার বড়বাজারে দোকান। বি-কম পাশ করার পরে সেই দোকানে বসতেন। পরে কলকাতার লোহার দোকান বিক্রি করে তিনি চন্দননগরে যান। সেখানে শিল্পী আলোক প্রামাণিকের থেকে তিনি কাজ শিখতে শুরু করেন। তারও পর আলোক শিল্পী অশোক কুণ্ডুর সাকরেদ হয়ে গিয়েছিলেন বাবু। বাগবাজারের পুজোতে আলোর জাঁক দেখে ভাবতেন, একদিন তিনিও…।
তারপর সুযোগ যখন পেলেন তখন বোড়ো চাঁপাতলায় নিজের কারখানায় বসে ভেলকি দেখিয়ে দিলেন গোটা বাংলাকে। সামান্য তার, রোলার আর টুনি বাল্ব, এই তাঁর উপকরণ। তাই দিয়েই ম্যাজিক দেখান চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো থেকে শুরু করে দেওঘরে শিবপুজোয়, পাঞ্জাবে গুরু গোবিন্দ সিং-এর জন্মোৎসব থেকে টাটানগরে জামশেদজি টাটার জন্মোৎসবে, গির্জা থেকে বিয়েবাড়িতে, ভারতের নানা প্রান্তে। হুগলিতে শ্যুটিং করতে এসেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। বলিউডের বিগ বি খবর পেলেন চন্দননগরের বিগ বি-র। বাবু পালের ডাক পড়েছিল মুম্বইয়ে ‘জলসা’ সাজানোর জন্য।
বাবু পালের আলোকসজ্জা সাতবার গিয়েছে দুবাইয়ের ‘শপিং ফেস্টিভ্যাল’-এ। ঢাকার দুর্গাপুজো বা রাশিয়ার হরেকৃষ্ণ মন্দিরও সেজেছে তাঁর আলোয়।
শ্রীধর দাসদের দেখাদেখি বাবু পালের মতো ম্যাজিশিয়ানরা যখন ফুটে উঠছিলেন চন্দননগরে, জগদ্ধাত্রী পুজোর সাবেকি আলোও তখন বদলে নিচ্ছিল নিজেকে। আস্তে আস্তে, কিন্তু অবধারিতভাবে।
সত্তরের দশক মুক্তির দশক। সেই দশকে আলোর পাশাপাশি চন্দননগরের লাইটিংয়ে এল যন্ত্রের কারসাজি। তাতে আলোর কেরামতির আকর্ষণ দ্বিগুণ বাড়ল। কালক্রমে এই বাবু পালের হাত ধরেই প্রথম দুবাইয়ে পাড়ি দিয়েছিল চন্দননগরের আলোকসজ্জা।
পরবর্তী কালে আবার এই বাবু পাল, শ্রীধর দাসের মতো শিল্পীরাই আক্ষেপ করে বলতেন, আজকাল লাইট আর লাইটিংকে শিল্প বলে ধরে না কেউ। সবই এখন ব্যবসা, কেবলই ব্যবসা। সৃজনশীলতা আর দক্ষতার প্রয়োজন সেখানে ফুরিয়েছে।
বাবুর (Babu Paul) আলোকসজ্জার বিশেষত্ব ছিল সাম্প্রতিক ঘটনা থিমের মাধ্যমে আলোয় উপস্থাপন। যা দেখলে দর্শক নস্ট্যালজিয়ায় ভুগতেন। ‘টার্গেট অডিয়েন্স’ ছিল মূলত ছোটরা। যে কোনও অনুষ্ঠানে কমবয়সিদের কথা ভেবে কিছু না কিছু মজার আলোকসজ্জা তৈরি করতেন। এ ভাবেই চন্দননগরের আলোয় তৈরি হয়েছে ডিজ়নিল্যান্ড। অলিম্পিক্স থেকে বিশ্বকাপ ফুটবল, বাবুর আলোর কারসাজি মানেই ঝকঝকে ‘ম্যাজিক’। সন্দেহাতীত ভাবে সমসাময়িক শিল্পীদের থেকে বাবু এগিয়ে ছিলেন তাঁর ভাবনা এবং সৃষ্টিশীলতায়।
কেবল অনন্য শিল্পী নন, মানুষ হিসেবেও বাবু ছিলেন অনন্য সাধারণ। করোনার সময় দু’বছর কোনও কাজ ছিল না। তখনও কর্মচারীদের ছুটি দেননি বাবু। অন্য আলোকশিল্পীদের পাশেও সেই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
সেই বাবু পাল (Babu Paul) চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর কাজ থেকে যাবে। যাবেই।